ইমাম-ই আ’যম আলায়হির রাহমাহ্ ও হানাফী মাযহাবের শ্রেষ্ঠত্ব
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে তাঁরই একমাত্র পছন্দনীয় ও পূর্ণাঙ্গ দ্বীন-ইসলাম দুনিয়াবাসীকে দান করেছেন। আর এ দ্বীন-ই ইসলামের বিরুদ্ধে যখনই কোনভাবে চক্রান্ত হয়েছে এবং সেটার স্বচ্ছ অবয়বের উপর কলঙ্ক লেপনের জন্য ষড়যন্ত্র হয়েছে, তখনই আল্লাহ্ তা‘আলা সেটার সত্যতা ও স্বচ্ছতাকে অক্ষুণœ-অম্লান রাখারও ব্যবস্থা করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। উদাহরণ স্বরূপ, হুযূরহ-ই আক্রামের বরকতময় হাতে ইসলামের পূর্ণতা প্রতিষ্ঠা লাভের পর, তাঁর ওফাত শরীফের সাথে সাথে ইসলামের বিরুদ্ধে বহুবিধ হামলা পরিচালিত হয়েছিলো। তখন হুযূর-ই আক্রামের যোগ্যতম উত্তরসূরী ও শ্রেষ্ঠতম অনুসারী হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এগিয়ে এসে সব ক’টি চক্রান্তকে নস্যাৎ করে দিয়ে ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্রের ভিতকে পুনরায় মজবুত ও সুদৃঢ় করে দিয়েছেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাত্র একশ’ বছরের মাথায় ইমাম-ই আ’যম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর ‘মাযহার-ই আতাম্ম’ (পূর্ণতম প্রকাশস্থল) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইসলামের অনন্য ও যুগোপযোগী খিদমত আঞ্জাম দেন। হযরত সিদ্দীক্ব-ই আক্বার রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যথাসময়ে উম্মত-ই মোস্তফার সাহায্যে এগিয়ে এসে তাদেরকে ‘ইখতিলাফ’ (মতবিরোধ) থেকে রক্ষা করেছেন, তাদের ইস্পাত কঠিন ভিতকে নড়বড়ে হতে দেননি। অনুরূপ ইমাম-ই আ’যম আলয়হির রাহমাহ্ গোটা মুসলিম জাতির এত বড় সাহায্য করেছেন যে, তাঁদেরকে কুফর, যিন্দীক্বী ও ইলহাদ (যথাক্রমে, কুফর, মুনাফিক্বী ও মুসলমান নামধারীদের কপটতা)-এর চক্রান্তরূপী ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষা করেছেন। আজ তাঁর ইল্মী ইজতিহাদের বরকতে মুসলিম উম্মাহ্, কাফির-মুরতাদ্দ্দের ফিৎনাদি থেকে মুক্ত হতে পারছে। হিজরী পঞ্চম শতাব্দির শেষভাগে দ্বীন-ই ইসলামকে পুনর্জীবিত করেছিলেন শাহানশাহে বাগদাদ হুযূর গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। সুতরাং এটা মুসলিম জাতির জন্য সৌভাগ্য যে, ইসলামের গৌরবময় ইতিহাসে হযরত সিদ্দীক্ব-ই আক্বার ‘খলীফা-ই আ’যম, হযরত আবূ হানীফা ‘ইমাম-ই আ’যম আর হযরত শায়খ আবদুল ক্বাদের জীলানী ‘গাউসে আ’যম’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম। আমি এ নিবন্ধে পরিসরের স্বল্পতার দিকে লক্ষ রেখে প্রথমে ইমাম-ই আ’যম হযরত আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আনহুর সংক্ষিপ্ত জীবনী তারপর প্রাসঙ্গিকভাবে হানাফী মাযহাবের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করবো। ইনশা-আল্লাহ্।
ইমাম-ই আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও হানাফী মাযহাবের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা এখন যুগের অন্যতম প্রধান দাবী। কারণ, গোটা দুনিয়ার সব মুসলমান ইমাম-ই আ’যমের প্রশংসাকারী এবং বিশ্বের অধিকাংশ মুসলমান হানাফী মাযহাবের অনুসারী হওয়া যেমন সুখের বিষয়, তেমনি একশ্রেণীর অকৃতজ্ঞ ও মুর্খ লোকের ইসলামের মুখোশ পরে, সলফে সালেহীনের তথাকথিত অনুসারী ও ইমাম বোখারীর কপট ভক্ত সেজে ইমাম-ই আ’যম ও হানাফী মাযহাব এমনকি সব ইমাম ও মাযহাব-এর বিরুদ্ধে অপতৎপরতা চালানোও অতীব দুঃখের কারণ। এ শেষোক্ত অশুভ তৎপরতা বেশ কিছুদিন আগে থেকে পরিলক্ষিত হলেও ইদানিং এটা আশঙ্কাজনকভাবে দেখা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, গায়র-মুক্বাল্লিদ ওহাবী সম্প্রদায়টি ইমামে আ’যম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ঘোর শত্রু। তারা তাঁর মাসআলাগুলো থেকে খুঁত বের করার অপপ্রয়াস চালায় এবং সেগুলো নিয়ে ঠাট্টা-মজাক করার ধৃষ্টতা দেখায়। তাদের ধৃষ্টতা এতটুকুতে গিয়ে দাঁড়ায় যে, তাদের কোন কোন হতভাগা লোক ইমাম-ই আ’যমের জন্ম তারিখ (৮০ হি.) থেকে আবজাদের হিসাবানুসারে سگ (কুকুর) এবং ওফাতের তারিখ (১৫০হি.) থেকে بوكم جهان پاك (বূ-কমে জাহানে পাক) লিখেছে। না‘ঊযুবিল্লাহ্। অবশ্য, হানাফী মাযহাবের অনুসারীগণও এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ বলেছেন, وهابى (ওহাবী) শব্দের সংখ্যানুসারে দাঁড়ায় ‘گد’ (শকুন)। এর সংখ্যা হয় ২৪। তাদের উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যও রয়েছে। যেমন- ‘শকুন’ মৃত খায়। আর এসব লা-মাযহাবী ওহাবীও পূর্ববর্তী বুযুর্গদের বদনাম (গীবৎ) করে। এমন লোকদের এ অপকর্মকে ক্বোরআন-ই পাকে মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার নামান্তর সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাছাড়া, وهابى (ওহাবী)’র সংখ্যাও ২৪, আবার چوها (ইদুঁর)-এর সংখ্যাও ২৪। ওহাবীরা ইঁদুদের মতো দ্বীনে কাটছাঁট করতে সচেষ্ট থাকে। মোটকথা, লা-মাযহাবী ওহাবীদের অশালীন মন্তব্য ও অপপ্রচারের ফলে প্রত্যেক হানাফী তথা সত্যিকারের মুসলমানের অন্তরে দুঃখ পায়। সুতরাং ইমাম-ই আ’যম ও তাঁর প্রবর্তিত হানাফী মাযহাবের শ্রেষ্ঠত্ব যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারলে এসব অকৃতজ্ঞ ও হতভাগার ওই মুখোশ উম্মোচিত হবে। আর সঠিক পথটি বেছে নিতে পারবেন সরলপ্রাণ মুসলিম সমাজ। সুতরাং দেখুন আমাদের মহানতম ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবন-বৃত্তান্ত ও শ্রেষ্ঠত্ব।
নাম ও বংশ পরিচয়
হযরত ইমাম-ই আ’যমের নাম শরীফ নো’মান ইবনে সাবিত ইবনে যাওত্বী। হযরত যাওত্বী অর্থাৎ ইমাম-ই আ’যমের দাদা পারস্যে এক অভিজাত বংশের লোক। তিনি হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর অকৃত্রিম আশেক্ব ছিলেন এবং তাঁর দরবারের খাস ও নৈকট্যধন্য ছিলেন। তাঁরই ভালবাসার কারণে তিনি কূফায় বসবাস করতে থাকেন, যা হযরত আলী মুরতাদ্বার রাজধানী ছিলো। হযরত যাওত্বী তাঁর সন্তান হযরত সাবিতকে, তাঁর শৈশবে হযরত আলী মুরতাদ্বার নিকট দো‘আর জন্য নিয়ে এসেছিলেন। হযরত আলী মুরতাদ্বা সাবিতের জন্য দো‘আ করলেন এবং অনেক বরকত বা কল্যাণের সুসংবাদ দিলেন। হযরত ইমাম-ই আ’যম হযরত আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুরই কারামত ও সুসংবাদের বাস্তবরূপ।
হযরত ইমাম আবূ হানীফা ৮০ (আশি) হিজরীতে কূফায় জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১৫০ হিজরীতে বাগদাদে ওফাত পান। আর ‘খায়যুরান’ কবরস্থানে দাফন হন। তাঁর মাযার শরীফ এখনো অগণিত আম ও খাস লোকের যিয়ারতস্থল। তিনি সত্তর বছর হায়াত পান।
হযরত ইমাম-ই আ’যম অনেক সাহাবী (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম)-এর সাক্ষাৎ পেয়ে ধন্য হন। তন্মধ্যে তিনি চারজন সাহাবীর সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করেছেন। তাঁরা হলেনঃ এক. হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু), যিনি বসরায় ছিলেন, খ. হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আবী আওফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, যিনি কূফায় বসবাস করতেন, তিন. হযরত সুহায়ল ইবনে সা’দ সা-‘ইদী, যিনি মদীনা মুনাওয়ারায় থাকতেন এবং চার. হযরত আবূ ত্বোফাইল ‘আমির ইবনে ওয়া-সিলাহ্, যিনি মক্কা-ই মুর্কারমায় থাকতেন। এটাই সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ও প্রণিধানযোগ্য বর্ণনা। ইমাম-ই আ’যম হযরত হাম্মাদের যোগ্যতম ছাত্র এবং ইমাম জাফর সাদিক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খাস শাগরিদ ছিলেন। দীর্ঘ দু’বছর যাবৎ তিনি হযরত ইমাম জাফর সাদিক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর একান্ত সান্নিধ্যে ছিলেন। হযরত ইমাম-ই আ’যমকে বাদশাহ্ মানসূর কূফা থেকে বাগদাদে নিয়ে আসেন। অতঃপর তাঁকে প্রধান বিচারপতি (ক্বা-দ্বিউল ক্বুদ্বাত)-এর পদ অলংকৃত করার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। এজন্য বাদশাহ্ তাঁকে বন্দি করে জেলে পাঠিয়েছিলেন। এ বন্দিদশায়ই এ মহান ইমাম শাহাদত বরণ করেন। রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু।
ইমাম-ই আ’যমের গুণাবলী
বাস্তবিক পক্ষে ইমামে আ’যমের ফযীলত বা গুণাবলীর গণনা করে লিপিবদ্ধ করা আমাদের সাধ্যের বাইরে। হযরত ইমাম-ই আ’যম হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন্ত মু’জিযা এবং হযরত আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর অম্লাণ কারামত। তিনি হলেন উম্মতে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর চেরাগ (প্রদীপ) ও দ্বীনী সমস্যাবলীর সমাধানদাতা। আল্লাহরই জন্য সমস্ত প্রশংসা। সুন্নী হানাফীরা অতিমাত্রায় সৌভাগ্যবান। আমাদের রসূল হলেন ‘রসূল-ই আ’যম’। (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম), আমাদের পীর-মুর্শিদ হলেন ‘গাউস-ই আ’যম, (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু) আর আমাদের ইমাম হলেন ‘ইমাম-ই আ’যম’ (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু)। ‘আযমত ও ইয্যাত’ (মহত্ব ও সম্মান) আমাদের ভাগ্যেই রয়েছে। বরকত হাসিলের জন্য আমি ইমাম-ই আ’যমের কয়েকটা গুণ বা বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার প্রয়াস পাচ্ছি। হানাফীরা পড়–ন, দেখুন, আর খুশী ও আনন্দে পুলকিত হোন!
