জশনে ঈদ-এ মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -অধ্যক্ষ আল্লামা মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আলক্বাদেরী
জশনে ঈদ-এ মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
অধ্যক্ষ আল্লামা মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আলক্বাদেরী
সাবেক অধ্যক্ষ, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, চট্টগ্রাম।
===========
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের দিন কেবল ঈমানদারদের জন্য নয় বরং সৃষ্টি জগতের সকলের জন্য আনন্দের ও রহমতের দিন। এজন্য সারা বিশ্বের মু’মিনগণ অত্যন্ত ভক্তি ও মর্যাদার সাথে রবিউল আউয়াল মাসে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করে থাকেন। এটি শরীয়তসম্মত পুণ্যময় আমল, যা কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা সু-প্রমাণিত।
১. ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিচিতি
ক. ঈদে মিলাদুন্নবী’র পরিচয়
‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ শব্দটি যৌগিক শব্দ, যা তিনটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। এক. ঈদ, দুই. মিলাদ, তিন. নবী।
প্রথমত ঈদ শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ উৎসব, আনন্দ, খুশি। বিশ্ববিখ্যাত অভিধান প্রণেতা ইবনু মনযুর বলেন- العيد كل يوم فيه جمع অর্থ- ‘সমবেত হবার প্রত্যেক দিনকে ঈদ’ বলা হয়।১
মুফতি আমীমূল ইহসান আলাইহির রাহমাহ বলেন- العيد كل يوم فيه جمع او تذكار لذي فضل অর্থ ‘কোন মার্যাদাবান ব্যক্তিকে স্মরণের দিন বা সমবেত হবার দিনকে ঈদের দিন বলা হয়।’২
দ্বিতীয়ত মিলাদ শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ: জন্মকাল, জন্মদিন। অর্থে মাওলিদ (مولد) শব্দের ব্যবহার আরবি ভাষায় অত্যধিক।
তৃতীয়ত নবী। এখানে নবী বলতে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। কারণ, মুসলিম জাতি ও পুরো সৃষ্টিজগত তাঁর আগমনের শোকরিয়া আদায় করে। সুতরাং ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ অর্থ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র আগমনের আনন্দ।
খ. ‘মিলাদুন্নবী’ শব্দের প্রচলন
‘মিলাদুন্নবী’ শব্দের মধ্যে ‘মিলাদ’ শব্দটি কারো জন্ম বা জন্মকাল বুঝানোর জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। এ অর্থে শব্দটির ব্যবহার রয়েছে হাদিস শরীফে, অভিধান গ্রন্থে, ইতিহাস গ্রন্থে; এমনকি অনেক কিতাবের নামেও। এটি নতুন কোন শব্দ নয়। এর কয়েকটি ব্যবহার নি¤েœ উল্লেখ করা হল।
১. অভিধান গ্রন্থ
আল্লামা ইবনু মনযুর তাঁর সুপ্রসিদ্ধ আরবি অভিধান ‘লিসানুল আরব’ এ লিখেছেন ميلاد الرجل: اسم الوقت الذي ولد فيه
অর্থ- ‘লোকটির মিলাদ, যে সময়ে সে জন্ম গ্রহণ করেছে সে সময়ের নাম।৩
২. হাদিসগ্রন্থ
ইমাম তিরমিযী আলাইহির রাহমাহ তাঁর ‘আল জামেউস সহীহ’ গ্রন্থের একটি শিরোনাম দিয়েছেন باب ما جاء في ميلاد النبي অর্থ- ‘নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র জন্ম সম্পর্কে বর্ণিত বিষয়ের অধ্যায়।’৪
হযরত উসমান বিন আফ্ফান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বনী ইয়ামর বিন লাইসের ভাই কুরাছ বিন উশাইমকে জিজ্ঞেস করলেন اأنت اكبر ام رسول الله صلي الله عليه وسلم فقال : رسول الله اكبر مني وانا اقدم منه في الميلاد
অর্থ- ‘আপনি বড়, নাকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম? তিনি বললেন-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা আমার চেয়ে বড়। আর আমি জন্মের মধ্যে তাঁর চেয়ে অগ্রজ।’৫
৩. ইতিহাস ও সীরাত গ্রন্থ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা মদিনা হিজরতকালে ‘সাওর’ গুহায় আশ্রয় নেন। এদিকে কুরাইশরা তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে ‘সাওর’ গুহার মুখে পৌছলে তাদের একজন বলল ان عليه العنكبوت قبل ميلاد النبي صلي الله عليه وسلم فانصرفوا অর্থ : ‘হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা এর জন্মের পূর্ব থেকে এ গুহামুখে মাকড়শার জাল রয়েছে। অতঃপর তারা চলে গেল।’৬
ইবনু আউন (রহ.) বলেন
