Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান স্মরণে

অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান স্মরণে

অধ্যাপক মুহাম্মদ দিদারুল ইসলাম

১৯৬১ সনে চট্টগ্রামে সরকারী মুসলিম হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশের পর সরকারী কমার্স কলেজে ভর্তি হই। সেখানেই কাজী সামশুর রহমানের সাথে আমার পরিচয়। সময় অতিক্রান্তের সাথে আমাদের দুই জনের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন রচিত হয়। এইভাবে বি.কম. পাশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. কম.-এ চান্স না হওয়ায় অগত্যা রাজশাহী বিশ্ববিদালয়ে ভর্তি হই। প্রথমে গিয়ে উঠি আমার ফুফা চট্টগ্রামের কৃতিসন্তান ড. এনামুল হকের রাজশাহী শহরের ‘সাঁঝের মায়া’ বাসায়। সাথে উনার ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়–য়া মুহাম্মদ ইবনে এনাম ও অপরজন একজন ব্যাংকার। প্রথম বৎসর হলে সিট পাইনি। ফলে এখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বাসে যাতায়াত। নীচের তলায় থাকতাম। বুয়া এসে রেঁধে দিয়ে যেত। বাজার করতে হত আমাদেরকে। ২-৩ টাকায় দু’কেজি ওজনের পদ্মার ইলিশ। স্বাদ কাকে বলে! – না খেলে কেউ বিশ্বাস করবেন না। পাঁচ টাকার ১০০টি আমের (১) ঝুড়ি- প্রসঙ্গত: রাজশাহী তো আসলে আমের জন্য বিখ্যাত এই কথা সবাই জানে। ২য় বর্ষে এসে সিট পেলাম এস. এম. (শাহ্ মখদুম) হলে। কাজী সমশু পেল ‘লতিফ হলে’। প্রতি মাসে বাবা পাঠাতেন ১৫০/- টাকা। কাজী সমশুও অনুরূপ টাকা পেত। ১২/- টাকা টিউশন ফি, হলে অবস্থান, দু’বেলা খাই-খরচ সহ ৪৫/-। প্রসঙ্গত তখন স্বর্ণের ভরি ৫০/- টাকা। হলের বাবুর্চি, বয়, কুমিল্লা, নোয়াখালীর হওয়ায় খেতে তেমন অসুবিধা হত না। হলে বসে একটি ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ ছাত্র বিবাহিত ও শ্বশুর বাড়ীর- পয়সায় লেখাপড়া করে। যে পোষ্টাল পিয়ন মানি অর্ডারে আমাদের জন্য প্রেরিত টাকা আন্ত। সে আমাদেরকে বলতো স্যার! আপনারা তো ধনীর ছেলে। এদিকে অধিকাংশ ছেলে-মেয়েদের ধারণা ছিল- চট্টগ্রামের লোকেরা অত্যন্ত ধনী। সে কারণে দেখতাম সকাল, বিকেলের নাস্তা তারা করত না। সকাল- ৯ টার মধ্যে তখন হলে ভাত রেডি। তা খেয়ে সোজা ক্লাসে। বিকেলে মাগরিবের নামাযের পর ভাত খেয়ে- পড়া-শুনা করে ঘুমিয়ে পড়ত। আমাদেরকে অভ্যাস বশত: হলের ডাইনিং হলের চার ছয় আনায় চা-নাস্তা না হলে চলত না। এদিকে কাজী সমশু তার হলে ছাত্রলীগের একটি বলয় সৃষ্টি করে ফেলেছে। বিকেল হলে সুরম্য আম বাগানের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ায় দলবল সহ চা-নাস্তা করতে যেত। বিল পরিশোধ করত সে নিজে- মধ্যে মধ্যে আমি। এদিক ২১ ফেব্রুয়ারী আসলে তো কথাই নেই। দলবল ভারী হতে থাকে। আমি তো ছিলাম নিত্যসঙ্গী। আমরা নিজের পয়সায় ছোট পরিসরে ‘স্মরণিকা’ বের করতাম সেখানে তার ও আমার লেখা থাকত। তখন একটি মহল প্রচারনা চালাত এগুলো সব আমেরিকান সি.