এক. আমাদের আক্বা ও মাওলা হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত ইমাম-ই আ’যম সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন এবং তাঁর গুণাবলী অতি গুরুত্বের সাথে বর্ণনা করেছেন। সুতরাং ইমাম বোখারী ও ইমাম মুসলিম হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে আর ইমাম ত্বাবরানী হযরত ইবনে মাস‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে, আবূ নু‘আয়ম শীরাযী ত্বাবরানী হযরত ক্বায়স ইবনে সাবিত ইবনে ওবাদাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
لَوْكَانَ الْاِيَمَانُ عِنْدَ الثُّرَيَّا لَتَنَاوَلُه رِجَالٌ مِّنْ اَبِْنَاءِ فَارِسَ وَفِىْ رِوَايَةِ الْبُخَارِىِّ وَمُسْلِمٍ وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِه لَوْكَانَ الدِّيْنُ مُعَلَّقًا بِالثُّرَيَّا لَتَنَاوَلُه رَجُلٌ مِّنْ فَارِسَ
অর্থাৎ ‘‘যদি ঈমান সুরাইয়া নক্ষত্রের নিকটও থাকে, তবে পারস্যের সন্তানদের কিছুলোক তা সেখান থেকে নিয়ে আসবে।’’ বোখারী ও মুসলিমের অন্য বর্ণনায় আছে, ‘‘ওই মহান সত্ত্বার শপথ, যাঁর ক্বুদরতের হাতে আমার প্রাণ, যদি দ্বীন-ই ইসলাম সুরাইয়্যা নক্ষত্রের সাথে ঝুলন্ত থাকে, তাহলে পারস্যের এক ব্যক্তি তা নিয়ে আসবে।’’
বলুন, পারস্য-বংশোদ্ভূতদের মধ্যে ইমাম-ই আ’যম আবূ হানীফা নো’মান ইবনে সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর এ শান বা মর্যাদার আর কে আছে? গোটা পারস্যে তাঁর মতো আর কেউ জন্মগ্রহণ করেনি। সুতরাং এ ভবিষদ্বাণী তাঁরই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
দুই. আল্লামা ইবনে হাজর মক্কী শাফে‘ঈ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হযরত ইমাম-ই আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর প্রশংসায় একটি স্বতন্ত্র পুস্তক লিখেছেন। সেটার নাম ‘খায়রাতুল হিসান ফী তরজমাতি আবী হানীফাতান্ নো’মান।’ তাতে তিনি একটি হাদীস শরীফ উদ্ধৃত করেছেন। ওই হাদীস শরীফে হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
تُرْفَعُ زِيْنَةُ الدُّنْيَا سَنَةَ خَمْسِيْنَ وَمِائَةٍ
অর্থাৎ ‘‘দেড়শ’ হিজরীতে দুনিয়ার সৌন্দর্য তুলে ফেলা হবে।’’ ১৫০ হিজরীতে ইমাম-ই আ’যমের ওফাত শরীফ।
বুঝা গেলো যে, ইমাম-ই আ’যম হলেন শরীয়তে দুনিয়ার শোভা, শরীয়তের আলো এবং ইল্ম ও আমলের সৌন্দর্য (সাজসজ্জা)। ইমাম কারদারী বলেছেন, ‘‘এ হাদীস শরীফ দ্বারা ইমাম-ই আ’যম আবূ হানীফার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।’’
তিন. হযরত ইমাম-ই আ’যম ইসলামী দুনিয়ার ওই প্রথম আলিম-ই দ্বীন, যিনি ফিক্বহ্ ও ইজতিহাদের বুনিয়াদ রেখেছেন এবং এর মাধ্যমে রসূলে পাকের উম্মতের উপর বড় ইহসান করেছেন। অন্য সব ইমাম, যেমন- ইমাম শাফে‘ঈ, ইমাম মালিক, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল প্রমুখ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম এ ভিতের উপর ইমারত প্রতিষ্ঠা করেছেন। হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘‘ইসলামে যে ব্যক্তি উত্তম পন্থা আবিস্কার করবে সে নিজেরও সাওয়াব পাবে এবং তদনুযায়ী সব আমলকারীর সাওয়াবও পাবে।’’
চার. হযরত ইমাম-ই আ’যম সমস্ত ফক্বীহ্ ও মুহাদ্দিসের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ওস্তাদ। এসব হযরত ইমাম-ই আ’যমের শাগরিদ (শীষ্য)। সুতরাং ইমাম শাফে‘ঈ হলেন ইমাম মুহাম্মদ (আলায়হিমার রাহমাহ)’র সৎপুত্র ও তাঁর ছাত্র। অনুরূপ, ইমাম মালিক ইমাম-ই আ’যমের লিখিত কিতাবাদি পাঠ-পর্যালোচনা করে উপকৃত হয়েছেন। অনুরূপ ইমাম বোখারী মুহাদ্দিসগণের ওস্তাদ একথা সত্য; কিন্তু ইমাম বোখারীর বহু ওস্তাদ ও শায়খ হলেন হানাফী। জ্ঞানাকাশের সূর্য যেন ইমাম-ই আ’যম, আর অবশিষ্ট ইমাম ও আলিম হলেন তারকারাজি।
পাঁচ. ইমাম-ই আ’যমের প্রত্যক্ষ শাগরিদ এক লক্ষেরও বেশী। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ হলেন মুজতাহিদ। যেমন-ইমাম আবূ ইয়ূসুফ, ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম যোফর, ইমাম ইবনে মুবারক, যাঁরা হলেন জ্ঞান-জগতের উজ্জ্বল তারকারাজি। হযরত ইমাম মুহাম্মদ সাহেব নয়শ’ নব্বইটি দ্বীনী শানদার কিতাব প্রণয়ন করেছেন; ওইগুলোর মধ্যে ছয়টি কিতাব অতি উঁচু মানের। ওইগুলোকে ‘যা-হিরুর রেওয়াত কিতাবাদি’ বলা হয়। আর এগুলোকে ফিক্বহ শাস্ত্রের মূল কিতাব হিসেবে মানা হয়।