قتل عمار وهو ابن احدي وتسعين سنة وكان اقدم في الميلاد من رسول الله صلي الله عليه وسلم
অর্থ-‘হযরত আম্মাার বিন ইয়াসির রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ৯১ বছর বয়সে শহীদ হন। তিনি জন্মের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র অগ্রজ ছিলেন।’৭
হযরত ইবনু আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-
وكان بين ميلاد عيسي والنبي عليه الصلاة والسلام خمس مأة سنة وتسع وستون سنة
অর্থ: আর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা এবং হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের মাঝখানে ৫৬৯ বছর ব্যবধান ছিল।’৮
আল্লামা ইবনু হাজর আসকালানী আলাইহির রাহমাহ বলেন فانه ولد بعد ميلاد النبي صلي الله عليه وسلم بمدة
অর্থ- ‘তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র জন্মের কিছুকাল পরে জন্মগ্রহণ করেছেন।৯
উপরিউক্ত উদ্ধৃতি থেকে বুঝা গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র জন্ম বুঝানোর জন্য ‘মিলাদুন্নবী’ শব্দটির ব্যবহার সাহাবায়ে কিরামের যুগ থেকে অদ্যবধি রয়েছে। এটি এ যুগের নবসৃষ্ট কোন শব্দ নয়। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করে যে, ‘মিলাদুন্নবী’ একটি ইদানিং সময়ের শব্দ। তাদের এ মন্তব্য আদৌ সঠিক নয়। আবার কেউ কেউ ‘মিলাদ’ শব্দের অর্থ ‘জন্ম’ না নিয়ে অন্য অর্থ নেয়ার চেষ্টা করে, যা কোন অভিধান প্রণেতা উল্লেখ করেননি।
গ. ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ পরিচয়
‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা বলতে এ ধরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র আগমনে আনন্দিত হওয়া এবং এ অদ্বিতীয় নিয়ামত পাবার কারণে সৎকাজ ও ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করা।
ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন কুরআন মাজীদের আলোকে
১. নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপনের নির্দেশ : মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে তাঁর দেয়া নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপন করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন-فاذكروني اذكركم واشكروالي ولا تكفرون
অর্থ-‘সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করবে। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, অকৃতজ্ঞ হয়ো না।১০
তাই, আল্লাহর নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপন করা প্রত্যেক মানুষের ওপর কর্তব্য। শোকরিয়া জ্ঞাপনের বিভিন্ন ধরণ রয়েছে, যা মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন।
নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপনের পদ্ধতি
নিয়ামতের স্মরণ
নিয়ামতের স্মরণ করাও শোকরিয়া জ্ঞাপনের একটি মাধ্যম। নিয়ামতের স্মরণ করার মাধ্যমে আল্লাহর নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপন করা যায়। তাই মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন يابني اسرائيل اذكروا نعمتي التي انعمت عليكم ‘হে বনী ইসরাঈল! আমার সেই অনুগ্রহকে স্মরণ কর যদ্দারা আমি তোমাদেরকে অনুগৃহিত করেছিলাম’১১
তিনি অন্যত্র ইরশাদ করেছেন واذكروانعمة الله عليكم অর্থ- তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ কর।’১২
নিয়ামতের বর্ণনা দেয়া: নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপনের আরেকটি মাধ্যম হল নিয়ামতের বর্ণনা দেয়া, অপরকে জানানো ইত্যাদি।১৩
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন واما بنعمة ربك فحدث অর্থ-‘তুমি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহের কথা জানিয়ে দাও।’১৪
এ আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন মানুষদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন তারা তাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহের কথা বর্ণনা করে।
নিয়ামত চেনা
নিয়ামতকে নিয়ামত হিসেবে চেনাও শোকরিয়া জ্ঞাপনের একটি মাধ্যম। প্রত্যেক নিয়ামত হল আল্লাহু প্রদত্ত। আর এ নিয়ামতের মর্যাদাও চিনতে হবে এবং তদানুযায়ী শোকরিয়া জ্ঞাপন করতে হবে।