আই.-এর টাকা। এদিকে হলের সংসদ নির্বাচন আসলে কাজী সামশু বিপুল ভোটে ‘লতিফ হলে’র জি. এস. নির্বাচিত হয়। এভাবে সময় অতিক্রান্ত হয়ে ১৯৬৭ সালে আমি এম. কম, কাজী সামশু অর্থনীতিতে এম. এ. পাশ করে চট্টগ্রামে ফিরে আসি। তখন সরকারী কলেজে থেকে বেসরকারী কলেজে বেতন বেশী ছিল।
এদিকে দূরত্বের কারণে আমার অপর আত্মীয় রাউজানের ডা: ফরিদ আহমদের (মরহুম) নানার সুপারিশে চট্টগ্রাম সিটি কলেজে (বর্তমানে সরকারী) কলেজে চান্স পেয়ে যাই। কিন্তু তখনকার সময়ের জাদরেল অধ্যক্ষ মরহুম রেজাউল করিম চৌধুরী ছাহেব শর্ত দিয়ে বসেন- এক বৎসর বিনা বেতনে থাকতে হবে। আমি যৌক্তিক কারণে শর্ত মানতে রাজী ছিলাম না বলে সেখানে যোগদান করিনি। বাবা রিয়াজউদ্দীন বাজারে হার্ডওয়ারের ব্যবসায়ী ছিলেন বিধায় আমার কলেজে যোগদান ভালোভাবে গ্রহণ করেন নি। কাজী সমশু নন্দন কানন ইশ্বর নন্দী লেনে ভাড়া বাসায় থেকে নানা ধরণের ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজকে নিয়োজিত রাখে। এরি মধ্যে ১৯৭১ সনে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ১২০ নং আন্দরকিল্লায় আওয়ামী লীগের অফিস। যুদ্ধ চলাকালীন আমিও মধ্যে মধ্যে যাতায়াত করতাম। একদিন পাক আর্মি তাকে সহ আরও কয়েকজনকে ধরে সার্কিট হাউসে নিয়ে যায়। যখন মেজর অফিসারের সামনে তাদের হাজির করা হয় অফিসার তাদের পই পই করে চেক করার সময় তার চোখ পড়ে কাজী সমশু’র দিকে। সবাই দেখেছেন কাজী সমশুর ডান হাত একটি রোগের অপারেশনের কারণে লম্বায় ছোট- বাম হাতে সব কাজ করত। বলা বাহুল্য সেই হাতে সে তাদের নিজস্ব গাড়ী চালাত। গাড়ীতে তার সাথে উঠলে সে এত জোরে গাড়ী চালাত যে- যদি বলি স্পীড কমাও। আমাকে ধমক দিয়ে বলত্। সহ্য না হলে গাড়ী থেকে নেমে যা- নীরব হয়ে যেতাম।
অফিসার তাকে চিনতে পারেন। পাকিস্তান আমলে বহু উর্দুভাষী ছাত্র আমাদের সাথে কমার্স কলেজের ছাত্র ছিল। এক বাংলা ছাড়া সব বিষয় ছিল ইংরেজীতে। তাকে আমিও চিনতাম সহপাঠি হিসেবে, কিন্তু নামটি ভুলে গেছি। সে খুব কড়া সূরে সিপাহীদের বলল- এ কাকে ধরে এনেছ- এতো মাজুর হ্যায়- তাকে ছেড়ে দাও। এইভাবে আল্লাহ্র বিশেষ রহমতে সে বেঁচে যায়। বাকীদের ভাগ্য অজানা। এরপর কাজী সমশু শহরকে আর নিরাপদ না দেখে রাউজানের বাড়ীতে চলে যায়- সেখানেও রাজাকার- আলবদর বাহিনীর অপতৎপরতা দেখে- কিছু বন্ধু-বান্ধব ও অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরীসহ ফটিকছড়ি হয়ে আগরতলা পৌঁছে যায়। সেখানে সে শরনার্থীদের তত্ত্বাবধানের