ছয়. সমস্ত নবীর সরদার হলেন চারজন নবী, আসমানী কিতাবগুলোর সরদার হচ্ছে চারটি কিতাব, ফেরেশতাদের সরদার হলেন চারজন, সাহাবা-ই কেরামের মধ্যে উত্তম ও উ”ুঁতম পর্যায়ের হলেন চার ইয়ার, মুজতাহিদ আলিমদের মধ্যে উত্তম হলেন চার ইমাম। বস্তুতঃ ওই চারজন নবীর মধ্যে হুযূর-ই আক্রাম হলেন সর্বাধিক মর্যাদাবান, চারটি কিতাবের মধ্যে উত্তম হচ্ছে ক্বোরআন-ই মজীদ, চার ফেরেশতার মধ্যে হযরত জিব্রাঈল উত্তম, চার ইয়ারের মধ্যে হযরত আবূ বকর উত্তম আর চারজন ইমামের মধ্যে সর্বোত্তম হলেন ইমাম-ই আ’যম। এ কারণে ইমাম শাফে‘ঈ বলেছেন, ‘ফক্বীহগণ হলেন ইমাম আ’যম-এর বংশধর’। আর তিনি হলেন সবার পিতা।
সাত. ইমাম-ই আ’যম যেমন ইল্ম বা জ্ঞানাকাশের সূর্য, তেমনি আমলের ময়দানের প্রধান ঘোড়-সাওয়ারও। তা হবেনও না কেন? তিনি দীর্ঘ চল্লিশ বছর যাবৎ এশার ওযূর দিয়ে ফজরের নামায পড়েছেন। দীর্ঘ চল্লিশ বছর এমন গোপনভাবে রোযা রেখেছেন যে, সে সম্পর্কে কেউ জানতো না। ঘর থেকে খাবার আনতেন। বের হয়ে ছাত্রদেরকে খাইয়ে দিতেন। ঘরের লোকেরা মনে করতেন তিনি বাইরে কোথাও খেয়েছেন। আর বাইরের লোকেরা মনে করতেন যে, তিনি ঘর থেকে খেয়ে এসেছেন। নিয়মিতভাবে রমযান মাসে একষট্টি খতম ক্বোরআন পড়তেন-এক খতম দিনে, এক খতম রাতে আর এক খতম পূর্ণ মাসে তারাবীহর নামাযে, মুক্বতাদীদের সাথে নিয়ে। তিনি পঞ্চান্ন বার হজ্ব করেছেন।
আট. ইমাম-ই আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মাযার শরীফ দো‘আ কবূল হবার জন্য কষ্টি পাথরতুল্য। সুতরাং ইমাম শাফে‘ঈ ক্বুদ্দিসা র্সিরুহু বলেন, ‘‘যখনই আমার সামনে কোন সমস্যা আসতো, তখন আমি ইরাক শরীফে ইমাম-ই আ’যমের মাযার শরীফে হাযির হতাম। সেখানে দু’ রাক‘আত নফল নামায পড়ে ইমাম-ই আ’যমের মাযার শরীফের বরকতকে ওসীলা করে দো‘আ করতাম। ফলে অতি শীঘ্রই দো‘আ কবূল হতো, সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো, চাহিদা পূরণ হতো। ইমাম শাফে‘ঈ যখন ইমাম-ই আ’যমের কবর-ই আন্ওয়ার-এ হাযির হতেন, তখন হানাফী মাযহাবানুসারে নামায পড়তেন, ক্বুনূত-ই নাযিলাহ্ পড়তেন না। কেউ জিজ্ঞাসা করলেন- এর কারণ কি? তদুত্তরে তিনি বলেন, ‘‘আমি এ মাযার শরীফে যিনি তাশরীফ রাখছেন তাঁর প্রতি সম্মান ও আদব প্রদর্শন করছি।’’ [ফাতাওয়া-ই শামী] স্মর্তব্য যে, এর অর্থ এ নয় যে, ইমাম শাফে‘ঈ ইরাকে এসে ইমাম-ই আ’যমের প্রতি আদব প্রদর্শন করতে গিয়ে সুন্নাত বর্জন করতেন; বরং অর্থ এ যে, কোন ইমাম কিংবা তাঁর অনুসারী নিশ্চয়তার সাথে এ দাবী করেন না যে, আমরাই একমাত্র সত্য ও সঠিক, অন্য ইমাম ও তাঁর মুক্বতাদীগণ ভুলের উপর আছেন; বরং প্রত্যেকের এ ধারণা রয়েছে যে, অন্য ইমামগণও সঠিক পথে আছেন। আক্বাইদের ব্যাপারে প্রত্যেকের ধারণা নিশ্চিত, আর ফিক্বহী মাসআসায় প্রত্যেকের ধারণার বেশীর ভাগ সঠিক হবার পক্ষে। সুতরাং ইমাম শাফে‘ঈও এখানে হাযির হয়ে এ ধারণা মতে আমল করেছেন। অর্থাৎ তিনি যেন একথা অবশ্যই মনে করেছেন যে, তাঁর ইজতিহাদ অনুসারে কোন সুন্নাত বর্জন করলেও ইমাম-ই আ’যমের ইজতিহাদ অনুযায়ী যা সুন্নাত, তা অনুসারে তো আমল হচ্ছে। সুতরাং এখানে আপত্তির অবকাশ নেই।
নয়. ইমাম-ই আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু একশবার মহামহিম রবকে স্বপ্নে দেখেছেন। সর্বশেষ বারে তিনি যে দো‘আটা মহান রবের দরবারে করেছিলেন, আর মহান রবও ও যে জবাব দিয়েছিলেন তা ‘রাদ্দুল মুহতার’ (শামী) কিতাবে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
দশ. উম্মতে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর বড় বড় ওলী, গাউস, ক্বুতব, আবদাল, আওতাদ হযরত ইমাম-ই আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু)’র দামনের সাথে সম্পৃক্ত, তাঁর মুক্বাল্লিদ। আল্লাহর যত সংখ্যক ওলী হানাফী মাযহাবে রয়েছেন, ততজন অন্য কোন মাযহাবে নেই। সুতরাং হযরত ইব্রাহীম ইবনে আদহাম, শাক্বীক্ব-ই বলখী, মা’রূফ-ই করখী, হযরত বায়েযীদ বোস্তামী, ফুদ্বায়ল ইবনে আয়াদ্ব খোরাসানী, দাঊদ ইবনে নাসর, ইবনে নাসীর ইবনে সুলায়মান তাঈ, আবূ ‘আমিদ লাফ্ফাফ খাযরাদী বলখী, খালাফ ইবনে আইয়্যূব আবদুল্লাহ্ ইবনে মুবারক ওলী, ফক্বীহ্ ও মুহাদ্দিস, হযরত ওয়াকী’ ইবনে জাররাহ্ এবং শায়খুল ইসলাম আবূ বকর ইবনে ওর্য়ারাক্ব তিরমিযীর মতো ওলীকুলের সরদারগণ হানাফী মাযহাবের অনুসারী; হযরত ইমাম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর আঁচলের সাথে সম্পৃক্ত। মোটকথা, হানাফী মাযহাব তো ওলীগণের মাযহাব। এখনো প্রায় সব ওলীয়ুল্লাহ্ হানাফী। পাক-ভারত উপমহাদেশের গর্ব হযরত দাতা গঞ্জে বখশ্ হাজভীরী, যাঁর আস্তানা শরীফ সৃষ্টির মিলনকেন্দ্র, হানাফী ছিলেন। আপন কিতাব ‘কাশ্ফুল মাহ্জূব’-এ তিনি ইমাম-ই আ’যমের বহু ফযীলত (গুণাবলী) কাশ্ফের মাধ্যমে উদ্ঘাটন করে উল্লেখ করেছেন। অনুরূপ, সমস্ত চিশতী, ক্বাদেরী, নক্বশ্বন্দী সোহ্রাওয়ার্দী মাশাইখ হানাফী।