ইবাদত বন্দেগী
আল্লাহর নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল ইবাদত-বন্দেগী। নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ছাড়াও অন্যান্য নফল ইবাদত যেমন দান-খয়রাত, অনাথ-গরীবদের খাওয়ানো ইত্যাদি শোকরিয়া জ্ঞাপনের উত্তম মাধ্যম। ফরজ ইবাদত পালনের মাধ্যমে দায়মুক্তি পাওয়া যায়; কিন্তু অধিকতর কৃতজ্ঞ হবার জন্য নফল ইবাদতের বিকল্প নেই।
ঈদ উদযাপন করা
আল্লাহর নিয়ামত পাবার দিনকে ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমেও নিয়ামতের শোকরিয়া করা যায়। যেমন- হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম বলেছিলেন ربنا انزل علينا مائدة من السماءتكون لنا عيدا لاولنا واخرنا واية منك অর্থ- হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য আসমান হতে খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করুন; এটি আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্য হবে ঈদ স্বরূপ এবং আপনার নিকট হতে নিদর্শন।’১৫
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ তায়ালার নিকট ফরিয়াদ করেছিলেন, যেন তিনি তাদের জন্য আসমান হতে খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা অবতীর্ণ করেন। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম বলেছেন যে, খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা অবতীর্ণ হলে তারা সে দিনকে ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করবেন। মহান রাব্বুল আলামীন তাদের ওপর সেই নিয়ামত রবিবারে অবতীর্ণ করেছিলেন বিধায়, তারা আজও রবিবারকে ঈদের দিন হিসেবে মেনে থাকে এবং এদিনকে তার ছুটির দিন হিসেবে পালন করে।
কুরআন মাজীদের এ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, নিয়ামত পাবার দিনকে ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার স্বীকৃতি রয়েছে; কারণ তিনি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ঈদ উদযাপনের স্বাকৃতি দিয়ে তাঁর উক্তি পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন এবং কোন প্রকার নিষেধ করেননি। এটি অবৈধ হলে তিনি অবশ্যই তা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করতেন।
খ্রিস্টানদের ওপর খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা রবিবারে অবতীর্ণ হবার কারণে সেদিনকে যদি ঈদের দিন হিসেবে উদযাপন করা যায়, তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা আগমনের দিনকে কেন ঈদের দিন হিসেবে মানা যাবে না? অথচ তিনিই হলেন সবচেয়ে বড় নিয়ামত। সুতরাং ছোট নিয়ামতের শোকরিয়া স্বরূপ সেই নিয়ামত পাবার দিনকে ঈদের দিন হিসেবে উদযাপন করা বৈধ হলে, নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় নিয়ামত পাবার দিনকে ঈদের দিন হিসেবে মানা ও উদযাপন করা বৈধ।
খুশি উদযাপন করা
আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপনের একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হল- নিয়ামতের ওপর খুশি উদযাপন করা। তাই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন قل بفضل الله وبرحمته فبذالك فليفرحوا هو خير مما يجمعون অর্থ- ‘(হে রাসুল!) আপনি বলুন, (সবকিছু) আল্লাহর দয়া ও মেহেরবাণীতে। সুতরাং এরই প্রতি তারা (মুসলমানরা) যেন খুশি উদযাপন করে। তারা যা সঞ্চয় করছে তা থেকে এটিই শ্রেষ্ঠতর।’১৬
এ আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন খুশি উদযাপনের দুটি উপকরণ সাব্যস্ত করেছেন। একটি হল অনুগৃহ (فضل), আর অপরটি হল (رحمة)। এতদুভয়ের মর্ম কী- এর ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত তাফসির বিশারদ আল্øামা মাহমুদ আলুসী১৭, ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী১৮ ইমাম আবু হাইয়ান আনদুলসী১৯ আলাইহিমুর রাহমান স্ব-স্ব তাফসীরে গ্রন্থে তাফসিরকারকদের শিরোমণি হযরত ইব্ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, এখানে (فضل) দ্বারা জ্ঞান এবং (رحمة) দ্বারা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা উদ্দেশ্য।
