ফজরের নামাযের ফযীলত ও মাসায়েল
অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি
وَعَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَعَا قَبُوْنَ فِيْكُمْ مَلَائِكَةٌ بِاللَّيْلِ وَمَلَائِكَة بِالنَّهَارِ وَيَجْتَمِعُوْنَ فِىْ صَلوةِ الْفَجْرِ وَصَلةِ الْعَصْرِ ثُمَّ يَخْرُجُ اللَّذِيْنَ بَاتُؤْا فِيْكُمْ يسئالُهُمْ رَبُّهُمْ وَهُوْ اَعْلَمُ بِهِمْ كَيْفَ تَرَكْتُمْ عِبَادِىْ فَيَقُوْلُوْنَ تَرَكْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّوْنَ وَاَتَيْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّوْنَ -(متفق عليه)
অনুবাদ: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে রাত ও দিনের ফিরিস্তাগণ পালাক্রমে আসে এবং ফজর ও আসরের নামাযে একত্রিত হয়। তারপর যারা তোমাদের মধ্যে রাত অতিবাহিত করে তারা উর্ধ্বলোকে চলে যায়। তাদের প্রভু তাদের জিজ্ঞেস করেন অথচ তিনি তাদের চেয়ে অধিক জানেন। তোমরা আমার বান্দাদেরকে কোন্ অবস্থায় রেখে এসেছো? তারা বলেন, আমরা তাদেরকে নামাযরত অবস্থায় রেখে এসেছি। আর যখন তাদের নিকট পৌঁছেছি তখনও তারা নামাযরত। [বুখারী, মুসলিম শরীফ]
প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীসে ফজর ও আসরের নামাযের গুরুত্ব উপস্থাপিত হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ করেছেন। ঈমানের পর প্রথম ফরজ কাজ হলো নামায। ইসলামের পঞ্চবুনিয়াদের অন্যতম স্তম্ভ হলো নামায। আল্লাহ্র সাথে বান্দার নিবিড় সম্পর্ক সৃষ্টির উৎকৃষ্ট মাধ্যম হলো নামায। মু’মিন ও কাফিরদের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী ইবাদতের নাম নামায। আল্লাহ্র সমীপে বান্দার চুড়ান্তরূপে আত্মসমপর্ণের পন্থা হলো নামায। পরিশুদ্ধ জীবন গঠনে নামাযের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
আল্লাহ্ তা‘আলার নির্দেশ পলনার্থে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর আনুগত্য ও দাসত্ব স্বীকার করে দৈনিক পাঁচবার তাঁর দরবারে হাজিরা দিতে হয়। বান্দা দিনের কর্মকাণ্ড শুরু করার পূর্বেই ফজরের নামাযের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্র দরবারে হাজিরা দিতে হয়। মুমীনের সামনে আনুগত্য ও দাসত্ব স্বীকার করার নামই ইবাদত। পবিত্র ক্বোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে ফজরের নামাযের নির্দেশ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে- وَأَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ طَرَفَىِ ٱلنَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ ٱلَّيْلِ-
অর্থ: তোমরা সালাত কায়েম করো দিবসের দুপ্রান্ত ভাগে এবং রজনীর প্রথমাংশে। [সূরা হুদ, পারা-১২, আয়াত১১৪]
আয়াতে বর্ণিত দিনের দুই প্রান্তভাগের প্রথম ভাগে ফজরের নামায দ্বিতীয় প্রান্তভাগ জোহর ও আসরের নামায এবং রাত্রির প্রথমাংশে মাগরীব ও এশার নামাযের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। [ফয়জুলবারী, ২য় খণ্ড, বাদাইউস সানায়ে, খণ্ড-১ম]
ফজরের নামাযের ফযীলত সংক্রান্ত অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এরশাদ হয়েছে-
عَنْ عُمَارَة بْنِ رُويبَةَ قَالَ سَمِعْتُ سُوْلُ اللهِ صَلى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ لَنْ يَلِجُ النَارَ احدٌ صَلَّى قَبْلَ طُلُوْعِ الشَمْسِ وَقَبْلَ غُرُوْبِهَا بَعْضِ الْفَجْرَ وَالْعَصْرَ- (رواه مسلم)
হযরত ওমর ইবনে রুয়াইবাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে এরশাদ করতে শুনেছি, যে ব্যক্তি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে অর্থাৎ ফজর ও আসরের সালাত আদায় করে সে কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। [মুসলিম মরীফ: হাদীস নম্বর ১৩০৯]