এগার. হযরত ইমাম-ই আ’যমের মাযহাব-ই হানাফী বিশ্বে এত বেশী প্রসার লাভ করেছে যে, যেখানে ইসলাম আছে সেখানে হানাফী মাযহাব রয়েছে। বিশ্বের বেশীরভাগ মুসলমান হানাফী মাযহাবেরই অনুসারী, অন্য মাযহাবগুলো সম্পর্কে অনেক দেশের সাধারণ লোকেরা জানে না বললেও অত্যুক্তি হবে না। যেমন- বলখ, বোখারা, কাবুল, কান্দাহার, প্রায় গোটা ভারত ও পাকিস্তান এবং আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এসব দেশে ও শহরে শাফে‘ঈ, হাম্বলী ও মালেকী মাযহাবের অনুসারী দেখাই যায়না। কিছু সংখ্যক গায়র মুক্বাল্লিদ ওহাবী, যারা কোন দিকেরই নয়; ‘না ঘর কা, না ঘাট কা’, হয়তো কোথাও কোথাও দেখা যায়। তাদের সংখ্যা এতই নগণ্য যে, তাদের থাকা না থাকার মতোই। ইমাম-ই আ’যমের এমন গ্রহণযোগ্যতা থেকে বুঝা যায় যে, তিনি আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারেও মাক্ববূল এবং তাঁর প্রবর্বিত হানাফী মাযহাবও আল্লাহর দরবারে অত্যন্ত প্রিয়।
বার. ইমাম-ই আ’যমের মাযহাবের অনুসারী নয় এমন অনেকেও ইমাম-ই আ’যমের প্রশংসায় অনেক বড় বড় কিতাব লিখেছেন। সুতরাং আল্লামা ইবনে হাজর মক্কী ‘খায়রাতুল হিসান ফী তারজামাতি আবী হানীফাতান্ নু’মান’ লিখেছেন, সিব্ত্ব-ই ইবনে জাওযী ‘কিতাবুল ইন্তিসার লি ইমামি আইম্যাতিল আমসার’ দু’ খণ্ডে লিখেছেন, ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূত্বী শাফে‘ঈ ‘তাব্য়ীদ্বুস্ সহীফাহ্ ফী মানাক্বিবি আবী হানীফাহ্’ লিখেছেন, আল্লামা ইয়ূসুফ ইবনে আবদিল হাদী হাম্বলী, ‘তানভীরুস্ সহীফাহ্ ফী তারজামাতি আবী হানীফাহ্’ লিখেছেন, যাতে তিনি ইবনে আবদুল্লাহ্র অভিমতও উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন, আমি ইমাম আবূ হানীফার মতো আলিম, ফক্বীহ্, মুত্তাক্বী আর দেখিনি। মোটকথা, আল্লাহর দয়াপ্রাপ্ত উম্মত হযরত ইমাম আবূ হানীফা ক্বুদ্দিসা সিররুহুর ফযীলত ও কামাল (গুণ ও পূর্ণতা)’র পক্ষে সাক্ষী রয়েছেন। সুতরাং যদি মুষ্ঠি পরিমাণ লা-মাযহাবী ওহাবী তাঁর শানে প্রলাপ বকে, তাহলে তার কী গুরুত্ব থাকতে পারে? মোটেই না। যদি পেঁচক-বাদুড় সূর্যকে মন্দ বলে, তাহলে সূর্য কালো-অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে না। যেমন আজকাল রাফেযী (শিয়াগণ) সাহাবা-ই কেরামের বিরুদ্ধে তিরস্কার-বিষোদ্গার করে থাকে, তেমনিভাবে গায়র মুক্বাল্লিদ ওহাবীরা ইমাম-ই আ’যমের প্রতি বিষোদ্গার করার ধৃষ্ঠতা দেখায় বৈ-কি।
তের. সমস্ত মুজতাহিদ ইমামের মধ্যে হযরত ইমাম-ই আ’যম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর যুগ হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অধিকতর নিকটবর্তী। যেমন- তাঁর জন্ম হয় ৮০ হিজরীতে। তিনি ‘তাবে‘ঈ’। চারজন সাহাবী-ই রসূলের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে ও রেওয়ায়ত নিয়েছেন (হাদীস বর্ণনা করেছেন)। সুতরাং যাঁরা তাঁর তাবে‘ঈ হবার বিষয়টিকে অস্বীকার করেছে, তারা নিছক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই করেছে। এটা কিভাবে হতে পারে যে, সাইয়্যেদুনা হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আবূ আওফার মতো সাহাবী ইমাম-ই আ’যমের যুগে কূফায় তাশরীফ রাখছেন, আর হযরত ইমাম-ই আ’যম তাঁর সাক্ষাৎ করেননি? আজকাল তো বুযুর্গদের সাথে সাক্ষাতের জন্য সাধারণ মুসলমানগণ পর্যন্ত দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যায়, সাহাবী-ই রসূলের শান যে আরো অনেক উচুঁ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মোটকথা, তিনি তাবে‘ঈই। তিনি সহীহ্ হাদীসসমূহ হুযূর-ই আক্রাম থেকে সাহাবীর মাধ্যমেও পেয়েছেন। তিনি ইসলামের প্রথম তিন উত্তম যুগেরই।
প্রসঙ্গত চার ইমামের জন্ম ও ওফাতের তারিখ ও বয়স নিম্নরূপঃ
ইমামের নাম জন্ম সাল ওফাতের সাল বয়স মাযার শরীফ
ইমামে আ’যম আবূ হানীফা রাহিমাতুল্লাহি আলায়হি ৮০ হি. ১৫০ হি. ৭০ বছর বাগদাদ শরীফ
ইমাম মালিক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ৯০ হি. ১৭৯হি. ৮৯ বছর মদীনা শরীফ
ইমাম শাফে‘ঈ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ১৫০হি. ২০৪হি. ৫৪ বছর মিশর
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ১৬৪ হি. ২৪১হি. ৭৭ বছর বাগদাদ শরীফ
চৌদ্দ. হযরত ইমাম-ই আ’যম আলায়হির রাহমাহ্ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আহলে বায়ত থেকে খাস ফুয়ূয ও বরকত হাসিল করেন, যা অন্য কোন ইমাম অর্জন করতে পারেন নি। কেননা, ইমাম-ই আ’যম হযরত ইমাম জা’ফর সাদিক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মজলিস শরীফে দীর্ঘ দু’বছর যাবৎ হাযির থাকেন। তিনি নিজেই বলেন, لَوْلاَ الثَِنْتَانِ لَهَلَكَ الْنُّعْمَانُ অর্থাৎ যদি ওই দু’টি বছর পাওয়া না যেতো, তাহলে নু’মান অর্থাৎ আমি ধ্বংস হয়ে যেতাম।’’
পনর. হযরত ইমাম-ই আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পূর্ণ প্রকাশস্থল। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রথম খলীফা, আর ইমাম-ই আ’যম হুযূর-ই আক্রামের উম্মতের প্রথম মুজতাহিদ। হযরত সিদ্দীক্ব-ই আক্বার ক্বোরআনের জামি’ বা সংকলনকারী, আর ইমাম-ই আ’যম হলেন ‘জামি‘ই মাসাইল-ই ফিক্বহ্ ও ক্বাওয়া‘ইদ-ই দ্বীনিয়্যাহ্’ (ফিক্বহ্ শাস্ত্রের মাসআলাদি ও দ্বীনের মৌলিক নিয়মাবলীর সংকলনকারী)। হযরত সিদ্দীক্ব-ই আকবার হুযূর-ই আক্রামের পর সর্বপ্রথম ন্যায় বিচারের নিয়মাবলী ও খিলাফতের বুনিয়াদ স্থাপন করেছেন, আর ইমাম-ই আ’যম ইজতিহাদ ও ফিক্বহর বুনিয়াদ স্থাপন করেছেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব হুযূর-ই আক্রামের উম্মতকে যথাসময়ে সাহায্য করেছেন, তাদেরকে মতভেদ ও বিক্ষিপ্ততার হাত থেকে রক্ষা করেছেন, আর ইমাম-ই আ’যম মুসলমানদের এত বড় সাহায্য করেছেন যে, তাদেরকে কুফর, ইলহাদ ও যান্দাক্বাহ্ (যথাক্রমে, কুফরী, ইসলামের মুখোশ পরে ইসলামের বিরোধিতা ও মুনাফিক্বী)-এর ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষা করেছেন। আজ তাঁরই জ্ঞানগত ইজতিহাদের বরকতে মুসলিম উম্মাহ্ কাফির ও মুরতাদ্দ্দের ফিৎনাদি থেকে রক্ষা পেয়েছে।
ষোল. হুযূর গাউসে আ’যম হযরত শায়খ আবদুল ক্বাদির জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যেমন আল্লাহর সমস্ত ওলীর সরদার, সবার গর্দানের উপর তাঁর কদম শরীফ রয়েছে, সুতরাং তিনি ত্বরীক্বতের প্রধান ইমাম, তেমনি ইমাম-ই আ’যম সমস্ত আলিমের সরদার। এজন্য তরীক্বতের ‘প্রধান ইমাম’-এর উপাধি যেমন ‘গাউসে আ’যম’ তেমনি শরীয়তের প্রধান ইমামের উপাধি ‘ইমাম-ই আ’যম’। সুবহা-নাল্লাহ্।
অতএব, এসব বৈশিষ্ট্য ও স্বতন্ত্র গুণাবলীর কারণে হযরত আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শ্রেষ্ঠত্বই প্রমাণিত হয়। ইমাম-ই আ’যম যেমন শ্রেষ্ঠ, তাঁর মাযহাব (হানাফী মাযহাব)ও শ্রেষ্ঠতম। এর বহুবিধ কারণও রয়েছে। বস্তুতঃ আমাদের হানাফী মাযহাবের একেকটি মাস্আলার উপর একেকটা স্বতন্ত্র বড় পরিসরের কিতাব লেখা যায়, যার পক্ষে দলীলাদিও প্রচুর। মাযহাবের প্রত্যেক ইমামের উদ্দেশ্যও হচ্ছে, শরীয়তকে জীবন্ত রাখা; প্রত্যেক ইমাম নিজ নিজ ইল্ম, বুঝশক্তি ও গবেষণা অনুসারে মাসআলা-মাসাইল লিখেছেন। তবে বাস্তবিক পক্ষে ইমাম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর দলীলাদি প্রথম কাতারে পরিদৃষ্ট হয়। প্রতিটি বিষয়ে তিনিই অগ্রগামী বলে প্রমাণিত। তাঁর জ্ঞান তাঁদের মধ্যে ব্যাপকতম বলে সাব্যস্ত হয়। তাঁর বর্ণিত মাসআলাগুলোই প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ, দ্বীনী ইলমকে যদি ‘দেহ্’ কল্পনা করা হয়, তবে ইমাম আবূ হানীফা আলায়হির রাহমাহ্র ইলমকে বলতে হয় পূর্ণাঙ্গ দেহ, আর অন্যান্য ইমামের ইল্ম হবে দেহের কোন না কোন অঙ্গ মাত্র। অন্য সব ইমামকে যদি চোখের সাথে তুলনা করা হয়, তবে ইমাম-ই আ’যমকে বলতে হবে ওই চোখের মণি। যদি শরীয়তের সমস্ত ইমামকে হাতের পাঞ্জার সাথে তুলনা করা হয়, তবে ইমাম-ই আ’যমকে বলতে হয় ওই পাঞ্জার বৃদ্ধাঙ্গুলী। তাঁরা যদি শরীয়তের জিহবা (রসনা) হন, তাহলে ইমাম-ই আ’যম হবেন ওই রসনার বাক্শক্তি। অন্য ইমামগণ যদি হৃদয় (ক্বলব) হন, তবে ইমাম-ই আ’যম হবেন ওই হৃদয়ের স্পন্দন। অন্য সব ইমাম যদি ফুলের মালা হন, তবে আমাদের ইমাম-ই আ’যম হবেন ওই মালার সুতা। রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ওয়া আনহুম।
এটাই নিয়ম যে, প্রত্যেক বিষয়ে একজন প্রধান হন। আর দ্বীনী ইলম তথা ফিক্বহ্ শাস্ত্রের ‘প্রধান’ হলেন ইমাম-ই আ’যম আবূ হানীফা। তিনি হলেন সমস্ত ইলমে দ্বীনের মোহনা (আধার),ফিক্বহ শাস্ত্রের মূল ব্যক্তি। তা হবেনও না কেন? তিনি তো ইল্মের কোলে লালিত, ইলমের দোলনায় দোল খেয়েছেন, ইলমের দুধ পান করেছেন, আল্লাহ্ তা‘আলার প্রদত্ত অসংখ্য নি’মাত পেয়ে ধন্য হয়েছেন, যুবক হয়েছেন রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসের অসাধারণ জ্ঞানরূপ খাদ্য আহার করে। সমস্ত ইমাম ইমাম-ই আ’যম থেকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে উপকৃত হয়েছেন।
[মাক্বামাতে ইমাম-ই আ’যম, কৃত. ইমাম হাফেয উদ্দীন ক্বাদেরী আলায়হির রাহমাহ্ ও ‘জা-আল হক্ব’ দ্বিতীয় খণ্ড ইত্যাদি]
হানাফী মাযহাবের প্রাধান্য