জন্য লিয়াঁজো অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। বেশ কিছুদ্দিন পর ত্রিপুরা ঘুরে কোলকাতা পৌঁছে। সেখানে স্বাধীনতা পক্ষের সরকারের একই কাজে থেকে দায়িত্ব পালন করে- সুযোগে ভারতের প্রায় শহর ভ্রমণ করে আগরতলা থাকাকালিন বিভিন্ন জনের মাধ্যমে আমাকে চলে আসার জন্য খবর দিতে থাকে- কিন্তু পাক বাহিনী কর্তৃক প্রায় পথ রুদ্ধ করে ফেলায়- চেষ্টা করেও যেতে পারিনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কাজী সমশু দেশে ফিরে আমার বাসায় উঠে। আমরা দুইজন একই বিছানায় ঘুমাতাম। সকালে নাস্তা করে সে চলে যেত। রাতে আস্ত কোনদিন খেত- কোনদিন খেত না। পরে শুনলাম সে চট্টগ্রামের বিভিন্ন কোম্পানীর শ্রমিক লীগ সংগঠনের নেতা হিসেবে কাজ করছে। এইভাবে প্রায় ছয়মাস পর দিদার মার্কেটের পেছনে মামা আবদুল্লাহ্ আল্ হারুন এম.পি. সাহেবের বাসার সামনে একটি বাসা ভাড়া করে। সেখানে প্রায়ই যেতাম- দেখতাম বিভিন্ন মিল, ফ্যাকটরি শ্রমিক সংগঠনের নেতা ও মালিক পক্ষের অগণিত মানুষের আনাগোনা। নেতা গাড়ী চাইলেই পাঠিয়ে দিচ্ছে। অত্যন্ত ব্যস্ত। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস- ‘৭৫ পট-পরিবর্তনে সবকিছু ওলট পালট। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুসহ (দুই কন্যা ব্যতীত) তাঁর স্ত্রী, দুই পুত্রসহ শিশু রাসেল ও পুত্র বধূদের নির্মমভাবে হত্যা করে। হায়রে মানুষ! তারা যদি জানত রোজ কেয়ামতে আল্লাহ্ রাব্বুল ইজ্জত প্রথম দিকে বিচার করবেন মানুষ হত্যাকারীদের এবং দোযখে নিক্ষিপ্ত করবেন। কাজী সামশু এরি মধ্যে কি একটা ব্যবসা ধরতে গিয়ে বিরাট মার খেয়ে যায়। এতে তার আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে।
এই অবস্থায় সে প্রথমে কধুরখীল জলিল আম্বিয়া কলেজে পরে মুজাফ্ফরাবাদ কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে। এরিমধ্যে সে বিয়ে করে- ১ ছেলে ও ২ মেয়ে। ছেলে প্রতিষ্ঠিত ঢাকায় থাকে। দুই মেয়ে মালেশিয়ায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হতে পি.এইচ.ডি করতে পাঠরত। ১ মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ১৯৮২ সালে সে আমাকে বলুয়ার দিঘীর খানকা শরীফে নিয়ে যায়। আমি হুজুর কেবলা তৈয়ব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির হাত মোবারকে বায়াত গ্রহণ করি। এর ফলে আমার জীবনের বহু কিছুর পরিবর্তন আসে। হুজুর কেবলা বলতেন ‘বাতিল-ছে দূর রহো। উছকা সাথ মোকাবেলা করো।’ আমরা কি- কেউ মানছি তাঁর প্রদত্ত উপদেশবাণী। আমি প্রায়ই সকালের নাস্তা নিয়ে আসতাম। একটু অসুবিধা হতো শীতের সময়। আমার স্ত্রী পাকা রাঁধুনে- সে পরিপাটি করে টিফিন কেরিয়ারে ঠিক করে দিত তা’ নিয়ে শীতের রাত্রির শেষ ভাগে আসকার দিঘীর পাড় থেকে বলুয়ার দিঘী। একদিন এ ভাবে দাঁড়িয়ে আছি রিকসার জন্য। শীত বেশী পড়ছিল- আর ভাবছি হায়রে এ সময় যদি একটি রিকসা পেতাম। ১০ মিনিট পর একটি রিকসা আসতে দেখলাম- যাত্রী হিসাবে পায়জামা-পাঞ্জাবী-মাথায় টুপি পরিহিত এক ভদ্রলোক। কাছে আসতেই হাঁক দিলাম- ভাই! আপনি কি বলুয়ার দিঘী খানকা শরীফ যাচ্ছেন। যদি যান আমাকে একটু সাহায্য করুন। ভদ্রলোক রিকসা থামিয়ে বললেন- আসুন। আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া জানালাম। শুধু এ’টা নয়- খানকা শরীফে যাওয়ার সময় বিশেষ করে সকালের ফরজ নামাজে যাওয়ার সময় মাথায় অনেক কিছু চিন্তা আসত। হুজুর কেবলা ফজরের নামায শেষে কোরআন থেকে আয়াত তেলোয়াত করে তকরির করতেন। নঈমী সাব হুজুর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এর তরজুমা করতেন। প্রায়ই দেখতাম- যা কিছু মাথায় চিন্তা করতেছিলাম- হুজুর কেবলা সেই বিষয়ের উপর তকরির করছেন। মনটা আনন্দে ভরে যেত। এরপরই তিনি নাস্তায় শরীক হয়ে আরামে চলে যেতেন।
তিনি অনর্থক খানকা শরীফে বসে গল্প গুজব পছন্দ করতেন না। এই রকম কিছু দেখলে সাথে সাথে বলে ফেলতেন, নামায, তকরির, মুনাজাত শেষ হয়েছে। এখানে অহেতুক গল্প গুজব না করে যার যার কাজ কর্মে ছড়িয়ে পড়। ১৯৮৬ সনে বাংলাদেশে হুজুর কেবলার শেষ সফর। ঢাকায় মাদ্রাসা-এ কাদেরিয়া থেকে নাস্তা করে স্বদেশে ফিরে যাবেন। ফজর নামাজের মুনাজাত শেষে আমরা সবাই কাঁদছিলাম। তিনি মিম্বর থেকে উঠে হঠাৎ পিছনে ফিরে ক্রন্দনরত পীর ভাইদের উদ্দেশ্যে বললেন- তোমরা কাঁদতেছ কেন। নামাজ পড়- ছবক যা দেয়া হয়েছে তা পালন করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। বাতিলের প্রতিরোধ কর। এমন কিছু কর না- যাতে রোজ কেয়ামতে আমাকে শরমিন্দা হতে হয়। বুঝলাম হুজুর কেবলা আর আসবেন না। কর্মকর্তারা প্রায়ই ছিরিকোট যেত। ফিরে এসে আশেকান পীর ভাইদের প্রবোধ দেয়ার জন্য বলত- আগামী বৎসর তিনি আসবেন। কিন্তু বৎসর যায়- হুজুর কেবলা আর আসেন না। খবর পেলাম তিনি অসুস্থ। ১৯৯০ সালে তাই বেকারার হয়ে ভাই আজিজের নেতৃত্বে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট টীম হুজুরকে দেখার জন্য ছিরিকোট শরীফ যাওয়া হলো। প্রসঙ্গত হুজুর কেবলা কে-কে আসছে আগে থেকেই খবর নিয়ে রেখেছেন। এবং নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন রাতে যাতে পিন্ডি থেকে রওয়ানা না হই। পথে আফগান উদ্বাস্তুরা- সুযোগ পেলে লুটপাট করে। তাই রাওয়ালপিন্ডিতে রাত কাটাতে হলো এক ধনী মার্বেল পাথর ব্যবসায়ী পীরভাই মরহুম ওসমান গণির বাসায়। পরদিন সকালের নাস্তা, দুপুরের খানা খেয়ে সিরিকোটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