আলো বিকশিত অবস্থায় ফজর নামায পড়া
عَنْ رَافِعْ بْنِ خَدِيج اَنَّ النَّبِى صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وسلم قَالَ اِصْبَحُوْا بِاالصُّبْحِ فَانَّهُ اَعْظَمُ للْاجْرِ- (رواه بن ماجه)
হযরত রাফে বিন খাদীজ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ফজরের নামায আলো বিকশিত অবস্থায় পড়ো। এতে অনেক বেশী সওয়াব রয়েছে।
[ইবনে মাজাহ্ শরীফ, হাদীস নম্বর-৩৭২]
যে ব্যক্তি ফজরের এক রাক‘আত পেল সে ফজর পেল।
وَعْن اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْاللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ اَدْرَكَ ركْعَةٌ مِنَ الصُّبْحِ قَبْلَ اَنْ تَطْلُحُ الشَمْسُ فَقَدْ اَدْرَكَ الصُّبْحِ وَمَنْ اَدْرَكَ رَكْعَة مِنَ العَصْرِ قَبْلَ اَنْ تَفْرُبَ الشَّمْسُ فَقَدْ اَدْرَكَ الْعَصْرَ- (متفق عليه)
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সূর্য উদিত হবার পূর্বক্ষণে এক রাক‘আত পেলো সে ফজর পেলো। আর ব্যক্তি সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বক্ষণে আসরের এক রাক‘আত পেলো সে আসর পেয়ে গেলো। [বুখারী, মুসলিম]
ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাতে মুআক্কাদাহর ফযীলত
উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাবীবাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
مَنْ صَلَّى فِىْ يَوْمِ وَلَيْلَةٍ اِثْنَتَىْ عَشْرَةَ رَكْعَة بَنى لَهُ بَيْتًا فِىْ الْجَنَّةِ اَرْبَعًا قَبْلَ الظُّهْرِ وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدِهَا- وَرَكَعْتَيْنِ بَعْدَ الْمَغْربِ وَرَكَعْتَيْنِ بَعْدَ الْعِشَاءِ وَرَكعتين قَبْلَ صَلوة الْفَجْرِ- (رواه الترمذى)
যে ব্যক্তি দিনে রাতে ফরজ ছাড়া বার রাক‘আত নামায পড়বে তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করা হবে। চার রাক‘আত জোহরের ফরজের পূর্বে ও দু’রাক‘আত পরে, দুই রাক‘আত মাগরীবের পর এবং দুই রাক‘আত ফজরের পূর্বে। [তিরমিযী শরীফ]
ফজরের ফরযের পূর্বে দু’রাক‘আত সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্
ফজরের ফরয নামাযের পূর্বে দু’রাক‘আত সুন্নাতে মুআক্কাদা, এ ব্যাপারে সর্বাধিক তাকীদ এসেছে। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা এরশাদ করেছেন-
رَكْعَتًا الْفَجْرِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا ومَا فِيْهَا-
অর্থ: ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত দুনিয়া ও দুনিয়াতে যা কিছু আছে এর চেয়ে উত্তম। [মুসলিম শরীফ]
স্ত্রীকে রাতে নামাযের জন্য জাগিয়ে দেয়ার ফযীলত
হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
رَحِمَ اللهُ رَجُلًا قَامَ مِنَ اللَّيْلِ فَصَلَّى وَاَيْقَظَ امْرأتُهُ فَصَلَّتْ فَاِنْ اَبَتْ نَضَحَ فِىْ وَجْهِهَا الماء- رَحِمَ اللهُ اِمْرَاة قَامَتْ مِنَ اللَّيْلِ فَصَلَّتْ وَاَيْقَظَتْ زَوْجَهَا فَصَلَّى فَاِنْ ابى نضجت فِىْ وَجْهِهِ الْمَاء- (رواه ابوداؤد)
অর্থ: আল্লাহ্ সে ব্যক্তির উপর রহমত করুন, যে রাতে জাগ্রত হয়ে নামায আদায় করে এবং আপন স্ত্রীকেও জাগিয়ে দেয়। আর সেও নামায পড়ে।। নিদ্রা হতে উঠতে অস্বীকার করলে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। এরূপে আল্লাহ্ রহমত করুন সে স্ত্রী লোকের উপর যে রাতে উঠে নামায পড়ে আর যদিও স্বামী উঠতে অস্বীকার করে তার মুখমন্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়। [আবূ দাউদ শরীফ]
ফজরের ওয়াক্ত শুরু
ফজরের নামাযের ওয়াক্ত শুরু হয় সুবহি সাদিক থেকে এর লক্ষণ হলো, পূর্বাকাশে উষার শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়া, সুবহে সাদিকের সময় হতে ফজরের সময় শুরু হয়। [ফতোয়ায়ে আলমগীরি, ১ম খণ্ড]