হানাফী ফিক্বহর প্রাধান্যসূচক বৈশিষ্ট্য অনেক। তন্মধ্যে কয়েকটা নিম্নরূপ –
এক. হানাফী ফিক্বহ্ ও হানাফী মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গি এ ছিলো যে, এটা শুধু সমসাময়িক সমস্যার সমাধান স্থির করবে না; বরং যেসব সমস্যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত আসতে পারে ওইগুলোর সমাধানও বের করবে। পক্ষান্তরে, ওই যুগের অন্যান্য ফক্বীহ্ ও মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিভঙ্গি এ ছিলো যে, তাঁরা শুধু ওই সমস্ত মাসাইল বা সমস্যার সমাধান বের করবেন, যা সামনে এসে গেছে। হানাফী মাযহাবের এটা এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
দুই. হানাফী ফিক্বহ্ প্রবর্তনের জন্য ইমাম-ই আ’যম নিজের সাথে ফক্বীহ্গণের এক বিরাট দলকেও সামিল করে নিয়েছেন। এর প্রাথমিক রূপরেখা প্রণয়নে এমন চল্লিশজন বিজ্ঞ আলিমের নাম রয়েছে, যাঁরা তাঁদের যুগের বড় বড় মুহাদ্দিস, বরং মুজতাহিদ ছিলেন এবং ইমাম আহমদ, ইমাম বোখারী, ইমাম মুসলিম এবং অন্যান্য শায়খগণের শায়খ এবং উস্তাদগণের ওস্তাদ ছিলেন। এজন্যই কথিত আছে যে, যদি সিহাহ্ সিত্তাহ্ এবং অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীস শরীফের কিতাবাদি থেকে ইমাম-ই আ’যমের শাগরিদদের সনদের হাদীসসমূহ পৃথক করে ফেলা হয়, তবে বাকী অংশ শূন্যের কোঠায় রয়ে যাবে।
তিন. হানাফী মাযহাবের অধিকাংশ শাখা-মাসাইল হাদীস শরীফের অধীনে উদ্ভাবিত হয়; অথচ অন্যান্য মাযহাবে অনেক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এজন্য হানাফী মাযহাব বেশী গতিশীল ও অধিক সমাদৃত। এজন্যই শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিসগণ তাঁদেরই মতামতের আলোকে ফাত্ওয়া প্রণয়ন করেছেন এবং তাঁদের ফিক্বহ্র সত্যায়ন করেছেন। আল্লামা কারদারী তাঁর ‘মানাক্বিব’ নামক গ্রন্থে আল্লামা ইবনে জুরাইজের বাণী উল্লেখ করেছেন- مَا اَفْتى الاِمَامُ اِلاَّ مِنْ اَصْلٍ مُحْكَمٍ (অর্থাৎ ইমামে আ’যমের প্রত্যেকটা মাস্‘আলা তথা ফাত্ওয়া একেকটা শক্ত নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত)।
চার. হানাফী ফিক্বহ্ থেকে অন্যান্য মাযহাবের ফিক্বহ্ সাহায্য নিয়েছে। ‘বুলূগুল আমানী’তে এ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম শাফে‘ঈর বাণীগুলোতে এর সমর্থন পাওয়া যায়।
পাঁচ. হানাফী ফিক্বহ্ আলিম-ওলামা, ইসলামী সুলতানগণ এবং সাধারণ মুসলমানদের নিকট অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য; কারণ এটা পূর্ণাঙ্গ ও বিজ্ঞানসম্মত। তদনুযায়ী আমল করাও সহজতর। এতে মূল নীতিমালার সাথে সাথে শাখা-মাস্আলাগুলোর বিবরণ সর্বাপেক্ষা বেশী। হানাফী ফিক্বহে যুগের চাহিদাগুলোর সমাধান যেমন বিদ্যমান, তেমনি নিত্য-নতুন আবিষ্কারগুলোর ব্যাপারেও শরীয়তের ফয়সালাদি স্থান পেয়েছে। এসব কারণে সূচনালগ্ন থেকেই এ ফিক্বহ্ বিশ্বের প্রায়সব দেশে কার্যকর হয়েছে ও বিস্তার লাভ করেছে।
পরিশেষে, পবিত্র ক্বোরআনের তাফসীর, হাদীস-ই রসূল সম্পর্কে অসাধারণ জ্ঞান, দ্বীন ও শরীয়তের যাবতীয় বিষয়ে খোদাপ্রদত্ত নির্ভুল ও অনন্য ‘তাফাক্বুক্বুহ্’ (অনুধাবন-ক্ষমতা) , শরীয়তের সমসাময়িক ও ভবিষ্যতে উদ্ভূত সমস্যাদির নির্ভুল ও সহজ সমাধান প্রদানের সুদূর প্রসারী দিকনিদের্শনা ও ব্যবস্থাপনা এবং ব্যক্তিগতভাবে অকৃত্রিম ও অসাধারণ তাক্বওয়া-পরহেযগারী ইত্যাদি কারণে হযরত আবূ ইমাম হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যেমন ‘ইমাম-ই আ’যম, তেমনি তাঁর ফিক্বহ্ ও মাযহাব (হানাফী মাযহাব) হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ মাযহাব। বিশ্বের বেশীর ভাগ মুসলমান তাই হানাফী মাযহাবের অনুসারী। সর্বোপরি, সবচেয়ে বেশী সংখ্যক সুদক্ষ আলিম-ওলামা এবং পীর-মাশাইখও হানাফী মাযহাবের অনুসারী হওয়া একথার প্রকৃষ্ট প্রমাণ যে, ইমাম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এবং হানাফী মাযহাবই শ্রেষ্ঠতম। এতদ্সত্ত্বেও যদি কোন অবিবেচক, মূর্খ, অকৃতজ্ঞ, বাতিলপন্থী ও ফিৎনাবাজ লোক কিংবা দল ইমাম-ই আ’যম ও হানাফী মাযহাবের বিপক্ষে কথা বলে, তবে তা হবে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যানযোগ্য। কারণ, এ ক্ষেত্রে সুখের বিষয় যে, একদিকে শরীয়তে ইমাম আবূ হানীফা ও হানাফী মাযহাবের অনুসারী ইমামদের ফয়সালা দলীলগত ও যুক্তিগত দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ ও মজবুত বলে প্রমাণিত হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি যে কোন বাতিলপন্থী যে কোন অপবাদই ইমাম-ই আ’যম ও