আল্লামা ইবনু জাওযী (রহ.) বলেন ان فضل الله العلم ورحمته محمد صلي الله عليه وسلم – رواه الضحاك অর্থ- ‘নিশ্চয় আল্লাহর ‘ফদ্বল’ হল জ্ঞান আর ‘রহমত’ হল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা, যা ইমাম দাহ্হাক রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন।২০
আল্লামা তিবরিসী উল্লিখিত আয়াতের অর্থ করতে গিয়ে বলেন
فا فرحوا بفضل الله عليكم ورحمته لكم بانزال هذا القران وارسال محمد اليكم فانكم تحصلون بهما نعيما دائما مقيما هو خير لكم من هذه الدنيا الفانية
অর্থ- ‘তোমাদের প্রতি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করে এবং কুরআর অবতীর্ণ করে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর যে দয়া ও করুণা করেছেন, তাতে তোমরা খুশি উদযাপন কর। কেননা, উভয়ের (ফদ্বল ও রহমত) মাধ্যমে নিশ্চয় তোমরা চিরস্থায়ী নিয়ামত অর্জন করবে, যা এ নশ্বর পৃথিবী থেকে তোমাদের জন্য অধিকতর শ্রেয়।’২১
ইমাম বাক্বির রাদ্বিয়াল্লাহু তায়লা আনহু প্রখ্যাত মুফাসসির হযরত ক্বাতাদাহ্, হযরত মুজাহিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা প্রমুখ থেকে বর্ণনা করেন যে, (فضل الله) দ্বারা রাসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্øামাকে বুঝানো হয়েছে।২২
উল্লিখিত আয়াতে ‘রহমত’ দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে বুঝানো হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ, আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহকে উদ্দেশ করে ইরশাদ করেছেন وما ارسلناك الا رحمة للعالمين ‘আমি আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছে।’২৩
প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা মাহমূদ আলূসী আলাইহির রাহমাহ প্রমুখের মতে ‘রহমত’ হল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি নাম। এছাড়াও রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন বিশ্ববাসীর জন্য সবচেয়ে বড় নিয়ামত। এতে কারো দ্বিমত নেই। তাই, আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন ولقد من الله علي المؤمنين اذ بعث فيهم رسولا من انفسهم অর্থ- ‘আল্লাহ মুমিনদের ওপর অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছেন।’২৪
সুতরাং বুঝা গেল যে, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা বিশ্ববাসীর জন্য বড় অনুগ্রহ ও নিয়ামত। এ কারণে আল্লাহু তায়ালা এ বড় অনুগ্রহ তথা রাসূলুল্লাহকে পাবার ওপর খুশি উদযাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। আর রাসূলুল্লাহকে পাবার দিন হল ‘মিলাদুন্নবী’ এবং ‘মিলাদুন্নবী’ কে কেন্দ্র করে খুশি উদযাপন করাই হল ‘ঈদ মিলাদুন্নবী’, যা পালন করার নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহ দিয়েছেন।
দেওবন্দীদের গুরু মৌলভী আশরাফ আলী থানভী বলেন যে, “উল্লেখিত আয়াতে ‘রহমত’ও ‘ফদ্বল’ দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে বুঝানো হয়েছে, যার জন্মের ওপর আল্লাহ তায়ালা খুশি উদযাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ তিনি সকল নিয়ামতের মূল। তাই তাঁর আগমনে যতই খুশি উদযাপন করা হোক না কেন তা কমই হবে।”২৫
এ ছাড়াও উপরিউক্ত আয়াতে ‘রহমত’ শব্দ দ্বারা রাসূলুল্লাহকে খাস বা নির্দিষ্ট অর্থে বুঝানো না হলেও ‘আম’ বা ব্যাপকার্থে তাঁকে বুঝাতে কারো দ্বিমত থাকতে পারে না। কারণ, তিনি সৃষ্টিজগতের প্রতি আল্লাহর বড় রহমত। আল্লাহর অন্যান্য নিয়ামতের ন্যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা যেহেতু একটি নিয়ামত, সেহেতু তাঁর আগমনের ওপর খুশি উদযাপন করা আল্লাহর নির্দেশ পালন মাত্র। আর রাসূলুল্লাহ’র জন্ম উপলক্ষে খুশি উদযাপন করার নামই হল ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’।
অতএব, কুরআনের আয়াত থেকে প্রমাণিত হল যে, রাসূলের জন্ম উপলক্ষে খুশি উদযাপন করা আল্লাহর নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। খুশি উদযাপনের ক্ষেত্রে সকল বৈধ পন্থা গ্রহণ করা শরিয়ত সম্মত। তাই মুসলমানগণ একত্রিত হয়ে মানুষদের প্রতি আল্লাহর বড় কৃপার কথা তথা রাসূলের আগমনের কথা স্মরণ করে, রাসূলের জীবন-বৃত্তান্ত বর্ণনা করে, ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে খাবারের ব্যবস্থা এবং দান-সদকা ইত্যাদির ব্যবস্থা করে। মোটকথা, খুশি উদযাপনের বহিঃপ্রকাশ শরিয়তসম্মত পন্থায় হলে কোন অসুবিধা নেই। এটা বড় সওয়াব ও ইবাদত।