সূর্যোদয়ের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত ফজরের সময় অব্যাহত থাকে।
মাসআলা
নামাযের নিষিদ্ধ সময় ১. সূর্যোদয়ের সময়, ২. দিপ্রহর বা সূর্য ঠিক মাথার উপর স্থির থাকাবাস্থায়, ৩. সূর্যাস্তের সময়।
এ সময়ে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল, কাযা কোন ধরনের নামায জায়েয নেই।
ফজরের ফরয নামায আদায়ের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত যে কোন নফল পড়া মাকরূহ। ফজরের নামায এতোটুকু সময় বিলম্ব করা মাকরূহ যাতে সূর্যোদয়ের ব্যাপারে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। [ফতোয়ায়ে আলমগীরি]
মাসআলা
জামাত শুরুর পর সুন্নাত পড়া যাবে না, তবে ফজরের নামাযে ব্যতিক্রম; জামাত শুরু হওয়ার পর কোন প্রকার সুন্নাত পড়া জায়েয নেই। তবে ফজরের সুন্নাত আদায় শেষে জামাত পাওয়ার আশাবাদী হলে মসজিদের কোন অংশে সুন্নাত আদায় শেষে জামাতে শামিল হবে।
[ফাতওয়া-এ রজভীয়া: খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৬১৪]
ফজরের সুন্নাত পড়তে গেলে জামাত শেষ হয়ে যাওয়ার ধারণা হলে তখন সুন্নাত না পড়ে জামাতে শামিল হয়ে যাবে। কারণ সুন্নতের জন্য জামাত পরিহার করা গুনাহের কাজ। [আলমগীরি, ফাতওয়া-এ রজভীয়াহ, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩৭০]
ফজরের বাদ পড়া সুন্নাত ফরজের পর সূর্যোদয়ের পূর্বে পড়া জায়েয নেই। সূর্য একটু উপরে উঠার পর কাযা পড়বে। [ফাতওয়া-এ রজভীয়াহ, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪৬২]
ঘুমন্ত ব্যক্তিকে নামাযের জন্য জাগিয়ে দিতে হবে। ঘুমন্ত ব্যক্তি যিনি নামায আদায় করতে ভুলে গিয়েছে। তার সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তির দায়িত্ব হলো তাকে জাগিয়ে দেয়া। ভুলে যাওয়া ব্যক্তিকে নামাযের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় গুনাহগার হবে। [বাহারে শরীয়ত: ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭০১]
রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি নামায আদায় করতে ভুলে যায় বা নামাযের সময় ঘুমিয়ে যায় স্মরণ হওয়া মাত্রই নামায পড়ে নিবে। কেননা ঐ সময়ই হলো তার জন্য নামাযের সময়। [মুসলিম শরীফ: হাদীস নম্বর-৬৮৪]
ফজরের নামাযের মুস্তাহাব ওয়াক্ত
ফজরের নামায আকাশ উজ্জ্বল হলে পড়া মুস্তাহাব, তবে এমন ওয়াক্তে হওয়া মুস্তাহাব যেন চল্লিশ থেকে ষাট পর্যন্ত পড়া যায়। অতঃপর সালাম ফিরানোর পর এতটুকু সময় থাকা বাঞ্চনীয়। যেটুকু সময়ে কোন কারণে নামায ভঙ্গ হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার চল্লিশ থেকে ষাট রাক‘আত পর্যন্ত পড়তে পারে। ততোটুকু দেরী করা মাকরূহ্ যেন সূর্য উদয় হওয়ার সন্দেহ না হয়। [বাহারে শরীয়ত: ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩০]
ফজর ও আসরের সময় ফিরিশতাদের দায়িত্ব পরিবর্তিত হয়
আল্লাহ্র পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিরিশতারা বান্দার আমল নামা লিখার কাজে নিয়োজিত আছেন। যারা ফজরের ওয়াক্তে আসেন তারা আসরের ওয়াক্তে চলে যান। আর যারা আসরের ওয়াক্তে আসেন, তারা পরদিন ফজরের ওয়াক্তে চলে যান। আল্লাহ্ তা‘আলা উভয় দলের ফিরিশতাদের জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা আমার বান্দাদের কোন অবস্থায় দেখলে? উভয় দল জবাব দেন, আমরা যখন তাদের নিকট পৌঁছি তখন তারা সালাতরত অবস্থায় ছিল। আবার যখন ফিরে আসছি তখনও তারা সালাত আদায় করা অবস্থায় ছিল। [বুখারী শরীফ: হাদীস নম্বর-৫৫৫]
আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে সঠিক নিয়মে নামায আদায় করার তাওফিক দান করুন- আ-মী-ন।