হানাফী মাযহাবের বিরুদ্ধে দিয়েছে সব ক’টির দাতভাঙ্গা জবাবও দেওয়া হয়েছে হানাফী মাযহাবের দক্ষ অনুসারীদের পক্ষ থেকে। এ ক্ষুদ্র পরিসরে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবুও উদাহরণ স্বরূপ সংক্ষেপে বলা যায়ঃ যেমন- তাকবীর-ই তাহরীমাহ্র সময় কান পর্যন্ত হাত তুলে নাভীর নিচে হাত বাঁধার পক্ষে ইমাম আ’যম মত দিয়েছেন। হানাফীরা তা-ই করে থাকেন। কিন্তু যারা কাঁধ পর্যন্ত হাত তুলে নাভীর উপরে বুকের উপর মেয়েদের মতো হাত বাঁধার কথা বলে, তাদের দলীল-যুক্তি ইমাম-ই আ’যমের উপস্থাপিত যুক্তি-প্রমাণের সাথে তুলনামূলক আলোচনা করলে হানাফী মাযহাবের দলীলগুলো বেশী মজবুত ও গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়। এ ধরনের অন্যান্য মাসআলাগুলোতেও হানাফী মাযহাবের প্রাধান্য ‘তাহাভী শরীফ’, আইনী শরহে বোখারী ইত্যাদি হানাফী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য ও প্রসিদ্ধ কিতাবগুলো পাঠ-পর্যালোচনা করলে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। এগুলো হলো ফিক্বহী মাসআলা-মাসাইলের বিষয়।
বাকী রইলো, বাতিলপন্থীদের নানা অপবাদ। যেমন- তিনি তাবে‘ঈ ছিলেন কিনা, তিনি দ্ব‘ইফ হাদীস ও যুক্তিকে প্রাধান্য দিতেন কিনা? ইমাম-ই আ’যম থেকে সহীহ্ হাদীসগুলো ইমাম বোখারী নেন নি কেন? ইত্যাদি। বস্তুতঃ তাদের এসব আপত্তিকে ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রমাণ করা হয়েছে। যেমন, ইমাম-ই আ’যম যে তাবে‘ঈ ছিলেন তার অকাট্য প্রমাণ দেওয়া হয়েছে। ইমাম-ই আ’যম যেহেতু তাবে‘ঈ ছিলেন, সেহেতু শুধু একজন বা দু’জন বর্ণনাকারীর মাধ্যমে (সূত্রে) হুযূর-ই আক্রামের অগণিত সহীহ্ হাদীস তিনি সংগ্রহ করেছেন। তাঁর উপস্থাপিত কোন সহীহ্ হাদীস পরবর্তী যুগগুলোতে দুর্বল (দ্ব‘ঈফ) হলে তাতো তাঁর পরবর্তী যুগের কোন ‘রাভী’ বা বর্ণনাকারীর কারণে হয়েছে। তজ্জন্য ইমাম-ই আ’যম দায়ী নন। তাছাড়া, বোখারী ও মুসলিম ব্যতীত সহীহ্ হাদীসের বিভিন্ন কারণে। যেমন- কিতাবাদিও বিশ্বে কম নয়। ইমাম বোখারী ইমাম-ই আ’যম থেকে হাদীস গ্রহণ না করলে, তাও ছিলো ইমাম বোখারী নিজেই লিখেছেন, ‘‘আমি আমার কিতাব ‘সহীহ্’তে হাদীসসমূহ শুধু ওইসব হযরত থেকে নিয়েছি, যাঁদের জ্ঞানগত অভিমত হলো-‘ঈমান হচ্ছে মুখের স্বীকৃতি ও আমলের সংমিশ্রমণ (মুরাক্কাব)-এর নাম।’ আর ইমাম-ই আ’যম বলেন, ঈমান হচ্ছে ‘বসীত্ব’ মুরাককাব নয়। ঈমানের মূল হচ্ছে- ‘অন্তরের বিশ্বাস ও সত্যায়ন’, ‘মুখের ঘোষণা’ হচ্ছে মু’মিনের বাহ্যিক পরিচয় এবং ‘আমল’ হচ্ছে ঈমানের শোভা ও অধিক প্রতিদান পাবার উপায়। সুতরাং এ ইজতিহাদগত মতবিরোধের কারণে হয়তো ইমাম বোখারী ইমাম-ই আ’যমের রেওয়ায়ত নেননি, ইত্যাদি। এটা যেমন ইমামে আ’যমের হাদীসের নির্ভুল ও অসাধারণ জ্ঞানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, তেমনি কেউ কারো নিকট থেকে হাদীস গ্রহণ না করলে কোন মুহাদ্দিস বা হাদীস গ্রহণের মর্যাদাও হ্রাস পাবার কথা নয়। যেমন-ইমাম মুসলিমও ইমাম বোখারী থেকে কোন হাদীস নেননি। তাই বলে বোখারী শরীফের বিরুদ্ধে অগ্রহণযোগ্যতার অপবাদ দেওয়া যাবে না। এভাবে ইমাম বোখারী ইমাম শাফে‘ঈ ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুমুল্লাহ্ থেকেও হাদীস নেন নি। তাই বলে কি ওই দু’মহান ইমামের বিপক্ষে কোন আপত্তি করা যাবে? মোটেই না। আর ইমাম-ই আ’যমের বিপক্ষে ‘তিনি ক্বিয়াস বা যুক্তিকে প্রাধান্য দিতেন’ মর্মে দেয় অপবাদও ভিত্তিহীন। বস্তুতঃ তিনি কোন সহীহ্ হাদীসকে বাদ দিয়ে কিংবা সহীহ্ হাদীসের উপর ক্বিয়াসকে প্রাধান্য দিয়ে মাসআলা বের করেন নি; বরং শরীয়তে ‘ক্বিয়াস-ই শর‘ঈ’ (শরীয়ত সমর্থিত ক্বিয়াস)-এর গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি এর পক্ষে যেমন যথেষ্ট পরিমাণ দলীল-প্রমাণ দিয়েছেন, তেমনি প্রয়োজনে ক্বিয়াস-ই শর‘ঈর ভিত্তিতে মাসআলাও অনুমান করেছেন। তিনি এর পক্ষে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, ক্বিয়াস-ই শর‘ঈতো খোদ্ পবিত্র ক্বোরআনসম্মত। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন-فَاعْتَبِرُوْا يَااُولىِ الْاَبْصَارِ (হে বিবেকবানগণ, শিক্ষা গ্রহণ করো!) এখানে اعتبار (فاعتبروا) মানে ক্বিয়াস-ই শর‘ঈ। এভাবে বহু আয়াত ও বহু সহীহ্ হাদীস (যেমন হাদীস-ই মু‘আয ইবনে জাবাল)ও এর পক্ষে প্রমাণ বহন করে। অতএব, ইমাম-ই আ’যম যেমনিভাবে আল্লাহ্, তাঁর রসূল এবং বিশ্ব মুসলিমের নিকট মাক্ববূল, তেমনি হানাফীরাও অত্যন্ত ভাগ্যবান।
[সূত্র. মাক্বামাত-ই ইমাম-ই আ’যম, জা-আল হক্ব, ২য় খন্ড, ইমাম আবূ হানীফা আওর উনকে নাক্বিদীন ইত্যাদি]