২. মহান আল্লাহ কর্তৃক মিলাদুন্নবী উদযাপন
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, মিলাদুন্নবী উদযাপন বলতে নবীর জন্মকে স্মরণ করা এবং তাঁর জীবন-বৃত্তান্ত বর্ণনা করা। মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে পঁচিশ জন নবী- রাসূলের মধ্যে হযরত আদম, হযরত মূসা হযরত ইয়াহইয়া, হযরত ঈসা ও হযরত মুহাম্মদ আলাইহিমুস সালামের জন্ম-বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন। যেমন- হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন وسلام عليه يوم ولد
অর্থ- ‘তার প্রতি শান্তি যেদিন তিনি [ইয়াহইয়া (আ.)] জন্মলাভ করেছেন।’২৬
এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামের জন্মকালের কথা উল্লেখ করেছেন। আর এটার নাম ‘মিলাদুন্নবী’ বা নবীর জন্মকাল।
তিনি পবিত্র কুরআনে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা সম্পর্কে ইরশাদ করেন
لقد جاءكم رسول من انفسكم عزيز عليه ما عنتم حريص عليكم بالمؤمنين روؤف رحيم
অর্থ-‘অবশ্যই তোমাদের মধ্য থেকেই (বংশ থেকে) তোমাদের নিকট এসেছেন এক রাসূল। তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে তা তাঁর জন্য কষ্টদায়ক, তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি ¯েœহশীল, পরম দয়ালু।’২৭
এ আয়াতে মহান আল্লাহ আরবদেরকে স্মরণ করে দিলেন যে, তাদের নিকট তাদের বংশ থেকেই এক মহান রাসূল এসেছেন। এখানে আসার অর্থ হল জন্মগ্রহণ করা। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র জন্ম তথা ‘মিলাদুন্নবী’র কথা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়াও তিনি অসংখ্য আয়াতে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার আগমনের কথা উল্লেখ করেছেন। এভাবে তিনি তাঁর প্রেরিত নবী-রাসূলের জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন তথা ‘মিলাদুন্নবী’ উদযাপন করেছেন। তাই মুমিনগণও তাদের প্রতি নবী প্রেরণের কথা স্মরণ করেন।
খ. হাদিস শরিফের আলোকে
ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা উদযাপন করা হাদিছ শরিফ দ্বারাও প্রমাণিত হয়। রাসূলুল্লাহ নিজেও শোকরিয়া স্বরূপ এ ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করেছেন, ছাগল জবাই করে এবং রোযা রেখে। এ সম্পর্কিত কয়েকটি হাদিস নি¤েœ উল্লেখ করা হল।
১. প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাসা রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু বলেন
قدم النبي المدينة فرأي اليهود تصوم يوم عاشوراء فقال ما هذا؟ قالوا هذا يوم صالح هذا يوم نجي الله بني اسرائيل من عدوهم فصامه موسي قال فانا احق بموسي منكم فصامه وأمر بصيامه
অর্থ : ‘নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা মদিনা শরীফ আগমন করলেন এবং সেখানে ইয়াহুদিদেরকে আশুরার দিনে রোযা রাখতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন- এটা কিসের রোযা? তারা বলল- এটা উত্তম দিন, আর এ দিনেই আল্লাহ বনি ইসরাঈলকে তাদের শত্রুদের থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তাই হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এ দিনে রোযা রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন, তোমাদের চেয়ে মূসা আলাইহিস সালামের আমিই অধিকরতর হক্বদার। অতঃপর তিনি স্বয়ং রোযা রাখলেন এবং তাঁর উম্মতদেরকে এ রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন।২৮
২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অন্য বর্ণনা করেন
هذ اليوم الذي اظفر الله فيه موسي وبني اسرائيل علي فرعون ونحن نصومه تعظيما له فقال رسول الله صلي الله عليه وسلم : نحن اولي بموسي منكم ثم امر بصومه
এদিনেই আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এবং বনি ইসরাঈলকে ফিরাউনের ওপর বিজয় দান করেছেন। আমরা এ দিনের সম্মানার্থে রোযা রাখছি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ইরশাদ করেন- “আমরা তোমাদের চেয়ে মূসা আলাইহিস সালাম’র অধিকতর হক্বদার। তারপর তিনি (মুমিনদেরকে) এ রোযা রাখার নির্দেশ দেন।’২৯
৩. হযরত আবু ক্বাতাদাহ আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন
إن رسول الله صلي الله عليه وسلم سئل عن صوم يوم الاثنين قال: ذاك يوم ولدت فيه ويوم بعثت او انزل علي فيه
অর্থ-‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে সোমবারে রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বলেন- সেদিন আমার জন্ম হয়েছে, আমি নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছি এবং আমার ওপর কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে।’৩০
উল্লিখিত হাদিছ শরীফ থেকে বুঝা গেল যে, রাসূলুল্লাহ সোমবার রোযা রাখতেন। সাহাবায়ে কেরাম এর কারণ জানতে চাইলে তিনি ইরশাদ করেন যে, সেদিন তাঁর জন্মদিন ও নবুয়ত প্রকাশের দিন। তাঁর ওপর আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করে তিনি প্রতি সোমবার আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপনার্থে রোযা রাখতেন। তিনি জন্মদিনে আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপন করতেন। সুতরাং আল্লাহর নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপনার্থে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদযাপন করা রাসূলুল্লাহর সুন্নাত।
উপরিউক্ত হাদিছসমূহ থেকে প্রমাণিত হল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র জন্ম উপলক্ষে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদযাপন করা শুধু বৈধ নয়; বরং অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। এটি স্বয়ং রাসূলুল্লাহর সুন্নাত। কারণ তিনি নিজেও আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপনার্থে ছাগল জবাই করে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদযাপন করেছেন এবং প্রতি সোমবার রোযা রাখতেন।
গ. সাহাবায়ে কিরামের স্বীকৃতি
১. ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন –
من انفق درهما علي قراءة مولد النبي صلي الله عليه وسلم كان رفيقي في الجنة
অর্থ- ‘যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাআ উদযাপনে এক দিরহামও ব্যয় করবে সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।’৩১
২. হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন
من عظم مولد النبي صلي لله عليه وسلم فقد احي الاسلام
অর্থ- ‘যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা উদযাপনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল, সে যেন ইসলামকে উজ্জীবিত করল।’৩২
৩. হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন
من انفق درهما علي قراءة مولد النبي صلي الله عليه وسلم فكانما شهد غزوة بدر وحنين
অর্থ- ‘যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবী উদযাপনে এক দিরহামও ব্যয় করবে, সে যেন বদর ও হুনাইনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল।’৩৩
৪. হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন
من عظم مولد النبي صلي الله عليه وسلم وكان سببا لقرأته لا يخرج من الدنيا الا بالايمان ويدخل الجنة بغير حساب
অর্থ- ‘যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবী উদযাপনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল; সে যেন মিলাদুন্নবী উদযাপন করল। এ কারণে সে ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করবে এবং বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবে।’৩৪
খোলাফায়ে রাশেদীনের উপরিউক্ত বর্ণনা থেকে বুঝা গেল যে, ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করতেন সাহাবায়ে কিরামগণও। তাদের বাণীসমূহ থেকে আরো বুঝা যায় যে, ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদযাপন করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ।
ঘ. সালফে সালেহীনের স্বীকৃতি
১. প্রথম সারীর তাবেঈ হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-
وددت لو كان لي مثل جبل احد ذهبا فانفقته علي قراأة مولد النبي صلي الله عليه وسلم
