সময় আল্লাহর আমানত ইসলামে সময়ের গুরুত্ব
অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি
عَنْ مُعَاذِ بْنُ جَبَلٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَنْ تَزُوْلُ قَدَمَا عَبْدِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ حَتّى يسألَ عَنْ اَرْبَع خصالٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيْمَا اَفْنَاهُ ـ عَنْ شَبَابِه فِيْمَا اَبْلاَهُ ـ وَعَنْ مَالِه مِنْ اَيْنَ اَكْتَسَبَهُ وفِيْمَا اَنْفَقَهُ وَعِلْمَهُ مَاذَا عَمِلَ بِه ـ
عَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نِعْمَتَانِ مَغْبُوْنٌ فِيْهِمَا كَثِيْرٌ مِنَ النَّاسِ الصِّحَةُ وَالْفِرَاغُ [رواه البخارى وابن ماجه]
অনুবাদ: হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কিয়ামত দিবসে চারটি বিষয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার পূর্বে কোনো বান্দা এক কদম সামনে অগ্রসর হতে পারবেনা, তার জীবন কোন কাজে অতিবাহিত করেছে, তার যৌবন সে কিসে ক্ষয় করেছে, তার ধন সম্পদ কোন পথে আয় করেছে এবং কোন খাতে ব্যয় করেছে, তার ইলম অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে। [আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব, পৃ. ৪/২৯৮]
হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহর দু’টি নিয়ামত, যে বিষয়ে অধিকাংশ মানুষ ধোঁকায় পতিত হয়, একটি হলো সুস্থতা অপরটি হলো অবসর সময়। [সহীহ্ বুখারী শরীফ, হাদীস-৪৯৩৩]
প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত প্রথম হাদীসে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অন্যতম নিয়ামত সময়ের গুরুত্ব এবং আল্লাহর নিকট সময়ের ব্যবহার প্রসঙ্গে আল্লাহর দরবারে বান্দার জবাবদিহিতা সম্পর্কে আলোকপাত হয়েছে। দ্বিতীয় হাদীস শরীফে সময়ের অপচয় ও অপব্যবহার এর পরিণতি সম্পর্কে উপস্থাপিত হয়েছে। মহান আল্লাহ্ মানবজাতিকে তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গঠনের জন্য অমূল্য সম্পদ ও পবিত্র আমানত হিসেবে সময় দান করেছেন, বাল্যকাল, যৌবনকাল ও বৃদ্ধকাল জীবনের সবটুকু সময়ের সদ্ব্যবহার করার নির্দেশনা রয়েছে, মহাগ্রন্থ আলকুরআন ও মহানবীর আল হাদীসে।
প্রখ্যাত তাফসীরকার হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বর্ণনামতে সময়ের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে সময়ের শপথ করেছেন। আল্লাহর কিতাবে ‘আল আসর’ দ্বারা সময়কাল বুঝানো হয়েছে। সময় বলতে কি বুঝি, সংক্ষেপে সময় বলতে মূর্হুত, ক্ষণ, সেকে-, মিনিট, ঘন্টা, দিন, রাত, সপ্তাহ্, পক্ষ, মাস, বছর, যুগ শতাব্দী বুঝায়। সময়ই জীবন, জীবনের অপর নাম সময়। জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়া অর্থ প্রতিটি মুহূর্ত ও সময় সম্পর্কে বান্দা আল্লাহর মাধ্যমে জিজ্ঞাসিত হবেন।
উল্লেখ্য যে, পার্থিব জগতের সবকিছু সুখ শান্তি সুস্থতা, অসুস্থতা, সচ্ছলতা, অসচ্ছলতা, ভালো-মন্দ ন্যায়-অন্যায় সময়ের মাঝেই আবর্তিত ও পরিবেষ্টিত। মনীষীরা বলেছেন, সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। জীবনে অনেক কিছু ফিরে আসে, ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু সময়কে ফিরিয়ে আনা যায় না। সময়ের শুরু আছে শেষ আছে। আমাদের জীবনের সময় সীমিত। আমাদের ইহকালীন সময় কখন শেষ হবে কারো জানা নেই। আল্লাহ্ আমাদের মৃত্যুর সময় নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। প্রত্যেককে মরতে হবে। كل نفس ذائقة الموت প্রত্যেক আত্মা মরণশীল। [সূরা আনকাবুত: আয়াত-৫৭]