মাগরিবের আগে দরবার শরীফ পৌঁছলাম। শুকরিয়া জানালাম আল্লাহ্র কাছে। নীচে মেহমান খানায় সবাই। আমাদের তিনজন আমি, মেট্রোপোল কমিউনিটি সেন্টারের মালিক জনাব লফিত সাহেব, আরামিট লি: এর কর্মকর্তা আমার বন্ধু আলী ইমাম এর জায়গা হল নতুন ভবনের দোতলায়- যাতে এসি ও আধুনিক ওয়াশ রুম দেখে কৃতজ্ঞতা জানালাম। এদিকে মাগরিবের নামাজ ও সিরিকোটী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির মাজার জিয়ারত শেষে রুমে এলাম- সাথে সাথে নীচে চা-নাস্তার ডাক পড়ল। হুজুরের সাথে দেখা হত- সকালে নাস্তার সময়। প্রথমে সালাম বিনিময়। খাটে বসা কোমর থেকে পা পর্যন্ত সাদা কাপড়ে ঢাকা। বললেন ‘এখানে আসা অনেকটা কষ্টকর, কিন্তু ফায়দা বেশী।’ তারপর দিন ছিরিকোটী রাহ্মাতুল্লাহি আলায়হি-এর ওরশ মোবারক। দরবারের আদব, সিস্টেম, ও শৃঙ্খলা, সময়নিষ্ঠা দেখে আপ্লুত হলাম। ওরশের দিন কোথায় গরু-ছাগল জবাই হয়েছে, কোথায় রান্না হচ্ছে ধোঁয়া পর্যন্ত দেখলাম না। খাওয়ার সময় হতেই দেখলাম পিল পিল করে মানুষ পাহাড় বেয়ে উঠে আসছে। নীচের খালি জায়গায় রশির চারপায়ায় চারজন বসে তবরুক খেয়ে নীরবে চলে যাচ্ছে। না আছে কোন হাঁক ডাক, চিল্লাচিল্লি। আমাদের এখানে তো এই অবস্থা নেই। দরবারে বেশী থাকা আমাদের কাছে সমীচিন মনে হয়নি। যেহেতু এখানে রান্না বান্নার জন্য কোন কাজের মেয়ে নেই। ঘরের মেয়েরাই রান্না-রান্না করেন। আর পরিবেশন করেন সাহেবজাদাগণ। কাঁধে রুটির ডালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমাদের লজ্জা করত। যাই হোক ৪ দিন পর হুজুর কেবলা থেকে বিদায় নিয়ে ছিরিকোটী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির মাজার জেয়ারত শেষ করে গাড়ীতে উঠলাম। পথে হযরত চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির মাজার জেয়ারত ও জোহরের নামাজ শেষে মাজার কর্তৃপক্ষের দেয়া আপ্যায়ন শেষ করে রাওয়ালপিন্ডি, লাহোরে হযরত দাতা গঞ্জেবখশ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র মাজার জেয়ারত, ড. ইকবালের কবর জিয়ারত ও দিল্লীতে হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া ও হযরত বখতিয়ার কাকী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র মাজার জেয়ারত শেষে কোলকাতা হয়ে দেশে ফিরে এলাম। কাজী সাহেবের সাথে দেখা হতেই বলল- তুই’ত হুজুরের সাথে দেখা করে আসলি- আমি ‘ত পরলাম না। কিভাবে তাকে প্রবোধ দিই। বললাম কপালে থাকলে তুইও পারবি।
২০০৪ সনে তাহের শাহ্ হুজুর কেবলা (ম.) এক চিঠির মাধ্যমে আমাকে জায়েমার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব প্রদান করেন। আমি তো প্রথমে বিশ্বাস করিনি। আমার থেকে বহু যোগ্য ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও। তখন আমি কাপ্তাই-এ গাউসিয়া কমিটির সদস্যদের সাংগঠনিক ট্রেনিং- কাজে নিয়োজিত। যেহেতু আমি বিশ্ব শিক্ষক সংগঠনের উদ্যোগে ও অর্থায়নে শ্রীলংকায় ট্রেনিং প্রাপ্ত। আনজুমান কর্তৃপক্ষের অনুরোধে অন্যান্য গাউসিয়া কমিটির নেতৃবৃন্দের সাথে আমাকে সেখানে যেতে হয়েছিল। ফিরতি পথে সেক্রেটারী জেনারেল মুহাম্মদ আনোয়ের হোসেন এর টেলিফোন। তোকে জামেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে না করিস না। রাত্রে বাসায় ফিরলে আমার স্ত্রী আমাকে বাসায় আনোয়ার সাহেবের টেলিফোনের খবরটি জানাল। দায়িত্ব নেয়ার পর সেক্রেটারী জেনারেল এর সার্বিক সহযোগিতা ও পরামর্শ আমি চিরদিন স্মরণ রাখব। তারপরদিন আনজুমান অফিসে গেলে সবার প্রিয় মরহুম রশীদুল হক খবরটি জানিয়ে আমাকে বললেন- যেন এ দায়িত্ব সানন্দে গ্রহণ করি। যাই হোক দু’দিন পর জামেয়ায় গেলাম- দেখি হৈ. চৈ. আর মাদ্রাসার দরজা-জানালা ভাঙচুর চালাচ্ছে একদল যুবক। নীচে আনজুমানের শাখা অফিসে গিয়ে দেখি লোকমান মুহাম্মদ ইব্রাহীম সাহেব বসা। বললাম চলুন প্রিন্সিপাল অফিসে যাই। তিনি বললেন দেখছেন না মাদ্রাসা ভাংচুর চলছে। বললাম কলেজে থাকতে ঘেরাও-এর অভিজ্ঞতা আমার আছে- চলুন যাই। তাঁকে সহ যাওয়ার সময় দেখলাম দরজা জানালা ভাংচুর এর নমুনা। জিজ্ঞাসা করলাম এরা কারা? উত্তর এল মাদ্রাসার কিছু উশৃঙ্খল ছাত্র ও বাইরের কিছু ছাত্র মিলে এ কান্ড ঘটিয়েছে।
ভিতরে ঢুকে দেখলাম কিছু সংখ্যক উশৃঙ্খল ছাত্র অধ্যক্ষের সাথে বাক বিতন্ডায় লিপ্ত। এইভাবে প্রায় দুই ঘন্টা বসে সব শুনছিলাম। তার পর তারা চলে গেল। পরে এদেরকে নিয়ে কোর্ট কাচারি হয়েছিল। আর এটাই আমার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা।
আমার নিয়োগ নিয়ে কাজী সাহেবের একটু মর্মবেদনা ছিল। একদিন আমাকে বলেই ফেল্ল। তোকে আমি হাত ধরে তৈয়ব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির হাতে বায়াত করালাম- আর নেয়ামত তুই পেয়ে গেলি। কিছুই বললাম না। এদিকে রাউজান দারুল ইসলাম কামিল মাদ্রাসায় সভাপতি-এর পদ খালি। আমরা চেয়েছিলাম কাজী সমশুকে পদটি দিতে। কিছুটা প্রতিরোধ আসল বিভিন্ন মহল থেকে। অনেক কষ্টে আনজুমান নেতৃবৃন্দের সহায়তায় তাকে উক্ত মাদ্রাসার জি.বি.-র সভাপতি পদে সমাসীন করা হল। কাজী সমশু আমৃত্যু এর উন্নয়নের জন্য পরিশ্রম করে গেছেন। তার দাফনের দিন মাঠ সহ বহুতল বিশিষ্ট একাডেমিক ভবন দেখে আপ্লুত হয়েছি। জানাযা ও মাগরিবের ক্ষণিক আগে তাকে তার পিতা হুজুরের মুরীদ মরহুম কাজী আবদুল গণির পাশে সমাহিত করা হয়। আমার সাথে উপস্থিত ছিল চট্টগ্রাম জেলার কলেজ শিক্ষক সমিতির বর্তমান নেতৃবৃন্দ। এক সময় আমি যখন প্রথমে সম্পাদক ও পরে চট্টগ্রাম কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি সেই সময়ে কাজী সমশু সমিতির একজন কর্মকর্তা, পরে সরকারী কমার্স কলেজ প্রাক্তন ছাত্র সমিতির সদস্যের পদ অলংকৃত করে। এছাড়া সে আনজুমানের প্রেস এণ্ড পাবলিকেশন সেক্রেটারী পদে থেকে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।
প্রসঙ্গত আমি যখন সঙ্গত কারণে স্বেচ্ছায় জামেয়ার চেয়ারম্যানের পদ হতে পদত্যাগ করি। পদত্যাগ পত্র পাওয়ার সাথে সাথে সেক্রেটারী জেনারেল আমাকে ফোন করে পদত্যাগ পত্র পরিহার করার জন্য বারবার জোর তাগিদ দেন। যতরকমের আবদার, অনুরোধ এবং বন্ধু হিসেবে নির্দেশও প্রদান করেন। তাছাড়া কাজী সামশুর রহমান সেক্রেটারীর সাহেবের সুরে আমাকে পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ করে। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। কি কারণে আমি পদত্যাগ করেছি তা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উপলক্ষে হুজুর কেবলা তাহের শাহ্ (ম.) হুজুর কেবলা ছাবের শাহ্ (ম.) ও সাহেবজাদা কাসেম শাহ্ (ম.) বাংলাদেশে অবস্থানকালে- হুজুর কেবলা ছাবের শাহ্ (ম.) সাথে একান্ত বৈঠকে সম্যক সবকিছু মুখে ও লিখিত আকারে বিনীতভাবে অবহিত করি। এরপর তিনি ১৬ অক্টোবর ২০২২ আনজুমান কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় আমাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন। এরপর ২১শে অক্টোবর জামেয়ার জুলুস মাঠে অগণিত পীর ভাইদের উপস্থিতিতে বাদ এশা নামাজের পর হযরত তাহের শাহ্ (ম.) হযরত ছাবের শাহ্ (ম.) ও সাহেবজাদা কাসেম শাহ্ (ম.) এর উপস্থিতিতে আমাকে একটি ক্রেস্ট ও একটি সার্টিফিকেট দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মানিত করেন। যা কিছু জামেয়ার জন্য করেছি তা অতি নগন্য। আরও কিছু করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু পারিনি। এরিমধ্যে খবর পাই বন্ধু কাজী সমশু অসুস্থ অবস্থায় C.S.C.R হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। হাসপাতালে তাকে দেখতে যাই। মাইল্ড হার্ট এটাক্ ও অন্যান্য উপসর্গ। আমি তখন ওখানে উপস্থিত বড় মেয়েকে বলি- যদি সম্ভব হয় বাবাকে ঢাকা নিয়ে যাও। এরপর আমার স্ত্রীকে নিয়ে পর পর আরও দু’বার তার বাসভবনে যাই। ইতিমধ্যে তাকে ভারতের চেন্নাই নেয়া হয়েছে। হাসপাতালে ৪ নভেম্বর ভোর ৬.৩০ মিনিট কাজী সমশু ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি. …..)। আমি তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ্ তা‘আলা তার সকল খেদমতের বিনিময়ে তাকে বেহেশত্ নসীব করুন। আমিন।

লেখক: জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসার প্রাক্তন চেয়ারম্যান।

Share:

Leave Your Comment