অর্থ-‘যদি আমার নিকট উহুদ পর্বতসম স্বর্ণ থাকত, তাহলে আমি তা মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামা উদযাপনে খরচ করতাম।’৩৫
২. তাবেঈ যুগের প্রখ্যাত সূফি এবং মুহাদ্দিছ ইমাম র্সারি সাক্বাত্বী আলাইহির রাহমাহ বলেন
من قصد موضعا يقرافيه مولد النبي صلي الله عليه وسلم فقد قصد روضة من رياض الجنة لانه ما قصد ذالك الموضع لا لمحبة الرسول
অর্থ- ‘যে ব্যক্তি কোন স্থানে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা উদযাপনের ইচ্ছা করল, সে যেন জান্নাতের বাগান সমূহের একটি বাগানে মিলাদুন্নবী উদযাপনের ইচ্ছা করল। কেননা, সে রাসূলুল্লাহর ভালোবাসার কারণেই ঐ স্থানে মিলাদুন্নবী উদযাপনের ইচ্ছা করেছে।’৩৬
উপরিউক্ত বর্ণনা থেকে বুঝা গেল যে, ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা তাবেঈ কর্তৃক স্বীকৃত এবং উত্তম তিন যুগের উলামায়ে কিরাম ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদযাপনের স্বীকৃতি দিয়েছেন।
ঙ. উলামায়ে আহনাফের অভিমত
ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের পক্ষে উলামায়ে আহনাফের অভিমত পাওয়া যায়। তা থেকে কয়েকটি নি¤েœ উল্লেখ করা হল এবং হাদিস ভাষ্যকার ইমাম মুল্লা আলী ক্বারী আলাইহির রাহমাহ ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদযাপনের পক্ষে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। নি¤েœ এর কিয়দাংশ উল্লেখ করা হল। তিনি বলেন
ان الزاهد القدوة المعمر ابا اسحاق ابراهيم بن عبد الرحيم بن جماعة لما كان بالمدينة النبوية علي ساكنها أفضل الصلوة واكمل التحية كان يعمل طعاما في المولد النبي صلي الله عليه وسلم ويطعم الناس …………………. وسميته بالمورد الروي في مولد النبي
অর্থ-“অনুসরণীয় সূফি আবু ইসহাক ইবরাহীম বিন আব্দর রহীম বিন জামায়াহ্ আলাইহির রাহমাহ যখন মদিনা শরীফে ছিলেন, তখন তিনি মিলাদুন্নবী উদযাপন উপলক্ষে খাবার তৈরি করে মানুষদের খাওয়াতেন আর বলতেন- ‘আমার পক্ষে যদি সম্ভব হতে, তাহলে পুরো মাস জুড়ে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা উদযাপন করতাম।’ আমি মুল্লা আলী ক্বারী বলছি- আমি যেহেতু (ইবনে জামায়াহর মত সম্পদ ব্যয় করে) যিয়াফত করতে অক্ষম, সেহেতু (ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনে) এ ক’টি পৃষ্ঠা লিখলাম, যাতে এগুলো এমন অপ্রকাশ্য যিয়াফত হয়ে যায়, যা শুধু মাস বা বছর নয়; বরং যুগ যুগ ধরে চলমান থাকবে। আর এর (পৃষ্ঠাগুলোর) নাম রাখলাম ‘আল-মাওরিদুর রবী ফি মাওলিদিন্ নবী।”৩৭
২. ‘রুহুল বয়ান’ গ্রন্থাকার আল্লামা ইসমাঈল হক্কী আলাইহির রাহমাহ বলেন-
ومن تعظيمه عمل المولد اذالم يكن فيه منكر قال السيوطي قدس سره يستحب لنا إظهار الشكر لمولده عليه السلام-
অর্থ-‘শরীয়তে নিষিদ্ধ নয় এমন কাজ দ্বারা মিলাদুন্নবী উদযাপন করা রাসূলুল্লাহকে সম্মান করার নামান্তর।
ইমাম সুয়ূতী কুদ্দিসা সিররুহ বলেন – মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র জন্য শোকরিয়া জ্ঞাপনের বহিঃপ্রকাশ করা আমাদের জন্য মুস্তাহাব।’৩৮
৩. শাইখ আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী আলাইহির রাহমাহ বলেন
لايزال اهل الاسلام يحتفلون بشهر مولده صلي الله عليه وسل ويعملون الولائم ………………… بقراأة مولده الكريم
মিলাদুন্নবীর মাসে মুসলিমগণ সর্বদা মিলাদ মাহফিল করে আসছেন, খানা পিনার ব্যবস্থা করে থাকেন, আনন্দ প্রকাশ করেন, অধিক নেক আমল করেন এবং মিলাদুন্নবীর গঠনাবলী বর্ণনা করেন।৩৯
৪. আল্লামা শাহ্ আব্দুর রহিম মুহাদ্দিছ দেহলভী আলাইহির রাহমাহ বলেন
كنت اصنع في ايام المولد طعاما صلة بالنبي صلي الله عليه وسلم ……………. هذا الحمص متبهجا شاشا
অর্থ- ‘মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা উদযাপন উপলক্ষে আমি প্রতি বছর খানা-পিনার ব্যবস্থা করতাম; কিন্তু এক বছর তেমন খানা-পিনার ব্যবস্থা করতে না পেরে কিছু ভাজা (চনাবুট) মানুষদেরকে দিলাম। অতঃপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে স্বপ্নে দেখলাম যে, আমার ভাজা ছোলা তাঁর সামনে আছে এবং তিনি আনন্দিত।’৪০
৫. শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী আলাইহির রাহমাহ বলেন-
وكنت قبل ذالك بمكة المعظمة في مولد النبي صلي عليه وسلم في يوم ولادته والناس يصلون علي النبي صلي الله عليه وسلم ………………… انوار الرحمة
অর্থ- ‘ইতিপূর্বে আমি মিলাদুন্নবী উদযাপনের সময় মক্কা শরীফ ছিলাম। যখন মানুষেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র ওপর দরূদ পাঠ করছিলেন এবং সেসকল ঘটনা বর্ণনা করছিলেন, যা তাঁর বিলাদত শরিফের সময় এবং বিলাদতের পর প্রকাশ পেয়েছিল। অতঃপর আমি দেখতে পেলাম, মাহফিলের ওপর তাজাল্লিয়াতের বর্ষণ শুরু হয়েছে। আমি বলছি না যে, এ দৃশ্য শুধু চর্ম চক্ষু দ্বারা দেখেছি। আর এটা বলছি না যে, শুধু অন্তরের চক্ষু দ্বারা দেখেছি। (অর্থাৎ উভয় চোখ দ্বারাই দেখেছি) আল্লাহ অধিকতর জ্ঞাত সুতরাং যাই হোক না কেন, আমি চিন্তা করে বুঝতে পেরেছি যে, মূলত নূরের তাজাল্লিয়াত ফেরেশতাদের নূরের তাজাল্লিয়াতের সাথে আল্লাহর রহমতও অবতীর্ণ হচ্ছে।’৪১
৬. ‘ইলমুছ ছিগাহ’ গ্রন্থকার মুফতি ইনায়াতুল্লাহ কাকুরবী আলাইহির রাহমাহ বলেন-
‘হারামাইন শরিফাইন এবং অধিকাংশ ইসলামী দেশে রবিউল আউয়াল মাসে মুসলিমরা মিলাদুন্নবী উদযাপন করেন, মুসলমানদেরকে একত্র করে মিলাদ-মাহফিলের ব্যবস্থা করেন, অধিক পরিমাণে দরুদ শরীফ পাঠ করেন এবং খানা-পিনা বা ফিরনির ব্যবস্থা করেন। মূলত এটি অত্যন্ত সওয়াবের কাজ এবং এটি রাসূলুল্লাহর ভালবাসা বৃদ্ধির মাধ্যম।’৪২
৭. হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী আলাইহির রাহমাহ বলেন- ‘মিলাদ শরীফ’
পালনের ব্যাপারে আমাদের উলামায়ে কিরাম মতবিরোধ করে থাকেন। এতদসত্ত্বেও আলেমগণ তা বৈধতার পক্ষে মত দিয়েছেন। এটি বৈধ হবার পন্থা থাকা সত্ত্বেও তারা কেন এত কঠোরতা প্রদর্শন করে। আমাদের জন্য হারমাইন শরিফের অনুসরণই যথেষ্ট।’৪৩
৭. মাওলানা আব্দুল হাই লাকনভী বলেন- ‘যে কোন সময়ে বৈধ পন্থায় মিলাদুন্নবী উদযাপন করা সওয়াবের কাজ।’৪৪
তথ্যসূত্র :
০১. ইবনু মনযুর, লিসানুল আরব।
০২. মুফতি আমীমুল ইহসান, কাওয়ায়িদুল ফিকহ।
০৩. ইবনু মনযুর, প্রাগুক্ত।
০৪. ইমাম তিরমিযী, আল-জামেউস সহীহ।
০৫. ইমাম তিরমিযী, প্রাগুক্ত।
০৬. ইবনে সাদ, আত তাবকাতুল কুবরা।
০৭. ইবনে সাদ, প্রাগুক্ত।
০৮. ইবনু সাদ, প্রাগুক্ত।
০৯. আল্লামা ইবনু হাজর আসকালানী, ফতহু বারী।
১০. আল কুরআন, সূরা বাকারা, আয়াত নং-১৫২।
১১. আল কুরআন, সূরা বাকারা, আয়াত নং-৪৭।
১২. আল কুরআন, সূরা আল ইমরান, আয়াত নং-১০৩।
১৩. আল মাওসূয়াতুল ফিকহিয়্যাহ আল-কুয়াইতিয়্যাহ।
১৪. আল কুরআন, সূরা দুহা, আয়াত নং-১১।
১৫. আল কুরআন, সূরা মায়িদা, আয়াত নং-১১৪।
১৬. আল কুরআন, সূরা ইউনূস, আয়াত নং-৫৮।
১৭. আল্লামা আলূসী, রুহুল মায়ানী।
১৮. ইমাম সূয়তী, আদ্ দুররুল মনছুর।
১৯. ইমাম আবু হাইয়ান, আল বাহরু মুহীত।
২০. ইবনু জাওযী, যাদুল মাসীর।
২১. আল্লামা তিবরিসী, মাজমাউল বয়ান।
২২. প্রাগুক্ত ।
২৩. আল কুরআন, সূরা আম্বিয়া, আয়াত নং-১০৭।
২৪. প্রাগুক্ত, সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং-১৬৪।
২৫. মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, মিলাদুন্নবী, পৃ. ১৫৪, ১২০, ১২১।
২৬. আল-কুরআন, সূরা মরিয়ম, আয়াত নং- ১৫।
২৭. প্রাগুক্ত, সূরা তাওবাহ, আয়াত নং- ১২৮।
২৮. ইমাম বুখারী আল জামেউস সহীহ।
২৯. ইমাম বুখারী, প্রাগুক্ত।
৩০. ইমাম মুসলিম, প্রাগুক্ত।
৩১. ইমাম ইবনু হাজর হায়তমী, আন-নি’মাতুল কুবরা।
৩২. প্রাগুক্ত।
৩৩. প্রাগুক্ত।
৩৪. প্রাগুক্ত।
৩৫. প্রাগুক্ত।
৩৬. ইমাম আবু বকর ইবনুস সাইয়িদ দিইয়াতী, প্রাগুক্ত।
৩৭. মুল্লা আলী ক্বারী, আল মাওরিদুর রবী ফি মাওলিদিন নবী।
৩৮. আল্লামা ইসমাঈল হক্কী, রুহুল বয়ান।
৩৯. শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী, মা ছাবাতা বিস্-সুন্নাহ ফি আইয়ামিন সানাহ।
৪০. শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী, আদ্ দুররুছ ছমীন।
৪১. শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী, ফয়জুল হারামাইন।
৪২. মুফতি ইনায়াতুল্লাহ, তাওয়ারিখি হাবীবে ইলাহ।
৪৩. হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী, শামায়িলে ইমাদাদিয়্যাহ, পৃ.-৯৫।
৪৪. আব্দুল হাই লাকনভী, ফাতাওয়ায়ে আবদিল হাই, খ. ২য়, পৃ.-২৮৩।