আমাদের সময় ক্ষণস্থায়ী
কার জীবনের কতটুকু সময় বরাদ্দ কারো জানা নেই। জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উত্তম ও মহৎ কাজে সদ্ব্যবহার করতে পারলেই জীবনটা হবে সফল ও স্বার্থক। সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত যথাযথ কাজে লাগানোর নামই সময়ের সদ্ব্যবহার।
সুস্থতা ও অবসরতা বিষয়ক হাদীসের বাস্তব শিক্ষা
বাস্তবে দেখা যায় অনেক মানুষ শারীরিকভাবে সুস্থ। সুস্থতার সময় সানন্দে প্রতিটি ভালকাজ করার সুযোগ হাতে রয়েছে, কিন্তু মানুষ জানে না যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে বিভিন্ন জটিল কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে ইবাদত-বন্দেগী নামায রোজা হজ্ব ও যাবতীয় নেক আমল করা তার জন্য কঠিন ও কষ্টকর হয়ে পড়বে অথচ সুস্থ অবস্থায় মানুষ অবহেলা উদাসীনতায় সময় কাটিয়ে দেয়। ভালোকাজে মনোযোগী হয় না। এভাবে অবসর সময়ে অনেক নেক আমল করার সুযোগ রয়েছে অথচ হেলা ফেলায় অলসতায় সময় অপচয় করে অবসর সময় অতিবাহিত করে অথচ একথা চিন্তা করে না ভবিষ্যতে অবসর সময় নাও আসতে পারে, সময়ের সদ্ব্যবহার না করে ধোঁকায় পতিত হয়, সময়ের মতো অমূল্য নিয়ামতকে সঠিক ব্যবহার ও মূল্যায়ন করতে পারলে জীবন মূল্যবান হয়।
জীবন তো সময়ের সমষ্টি
প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন- يَا اِبْنَ ادم اِنَّمَا اَنْتَ اَيَّامٌ فَاِذَا ذَهَبَ يَوْمٌ ذَهَبَ بَعْضُكَ ـ [كتاب الزهد]
হে আদম সন্তান! তুমি তো কতেক দিনের সমষ্টি। সুতরাং যখন একটি দিন অতিবাহিত হলো, তখন তোমার জীবনের একাংশ হারিয়ে গেল। [কিতাবুয্ যুহুদ, পৃ. ৩৯৭]
হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সময়ের গুরুত্ব প্রসঙ্গে আরো বর্ণনা করেন- اَمْس اجلٌ وَالْيَوْمُ عَمَلٌ وَغَدًا اَمَلٌ
অর্থ: গতকাল তো অতিবাহিত হয়ে গেলো। আজ হলো কাজের দিন, আগামীকাল তো আশামাত্র। আগামীকাল কী ঘটবে সে সম্পর্কে কারো জ্ঞান নেই।
وَمَا تَدْرِىْ نَفْسٌ مَا ذَا تَكْسِبْ غدًا
কেউ জানেনা আগামীকাল সে কী অর্জন করবে। [সূরা: লোকমান, আয়াত-৩৪]
প্রতিটি মুহূর্ত সুষ্ঠু পরিকল্পনা ভিত্তিক সঠিকরূপে ব্যবহার করার জন্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম চমৎকার উপদেশবাণী উপস্থাপন করে আমাদের কৃতাতর্থ করেছেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
مَا مِنْ يَوْمٍ فَجْرَهُ اِلاَّ يُنَادِىْ يَا اِبْنُ ادمُ اَنَا خَلْقٌ جَدِيْدٌ وَعَلَى عَمَلِكَ شَهِيْدٌ فَتَزوَّدْ مِنِّىْ فَاِنِّىْ لاَ اَعُوْدُ اِلى يَوْمِ الْقِيَامَةِ [قيمة الزمن عند العلماء]
অর্থ: প্রতিদিন প্রত্যূষে দু’জন ফিরিস্তা ডাক দিয়ে বলে হে আদম সন্তান, আমি একটি নতুন দিন, তোমার কর্মের আমি সাক্ষী, তাই আমাকে কাজে লাগাও। আমার থেকে উপকৃত হও। কিয়ামত পর্যন্ত আমি আর ফিরে আসবোনা।
[কিমাতুজ্ জমন ইন্দাল উলাা, কৃত. শায়খ আবদুল ফাত্তাহ্, আবু গুদ্দাহ্ রহ.]
পাঁচটি বিষয়কে মূল্যমান করুন, সময় অমূল্য সম্পদ
পাঁচটি বিষয়কে গণীমত মনে করুন, সময়ের কাজ সময়ে করুন। অবস্থা পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে, যে কোন মুহূর্তে জীবন বাতি নিভে যেতে পারে। বেঁচে থাকার গ্যারান্টি নেই। সময়কে গুরুত্ব দিন, কদর করুন, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عَنْ عُمْر بْنِ مَيْمُوْنَ الْاَوْدِىْ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِرَجُلٍ وَهُوَ يَعِظُهُ ـ اِغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ شَبَابَكَ قَبْلَ هَرْمِكَ ـ وَصِحَّتِكَ قَبْلَ سَقَمِكَ ـ وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ ـ وَفِرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ ـ وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ [كنز العمال]
অর্থ: হযরত আমর ইবনে মায়মুন আল আওদী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলূল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয়ের আগে গণীমত মনে কর। বৃদ্ধ হওয়ার আগে যৌবনকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দরিদ্র হওয়ার আগে সচ্ছলতাকে, কর্মব্যস্ত হওয়ার আগে অবসর সময়কে, মৃত্যুর আগে জীবনকে। [কানযুল উম্মাল, খন্ড-১৫, হাদীস নং-৪৩৪৯]
সময়ের সঠিক ব্যবহারে রুটিন মেনটেইন করুন
একজন আদর্শ মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো দৈনিক চব্বিশ ঘন্টা সময়ের কর্ম পরিকল্পনা ও রুটিন অনুযায়ী সময় ব্যয় করা। কোন কাজ কোন সময়ে কতটুকু সময় নিয়ে করবেন রুটিন করুন। প্রাত্যহিক জরুরী কাজ, যেমন গোসলের প্রস্তুতি, নামাযের সময়, তিলাওয়াতের সময়, সকালের নাস্তার সময়, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, ভার্সিটি গমনের সময়সূচি অনুসরণ করুন।
পেশাজীবী, চাকুরীজীবীদের দৈনিক সময়সূচি, অফিসিয়াল সময়সূচি, বিশ্রামের সময়, পিতা, মাতা, ছেলে-সন্তান ও পরিবারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে সময় দিন, ব্যবসা বাণিজ্য, চাকুরি, পড়ালেখা, সমাজসেবা, মানবসেবা ইত্যাদি মহৎ কর্মে জীবনের কিছু মূল্যবান সময় ব্যয় করুন। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির ও পেশার মানুষকে ইসলামের সঠিক পথে আহ্বান করুন। এ পথে ‘দাওয়াতুল খায়র’ কল্যাণের পথে দ্বীনের দাওয়াতী কর্মসূচি পালনে সাপ্তাহিক, দৈনিক কিছু সময় বের করুন। এভাবে নিজের কর্তব্য, ¯্রষ্টার প্রতি কতর্ব্য ও সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য পালনে, প্রতিদিনকার চব্বিশ ঘন্টার সময়কে পরিকল্পিত উপায়ে সদ্ব্যবহার করলে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে ইহকাল ও পরকালে সাফল্য আসবে। সময়ের কাজ সময়ে করতে অভ্যস্থ হোন, সময়ের কাজ অসময়ে করার প্রবণতা পরিহার করুন, কল্যাণ কাজে সময় ব্যয়ে সচেষ্ট হোন ক্ষতিকর ও গুনাহর কাজে সময় ব্যয় থেকে বিরত থাকুন। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে সময়ের গুরুত্ব অনুধাবন ও সদ্ব্যবহার করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: অধ্যক্ষ, মাদ্রাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম।