আক্বীদার বিশুদ্ধতার সাথে আমল ও সচ্চরিত্রের গুরুত্ব
হাফেজ মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান
আল্লাহর কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসায় বিন¤্র হই, যিনি আমাদের বিশুদ্ধ আক্বীদা, গ্রহণযোগ্য নেক আমল ও প্রশংসনীয় চরিত্র শেখানোর জন্য তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন। তাঁর প্রিয় হাবীবের প্রতি অসংখ্য দুরূদ ও সালাম, যিনি আমাদেরকে বিশুদ্ধ আক্বীদা-বিশ্বাসের স্বরূপ ও আমল-আখলাক্বের তা’লীম দিয়েছেন। তাঁর অযুত সাহাবা ও তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরী অসংখ্য ওলি-আওতাদ, সর্বোপরি তাঁর আহ্লে বায়ত ও পূণ্যাত্মা আওলাদের প্রতি সকৃতজ্ঞ সালাম ও শ্রদ্ধা নিবেদন করি, যাঁরা নক্ষত্রের জ্যোতি হয়ে, হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম-এর মুক্তির তরণীর মত অবলম্বন হয়ে ধ্বংসের হাত থেকে এ উম্মতকে রক্ষা করেছেন। বিশেষতঃ ‘কাশ্তিয়ে নূহ’ জামেয়ার প্রতিষ্ঠাতা ক্বুত্ব্বুল আউলিয়া, আল-ই রাসূল হাফেয ক্বারী আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি, তাঁর যোগ্য সন্তান গাউসিয়া কমিটির মহান প্রতিষ্ঠাতা, জশনে জুলূস-এ ঈদ-এ মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রবক্তা, গাউসে যমান হাফেয ক্বারী আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এবং বর্তমান সাজ্জাদানশীন আল্লামা শাহ্সুফী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মুদ্দাযিল্লুহুল আলী)’র চরণে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করি। সর্বোপরি পীরে বাঙ্গাল আল-ই রসূল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবির শাহ্ (মুদ্দাযিল্লুহুল আলী)’র খেদমতে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে অশেষ কৃতজ্ঞতা, যিনি গাউসিয়া কমিটিসহ সকল পীরভাইদের জন্য গাউসিয়া তরবিয়াতী নিসাব প্রণয়ন, বাস্তব ও যুগোপযোগী ব্যবহারিক প্রয়োগের লক্ষ্যে ‘দাওরাহ-ই দাওয়াত-ই খায়র’র মত মহান কর্মসূচীর বলিষ্ঠ নির্দেশনা দিয়ে সংশ্লিষ্ট ভাইদের মহান কাজে সম্পৃক্ত করে অপরিমেয় করুণায় ঋণী করেছেন।
গাউসিয়া কমিটির এ মহান কর্মসূচী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপ’র প্রথম প্রশিক্ষণ কর্মশালায় প্রশিক্ষণার্থী ভাইদের জন্য প্রণীত সিলেবাসে নির্ধারিত একটি বিষয় প্রস্তাবিত শিরোণমটি। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন পবিত্র ক্বোরআনের শরুতে মানব জীবনের সাফল্যের মাপকাঠি তাক্বওয়ার স্বরূপ বর্ণনায় এরশাদ করেছেন,
الم ﴿١﴾ ذلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ ۖ فِيهِ ج هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ ﴿٢﴾ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُوْنَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ ﴿٣﴾ وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ ج وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ ﴿٤﴾ أُولَـٰئِكَ عَلَىٰ هُدًى مِّن رَّبِّهِمْ ق وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ﴿٥﴾
অর্থাৎ ‘‘সেই উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন কিতাব (ক্বোরআন), যাতে নেই সন্দেহের কোন অবকাশ মাত্র, (এটি) তাক্বওয়াবানদের জন্য হিদায়ত; যাঁরা না দেখেও বিশ্বাস করে, নামায ক্বায়েম রাখে, আমি তাদেরকে যা কিছু দিয়েছি, তা থেকে (আমার পথে) ব্যয় করে আর যারা ঈমান আনে সেই কিতাবের প্রতি, যা আপনার প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যা আপনার আগে নাযিল করা হয়েছে। আর আখিরাতের প্রতি তারা বিশেষ ইয়াক্বীন (দৃঢ় বিশ্বাস) রাখে। তারা নিজ পালনকর্তার পক্ষ থেকে হিদায়তের ওপর প্রতিষ্ঠিত, আর তারাই তো (উভয় জগতে) সফলকাম।
এখানে লক্ষণীয় যে, তিন বিষয়ের অবতারণা হয়েছে এ আয়াতগুলোতে, যা আলোচ্য বিষয়বস্তুর প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। যথা- ১. ঈমান (আক্বীদার বিশুদ্ধতা), ২. নামায প্রতিষ্ঠা (আমলের গুরুত্ব) এবং ৩. তাক্বওয়া (যা ইমান আমল ও আখলাক্বের সমন্বিতরূপ)। আয়াতে উল্লিখিত ‘ঈমান’ প্রসঙ্গে কান্যুল ঈমান’র হাশিয়া (পাদটীকা)’য় আছে, ‘যে সমস্ত বিষয় সম্পর্কে হিদায়ত ও ইয়াক্বীন সহকারে চূড়ান্তভাবে একথা সাব্যস্ত হয় যে, সেগুলো ‘দ্বীন-এ মুহাম্মদী’র অন্তর্ভুক্ত, যে সমস্ত বিষয়কে মেনে নেয়া, অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা এবং মুখে স্বীকার করার নামই প্রকৃত ঈমান। আমল ইমানের অন্তর্ভুক্ত নয়। এ জন্যই ঈমান’র পরেই সালাত’র কথা এরশাদ হয়েছে। আরো লক্ষণীয় যে, আক্বীদা-বিশ্বাস, আমল ও আখলাক্ব’র নির্দেশনা সম্বলিত হিদায়তের কিতাবে যা বর্ণিত হয়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের স্থান নেই। ‘লা-রায়বা ফী-হি’ বলে কিতাবের প্রতি আক্বীদা-বিশ্বাসকে মজবুত করে নেয়ার প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ইয্যাত ইরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا آمِنُوا بِاللهِ وَرَسُوْلِهٖ وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلٰى رَسُولِهٖ وَالْكِتَابِ الَّذِي أَنزَلَ مِن قَبْلُ ط وَمَنْ يَكْفُرْ بِاللهِ وَمَلَآئِكَتِهٖ وَكُتُبِهٖ وَرُسُلِهٖ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا ﴿١٣٦﴾
তরজমা: ‘‘হে ঈমানদারগণ, ঈমান রাখো আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের ওপর এবং ওই কিতাবের ওপর, যা তিনি স্বীয় রাসূলের ওপর, অবতীর্ণ করেছেন আর ওই কিতাবের উপরও যা এর পূর্বে অবতীর্ণ করেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রসূলগণও আখিরাতের দিনকে অমান্য করে, সে দূরবর্তী ভ্রষ্টতায় দিকভ্রষ্ট হয়েছে।
শান-এ নুযূল
হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বলেছেন, এ আয়াত আবদুল্লাহ্ ইবনে সালাম, আসাদ, উসাইদ, সা’লাবাহ্ ইবনে ক্বায়স, সালাম, সালমাহ্ এবং ইয়ামীনের প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে। তাঁরা ছিলেন আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ঈমানদার। একদিন তাঁরা রসূল-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে হাযির হয়ে আরয করলেন, ‘আমরা আপনার ওপর এবং আপনার কিতাবের ওপর, হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর তাওরীতের ওপর এবং ওযায়র আলায়হিস্ সালাম-এর ওপর ঈমান আনছি; কিন্তু এগুলো ছাড়া অন্যান্য কিতাব ও রসূলগণের ওপর ইমান আনতে পারব না।’ তখন আল্লাহ্র রসূল তাঁদেরকে বললেন, ‘‘তোমরা আল্লাহ্র ওপর ও তাঁর রসূল মুহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র ওপর, তাঁর গ্রন্থ ক্বোরআন মজীদ ও তৎপরবর্তী প্রত্যেক কিতাবের ওপর ঈমান আনো।’’ তখন তাঁর এ আহ্বানের সমর্থনে উক্ত আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে।
এ সম্বোধনে যদি ঈমানদার সাহাবীগণকে নির্দেশ করা হয়, তবে অর্থ হবে, তোমরা এ বিশুদ্ধ আক্বীদার ওপর অটল ও মজবুত থাকো। যদি আহলে কিতাব সম্প্রদায়কে বলা হয়, তবে অর্থ হবে, ‘‘তোমরা কোন বিশেষ রসূল বা বিশেষ কিতাব নয়; বরং সকল নবী ও রসূল এবং সকল আসমানী কিতাবকে সত্য বলে মেনে নাও। (নচেৎ তোমাদের আক্বীদা বিশুদ্ধ হবে না।)’’ আর যদি মুনাফিক্বদেরকে সম্বোধন করা হয়, তবে অর্থ হবে, ‘বাহ্যিক বা মৌখিক দাবী নয়, তোমরা সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করে আক্বীদা বিশুদ্ধ করে নাও।’’ এখানে এ পর্যন্ত স্পষ্ট করা হয়েছে যে, ‘কোন একজন রসূল এবং একটি মাত্র কিতাবকে অমান্য করাও সব ক’টিকে অমান্য করার শামিল।’ [প্রাগুক্ত] এ আয়াতের আলোকে এ কথা প্রমাণিত হল যে, সামগ্রিক আমল গ্রহণযোগ্য হবার পূর্বে আক্বীদা-বিশ্বাসের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। ‘আক্বীদা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ-এমন কথা, যাতে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা যায়, যাকে মানুষ নিজের ধর্ম-বিশ্বাস হিসাবে গ্রহণ করে এবং যার ওপর নিশ্চিতভাবে আস্থা রাখে। এটি ঈমান, ইয়াক্বীন ও তাসদীক্ব প্রভৃতি শব্দের সমার্থক। মোটকথা, ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিশব্দ ‘আক্বীদা’-এর বহুবচন ‘আক্বা-ঈদ।’ ঈমান’র আভিধানিক অর্থ التصديق بالقلب অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা।
শরয়ীতের পরিভাষায়, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) যা কিছু নিয়ে তাশরীফ এনেছেন, সবকিছুর প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস করা, সবকিছু সত্য বলে মেনে নেয়ার নাম ঈমান। ক্বোরআন মজীদে যে সব আয়াতে আমলের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলোতে আমলের সাথে বিশুদ্ধ আক্বীদা তথা ঈমানের অপরিহার্যতা শর্তের মত সংযোজিত রয়েছে। তেমন কয়েকটি আয়াত প্রামাণ্য রূপে স্বর্তব্য। ঈমান ও নেক আমলবিহীন মানবজীবন ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত। পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে,
وَالْعَصْرِ ﴿١﴾ إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ ﴿٢﴾ إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ ﴿٣﴾
তরজমা: ‘‘ওই মাহবুবের যুগের শপথ, নিঃসন্দেহে মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত, কিন্তু (তারা ছাড়া), যারা ঈমান এনেছে ও নেক আমল করেছে আর পরস্পরের হকের সহায়তা করেছে এবং একে অপরকে ধৈর্যের সদুপদেশ দিয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে-
وَمَن يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ مِن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَـٰئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ نَقِيرًا ﴿١٢٤﴾
তরজমা: ‘‘পুরুষ বা নারী যা কিছু নেক আমল (সৎ কাজ) করবে, যদি ঈমানদার হয়, তবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাদেরকে অণু পরিমাণও প্রতিদান বঞ্চিত করা হবে না।
এখানে নেক কাজের প্রতিদানের জন্য বিশুদ্ধ আক্বীদা-বিশ্বাস অপরিহার্য করা হয়েছে।
এরশাদ হয়েছে-
مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثٰى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةًج وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُم بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ﴿٩٧﴾
তরজমা: ‘‘যে ব্যক্তি নেক আমল করে, হোক সে পুরুষ কিংবা নারী, সে ঈমানদার হলে অবশ্যই আমি তাকে এক পবিত্র জীবন দানে ধন্য করবো। আর আমি তাদেরকে প্রতিদান দেবো তাদের আমলের চেয়েও অধিকতর সুন্দর।’’
পরকালের উত্তম জীবন লাভের মত আমলের পূর্বশর্ত বিশুদ্ধ আক্বীদা-বিশ্বাস। ঈমানদারের নেক আমল ও প্রচেষ্টা বিফল হয় না। আল্লাহ তার প্রতিদান অবশ্যই সংরক্ষণ করেন। এ মর্মে এরশাদ হয়েছে-
فَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَا كُفْرَانَ لِسَعْيِهِ وَإِنَّا لَهُ كَاتِبُونَ ﴿٩٤﴾
অর্থাৎ ‘‘যে ব্যক্তি কোন নেক আমল ওই অবস্থায় সম্পাদন করে যে, তার প্রচেষ্টার অস্বীকৃতি নেই আর নিশ্চিতভাবে আমি অবশ্যই তা লিপিবদ্ধকারী।
মানুষের কর্মফল বিনষ্ট না হয়ে সংরক্ষিত থাকার জন্য বিশুদ্ধ আক্বীদার ভিত্তিতে করা জরুরী, অন্যথায় তার প্রতিদান বিফলে যাবে। বদ-আক্বীদা সম্পন্ন ব্যক্তির আমল পরকালে কোন কাজে আসবে না।
ঈমান-আক্বীদা বিশুদ্ধ না হলে যত মহৎ কাজই মানুষ করুক না কেন আল্লাহ্ ও রসূল তা পুণ্য কাজ হিসাবে গণ্য করেন না, শরীয়তে তা নেক আমল হিসাবে বিবেচিত হয় না। এমনকি পৃথিবী ভর্তি স্বর্ণ তার মুক্তিপণ স্বরূপ দেয়া হলেও তা গ্রহণ করা হবে না। যেমন- আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন-
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَمَاتُوا وَهُمْ كُفَّارٌ فَلَن يُقْبَلَ مِنْ أَحَدِهِم مِّلْءُ الْأَرْضِ ذَهَبًا وَلَوِ افْتَدَىٰ بِهِ ط أُولَـٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ وَمَا لَهُم مِّن نَّاصِرِينَ ﴿٩١﴾
অর্থাৎ ওইসব লোক, যারা কুফরী করেছে এবং যারা মৃত্যুবরণ করেছে কাফির অবস্থায় তাদের মধ্যে কারো পক্ষ থেকে পৃথিবী ভর্তি স্বর্ণও কখনো কবুল করা হবে না, যদিও তারা তা নিজেদের মুক্তির জন্য ফিদ্ইয়া (মুক্তিপণ) দেয়। তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি, তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।
عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِى اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ صَامَ رَمَضَانَ اِيْمَانًا وَّ اِحْتِسَابًا غُفِرَلَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه وَمَنْ قَامَ رَمَضَانَ اِيْمَانًا وَّاِحْتِسَابًا غُفِرَلَهٗ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه وَمِنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ اِيْمَانًا وَّاِحْتِسَابًا غُفِرَلَهٗ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه [مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ] অর্থাৎ হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহ্র রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘‘যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে প্রতিদান প্রত্যাশায় মাহে রমযানের রোযা রাখে, তার পূর্বেকার গুনাহ্সমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি রমযান মাসে ঈমান ও দৃঢ় প্রত্যাশায় (তারাভীহর) নামাযে দাঁড়ায়, তার অতীতের পাপসমূহ মার্জনা করা হয়। আর যে ব্যক্তি পুণ্যের আশায় ক্বদরের রাতে নামাযে দাঁড়ায়, (রাত্রি জাগরণ করে ইবাদত বন্দেগী করে) তার অতীতের পাপরাশি ক্ষমা করা হয়।
এখানে রোযা ও নামাযের প্রতিদান পেতে ঈমান-বিশ্বাসের শর্ত আরোপিত হয়েছে।
ইসলামের দাওয়াত বা প্রচারের ক্ষেত্রেও দেখা যায় আমলের পূর্বে আক্বীদা বিশ্বাসের বিষয়টি উত্থাপিত হয়, কারণ বিশ্বাসের ভিত রচিত না হলে আমলের ক্ষেত্র তৈরী হয় না। যার আক্বীদা বিশুদ্ধ হয়নি, তার কাছে আমলের কথা অবান্তর। যেমন কিতাবুয্ যাকাতের হাদীসে রয়েছে-
وَعَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَعَثَ مُعَاذَا اِلَى الْيَمَنِ فَقَالَ اِنَّكَ تَأْتِىْ قَوْمًا اَهْلَ الْكِتَابِ فَادْعُهُمْ اِلى شَهَادَةِ اَنْ لاَّ اِلهَ اِلاَّ اللهُ وَاَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُوْلُ اللهِ فَاِنْ هُمْ اَطَاعُوْا لِذَالِكَ فَاَعْلِمْهُمْ اَنَّ اللهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلواتٍ فِى الْيَوْمِ وَاللَّيْلَةِ فَاِنْ هُمْ اَطَاعُوْا لِذَالِكَ فَاَعْلِمْهُمْ اَنَّ اللهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ اَغْنِيَآئِهِمْ فَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَآءِهِمْ فَاِن هُمْ اَطَاعُوْا لِذَالِكَ فَاِيَّاكَ وَكَرَائِمَ اَمْوَالِهِمْ وَاِتَّقِ دَعْوةَ الْمظْلُوْمِ فَاِنَّه لَيْسَ بَيْنَهَا وَبيْنَ اللهِ حِجَابٌ [مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ] অর্থাৎ হযরত সায়্যেদুনা ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত মু‘আয রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে যখন ইয়ামনে প্রেরণ করছিলেন, তখন তাঁকে নসীহত করে বলেন, নিশ্চয় তুমি যাচ্ছ আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের এক জনগোষ্ঠির কাছে। সুতরাং তুমি তাদেরকে (প্রথমতঃ) আহ্বান করো এ কথার স্বাক্ষ্য দিতে যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন মা’বূদ নেই, হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রসূল। যদি তারা এ আক্বীদা মেনে নেয়, তখন তাদের জানিয়ে দিও যে, আল্লাহ তাদের ওপর দিনে রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। তারা যদি তাও মেনে নেয়, তখন তাদেরকে জানিয়ে দিও, নিশ্চয় আল্লাহ্ তাদের ওপর মালের সদক্বাহ্ (যাকাত) ফরয করেছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে আহরণ করে দরিদ্রদের মাঝে বন্টন করা হবে। যদি তারা এ নির্দেশনা মেনে নেয়, তবে তাদের উত্তম সম্পদ (আদায় করা) থেকে নিবৃত্ত থেকো। মযলূমের ফরিয়াদকে ভয় করো। কারণ সেটা ও আল্লাহ্র মধ্যখানে কোন পর্দা থাকে না।
নামায দৈহিক ইবাদতের মধ্যে প্রধান এবং যাকাত আর্থিক ইবাদতের মধ্যে প্রধান। এ দু’টি ইবাদতের নির্দেশনার সাথে প্রথমেই যে বাণীর আনুগত্য করার শর্ত আরোপ হয়েছে সেটা ঈমান-আক্বীদার মূল বাণী। তাই নিঃসন্দেহে এ দাবী প্রতিষ্ঠিত হয় যে, শরীয়তের আমল প্রযোজ্য হওয়ার ক্ষেত্রে আক্বীদার বিশুদ্ধতা অলংঘনীয় ও জরুরী।
আক্বীদার ক্ষেত্রে বিশুদ্ধতার এ বিশেষণ যুক্ত হওয়াই প্রমাণ করছে যে, ঈমান-আক্বীদার মধ্যে ইসলামের মৌলিক রূপরেখার বিপরীতে অশুদ্ধ ও বাতিল আক্বীদা বিশ্বাসের প্রচলন বর্তমান সমাজে ব্যাপকহারে দেখা দিয়েছে। অথচ সাহাবা-ই কেরাম থেকে এ পর্যন্ত ইসলামের শাশ্বত বিশুদ্ধ আক্বীদা দর্শনের ধারক-বাহক হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত।
সাহাবা-ই কেরামের অনুসৃত পথ ও মত একমাত্র আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত। এটা একমাত্র নাজাতপ্রাপ্ত দল। এ উম্মতের সঠিক পথের ভ্রান্ত দাবীদার বাকীসব পথ ও মত গোরাহীতে নিমজ্জিত, বাতিল ফির্কা ও জাহান্নামী। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, এক হাদীসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান করেছেন। তিনি এরশাদ করেন-
لَيَأْتِيَنَّ عَلى اُمَّتِىْ كَمَا اَتى عَلى بَنِىْ اِسْرَائِىْلَ حَذْوَالنَّعْلِ بِالنَّعْلِ حَتّى اِنْ كَانَ مِنْهُمْ مَنْ اَتٰى اُمَّه عَلاَنِيَةً لَكَانَ فِىْ اُمَّتِىْ مَنْ يَّصْنَعُ ذَالِكَ وَاِنَّ بَنِىْ اِسْرَائِيْلَ تَفَرَّقَتْ عَلى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَةٌ وَتَفْتَرِقُ اُمَّتِىْ عَلى ثَلاَثٍ وَّ سَبْعِيْنَ مِلَّة كُلُّهُمْ فِى النَّارِ اِلاَّ مِلَّة وَاحِدَة قَالُوْا مَنْ هِىَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ مَا اَنَا عَلَيْهِ وَاَصْحَابِىْ ـ رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَ فِى رِوَايَةِ اَحْمَدَ وَاَبِىْ دَاؤدَ عَنْ مُعَاوِيَةَ ثِنْتَانِ وَسَبْعُوْنَ فِى النَّارِ وَوَاحِدَة فِى الْجَنَّةِ وَهِىَ الْجَمَاعَة
অনুবাদ: আমার উম্মতের কাছে বনী ইসরাঈলের মত হুবহু সময় আসবে, যেভাবে জুতো জোড়া একটি অপরটির অনুরূপ হয়। এমনকি তাদের মধ্যেও কেউ প্রকাশ্যে তার মায়ের সাথে অনাচারে লিপ্ত হলে, আমার উম্মতের মধ্যেও সে রকম আচরণ করার মত লোকও পাওয়া যাবে। নিশ্চয় বনী ইসরাঈল বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল, আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে তেয়াত্তর দলে। একটি মাত্র দল ছাড়া তাদের বাকী সবাই হবে দোযখী। তখন উপস্থিত লোকেরা আরয করলো, তারা কারা, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (অর্থাৎ কারা হক পন্থী?) তখন তিনি এরশাদ করলেন, যে আক্বীদা ও আদর্শে আমি এবং আমার সাহাবীরা আছি। এ হাদীস ইমাম তিরমিযী সংকলন করেছেন। হযরত মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে আহমদ ও আবূ দাঊদ’র এক রেওয়ায়তে আছে, (তাদের) বাহাত্তর দল যাবে দোযখে, আর শুধু একটি দল যাবে জান্নাতে। সেটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত।
প্রতি যুগে সাহাবা-এ কেরামের আক্বীদার সাথে সঙ্গতি ও মিল পাওয়া যায় শুধু আহলে সুন্নাতের সাথে। বুঝা যায়, বাদ বাকী দল-উপদলের আক্বীদা বিশুদ্ধ নয়।
পবিত্র হাদীসের পরিভাষায় ‘আল জামা‘আহ্’ ‘আস্সাওয়াদুল আ’যম’, ‘সাবীনুল্লাহ্’, ‘সিরাতে মুস্তাকীম’-এসব শব্দগত ভিন্নতায় মৌলিক আক্বীদায় অভিন্ন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতেরই নাম। হানাফী, শাফে‘ঈ, মালেকী, হাম্বলী, কাদেরী, চিশতী প্রভৃতি আমলগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন সাধন প্রক্রিয়ায় মৌলিক আক্বীদায় এক ও অভিন্ন দল সুন্নী জামাত।
আক্বীদার ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাতের পরিপন্থী যত ভ্রান্ত দল, সবাই বাতিল ফির্কা। বর্ণিত হাদীসে ‘আমার উম্মত’ বলে কাদের বুঝানো হয়েছে, তার ব্যাখ্যায় হাদীসবেত্তাগণ বলেন, উম্মত দু’প্রকার, ১. উম্মতে দাওয়াত। যাদের প্রতি দ্বীনের দাওয়াত প্রদত্ত হয়েছে; কিন্তু তারা গ্রহণ করেনি। যেমন কাফির, মুশরিক, ইয়াহুদী, নাসারা প্রভৃতি। ২. উম্মতে ইজাবত, যারা দাওয়াত কবুল করেছে। এ হাদীসে দ্বিতীয় প্রকার উম্মতকেই বুঝানো হয়েছে। পরবর্তীতে ‘নবীর উম্মত পরিচয়েই’ যারা বিভিন্ন ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণ করবে (যেমন, আল্লাহ্র জন্য দেহাকৃতি সাব্যস্ত করা, মিথ্যাচারের সম্ভাবনা রাখা, রাসূল আমাদের মত দোষে গুণে সাধারণ, মূর্খ, নিরক্ষর, অক্ষম, মৃত নবী, মাটির নবী, শ্রেষ্ঠ হলেও সর্বশেষ নন ইত্যাদি, অনুরূপ তাক্বদীর অস্বীকার করাসহ, যা সাহাবীগণের আক্বীদার বিপরীত) এরাই বাহাত্তর জাহান্নামী দল বলে গণ্য। পক্ষান্তরে, সঠিক আক্বীদায় আছেন সাহাবা, তাবে‘ঈ, তাব‘ঈ তাবে‘ঈন, খোলাফায়ে রাশেদীন, গাউস, ক্বুত্বব, আবদাল, আওতাদ, মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদগণ, যাঁরা নেয়ামতপ্রাপ্ত, যাঁদের অনুঃসৃত পথ ও মতই সিরাতে মুস্তাক্বীম। আবহমানকাল ধরে তাঁদের আক্বীদা পোষণকারী দলই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত।
হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
خَطَّ لَنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَطًّا ثُمَّ قَالَ هذَا سَبِيْلُ اللهِ ثُمَّ خَطَّ خُطُوْطًا عَنْ يَمِيْنِه وَعَنْ شِمَالِه وَقَالَ هذِه سُبُلٌ عَلى كُلِّ سَبِيْلٍ مِنْهَا شَيْطَان يَدْعُوْ اِلَيْهِ وَقَرَأَ ((وَاِنْ هذَا صِراطِىْ مُسْتَقِيْمًا فَاتَّبِعُوْه)) الاية (رَوَاهُ اَحْمَدُ وَالنَّسَائِىُّ وَالدَّارِمِىُّ)
অর্থাৎ একবার আল্লাহর রাসূল আমাদের সামনে একটি রেখা আঁকলেন। অতঃপর বললেন, এটি আল্লাহর রাস্তা। অতঃপর রেখাটির ডানে ও বামে আরো কিছু রেখা আঁকলেন এবং বললেন, এগুলো ভিন্ন রাস্তা, প্রতিটির ওপর বসা আছে শয়তান, যে মানুষকে নিজের দিকে ডাকতে থাকবে। এরপর তিনি ক্বোরআনের আয়াত- ‘‘ওয়া আন্না হা-যা সিরাত্বী মুস্তাকীমান ফাত্তাবি‘ঊ-হু’’ তেলাওয়াত করলেন।
এভাবে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
لاَ يُؤْمِنُ اَحَدُكُمْ حَتّى يَكُوْنَ هَواهُ تَبْعا لِمَا جِئْتُ بِه
অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবেনা, যতক্ষণ তার প্রবৃত্তি আমি যা (নির্দেশনা) নিয়ে এসেছি, তার অনুবর্তী হবে না।
মোটকথা, যে সমস্ত বিষয় আক্বীদা সংক্রান্ত, তাতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য নয়, এমন কিছু সম্পর্কিত করা যাবে না। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা বিষয়ক গ্রন্থাবলি অধ্যয়নপূর্বক কিংবা নির্ভরযোগ্য ওলামা-ই আহলে সুন্নাতের কাছ থেকে ভালভাবে জেনে নিয়ে মৌলিক আক্বীদার মাসা-ইল নিশ্চিত হওয়া জরুরী।
ওপরে ধোঁয়া দেখে যেমন নিশ্চিত বলা যায় যে, ভেতরে আগুন আছে, বৃক্ষের জীবন থাকলে যেমন তার শাখা-প্রশাখা, ফুল-ফল অবশ্যম্ভাবী, তেমনি ঈমান সজীব থাকলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেক আমলগুলোও এর ফুল ফল হয়ে বিকশিত হবে। আমাদের মনে রাখা উচিৎ, নেক আমল তো ঈমানেরই অলঙ্কার, ঈমানদারই নেক আমলের হক্বদার, ঈমান বুকে ধারণ করে ঈমানদার আমলবিহীন থাকতে পারেনা। পৃথিবীর এ জীবন আমলেরই ক্ষেত্র। পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে-
اَلَّذِىْ خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَواةَ لِيَبْلُوَكُمْ اَيُّكُمْ اَحْسَنُ عَمَلاً
অর্থাৎ তিনিই (ওই মহান সত্তা), যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, যাতে তিনি তোমাদেরকে যাচাই করে দেখবেন যে, তোমাদের মধ্যে কার আমল সুন্দরতম।
মানব সৃষ্টির তাৎপর্য উপলব্ধি করলে ঈমানদার আমল থেকে নিবৃত্ত থাকতে পারেনা। তাক্বদীরে মানুষের শেষ পরিণতি যাই থাকুক, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের দৃষ্টিতে আমল আমাদের করতেই হবে। অদৃষ্টের পরিণতিই চূড়ান্ত বলে আমল ছেড়ে দেওয়া চলবে না। এ প্রসঙ্গে শেরে খোদা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে রয়েছে-
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا مِنْكُمْ مِنْ اَحَدٍ اِلاَّ وَقَدْ كَتَبَ مَقْعَدَه مِنَ النَّارِ وَمَقْعَدَه مِنَ الْجَنَّةِ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ اَفَلاَ نَتَّكِلُ عَلى كَتَابِنَا وَندع الْعَمَل ـ قَالَ اِعْمَلُوْا كُلٌّ مُّيَسَّرٌ لِماَ خُلِقَ لَهٗ اما مَنْ كَانَ مِنْ اَهْلِ السَّعَادَةِ فَسَيُيَسَّرُ لِعَمَلِ السَّعَادَةِ وَاَمَّا مَنْ كَانَ اَهْلُ الشَقَّاوَةِ فَسَيُيَسَّرُ لِعَمَلِ الشَّقَاوَةِ ثُمَّ قَرَأَ فَاَمَّا مَنْ اَعْطٰى وَاتَّقٰى وَصَدَّقَ بِالْحُسْنٰى الاخـ … (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
অর্থাৎ আল্লাহর রসূল এরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার জাহান্নামের ঠিকানা ও যার জান্নাতের ঠিকানা লিপিবদ্ধ করা হয়নি। উপস্থিত লোকেরা আরয করলেন, এয়া রাসূলাল্লাহ্, তবে কি আমরা আমাদের অদৃষ্ট লিপির ওপরই ভরসা করবেনা না এবং ‘আমল’ ছেড়ে দেব না? তিনি এরশাদ করলেন, আমল করতে থাকো। প্রত্যেকের জন্য ওই আমল সহজ করে দেয়া হবে, যার (পরিণতির) জন্য সে সৃষ্ট হয়েছে। যদি কেউ সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে সৌভাগ্যবানদের আমল তার জন্য সহজ করা হবে। আর যদি কেউ হতভাগ্যদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে হতভাগাদের আমল তার জন্য সহজ করা হবে। অতঃপর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ‘ফা আম্মা মান আ’তা ওয়াত্তাকা ওয়া সাদ্দাক্বা বিল হুসনা’- আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন।
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নেক আমলকে ক্ষুদ্র করে দেখতে নেই, বর্জন করতে নেই। ইখলাস (নিষ্ঠা)’র সাথে করা সামান্য আমলে যদি আল্লাহ্ ও রসূল সন্তুষ্ট হয়ে যান, তবে তার চেয়ে বড় আমল কী? এ জন্যই হাদীস শরীফে এসেছে وَلاَ تَحْقِرَنَّ شَيْأً مِّنَ الْمَعْرُوْفِ অর্থাৎ নেক আমলের কোন কিছুকেই মা’মূলী ভেবো না।
আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দার জন্য হায়াত সৃষ্টি করে দেখতে চান, তাদের মধ্যে কে সুন্দর আমলকারী। ভাল আমলকারী কে, এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, হারাম থেকে বাঁচবার এবং আল্লাহ্ তা‘আলার নির্দেশের আনুগত্য করার অধিকতর আগ্রহী ব্যক্তিই ভাল আমলকারী।
মহান রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন,
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ط وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ Ο
অর্থাৎ হে মাহবূব, আপনি বলে দিন, হে মানবজাতি, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবেসে থাকো, তবে আমার আনুগত্য কর। তবে আল্লাহ্ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ্সমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, দয়ালু।
আরো এরশাদ হয়েছে- مَّن يُّطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ ۖ
যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল।
হাদীস শরীফে এসেছে, আল্লাহর রাসূলের নির্দেশনাই সর্বোত্তম হেদায়ত। যেমন-
وَعَنْ جَابِرٍرَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَمَّا بَعْدُ فَاِنَّ خَيْرَ الْحَدِيْثِ كِتَابُ اللهُ وَخَيْرُ الْهَدْىِ هَدْىُ مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الْاُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضِلَاَلَةٌ ـ رَوَاهُ مُسْلِمَ
অর্থাৎ হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, হামদ ও সালাতের পর, নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম কথা হল আল্লাহর কিতাব ও সর্বোত্তম তরীকা (পথ নির্দেশনা) হলো মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র তরীক্বা। আর সর্বনিকৃষ্ট বস্তু হল দ্বীনের বিদ‘আতসমূহ এবং প্রত্যেক বিদ্‘আতই গোমরাহী (পথভ্রষ্টতা)
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করলে সাধারণ মু’মিনও আল্লাহর প্রিয় হয়ে যায়। তাহলে তাঁর মাহবূব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর চলা-ফেরা, উঠা-বসা, চাল-চলনসমূহ আল্লাহর কাছে যে কত পছন্দের তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। আল্লাহ্ যা পছন্দ করেন, তাই হবে সুন্দর আমল।
পবিত্র ক্বোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে-
لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا ﴿٢١﴾
অর্থাৎ নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ্র অনুসরণই উত্তম, তারই জন্য যে আল্লাহ্ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।
সোজা কথায় রাসূলুল্লাহর পবিত্র সুন্নাতগুলোই আমাদের জন্য উসওয়া-ই হাসানা, যার অনুসরণ পরকাল প্রত্যাশীদের জন্য পাথেয় স্বরূপ। মহান রবের সাক্ষাতের প্রত্যাশী বান্দামাত্রই নেক আমল’র পূঁজি সঞ্চয় করবেন। যেমন অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে-
فَمَن كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا ﴿١١٠﴾
সুতরাং, যার নিজ পালনকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করার আশা আছে, সে যেন নেক আমল সম্পাদন করে, আর সে যেন আপন প্রতিপালকের ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করে।
বিশুদ্ধ আক্বীদাসহ যে ব্যক্তি কোন সৎকাজ করবে, তার প্রতিদান কমপক্ষে দশগুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। যেমন এরশাদ হয়েছে-
مَن جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا ۖ
অর্থাৎ যে কেউ একটা সৎকাজ করবে, তবে তার জন্য তদনুরূপ দশগুণ রয়েছে।
এ আয়াতের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যায় আছে, ‘‘যে একটা সৎকাজ করবে, তাকে দশটা সৎকাজের প্রতিদান দেয়া হবে এবং এটাও চূড়ান্ত সীমা নির্ধারণের পদ্ধতি অনুসারে নয়; বরং আল্লাহ্ তা‘আলা যাকে যত চান ততই তার সৎকর্মসমূহের প্রতিদান বৃদ্ধি করবেন, একটার প্রতিদান সাতশ’ গুণও করবেন, কিংবা অগণিত দান করবেন। মূলকথা হচ্ছে এ যে, সৎকর্মসমূহের প্রতিদান নিরেট অনুগ্রহই। এটা হচ্ছে ‘আহলে সুন্নাত’-এর অভিমত। আর অপকর্মের এতটুকু শাস্তিও তাঁরই ইনসাফ।
দৈনিক পাঁচবার কোন মানুষ যদি বাড়ীর সম্মুখস্থ পুষ্করিনী মুখ হাত পা ধৌত করে, তবে তার শরীরের যেমন কোন ময়লা আবর্জনা থাকতে পারেনা, তেমনি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত পাঁচ বার নামায আদায় করলে ওই ব্যক্তির কোন গুনাহর ময়লা থাকতে পারে না- এ উদাহরণ টেনে আল্লাহর রাসূল সাহাবা-ই কেরামের নিকট নামাযের গুরুত্ব ও মহিমা বর্ণনা করেছেন। রোযা জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষার জন্য মু’মিনের ঢাল স্বরূপ। মু’মিন বান্দা আল্লাহর রাস্তায় অর্থ সম্পদ ব্যয় করলে তার উদাহরণ বপন করার শস্য বীজের মত, যা একটি হতে সাতটি শীষ গজিয়ে প্রতিটি শীষে একশ’ করে একটি দানা সাতশ’ হয়ে ফিরে আসে- ক্বোরআন-ই করীমে এ উদাহরণ সম্পদের মাধ্যমে নেক আমলের দিকে উৎসাহ্ প্রদত্ত হয়েছে। যাতে বান্দা কোন প্রকার নেক আমল তরক না করে এবং কোন উত্তম প্রতিদান থেকেও বঞ্চিত না হয়। ফাযা-ইলের কিতাবসমূহে নেক আমলের প্রতিদান ও ফযীলত ব্যাপকহারে বর্ণিত হয়েছে, কলেবর বৃদ্ধির সম্ভাবনা এড়াতে বিশদ আলোচনা করা হল না।
আমরা, প্রতিটি মু’মিন বান্দার এ উপলব্ধি অবশ্যই আছে যে, সঠিক ও বিশুদ্ধ আক্বীদার ধারক প্রকৃত একজন মু’মিন অবশ্যই সচ্চরিত্রে চরিত্রবান। সচ্চরিত্রের বিশেষায়ন দুশ্চরিত্রের অস্তিত্বকে বর্জনের পরোক্ষ বক্তব্য বহন করে। কারণ দুশ্চরিত্র হওয়া কাফিরদের বৈশিষ্ট্য। আর সচ্চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া সত্যিকার মু’মিনের পরিচায়ক।
সচ্চরিত্রের আরবী প্রতিরূপ আখলাক্বে হাসানা আখলাক্ব শব্দটি ‘খুলুক্ব’-এর বহুবচন। এর সাথে ক্বোরআনে বর্ণিত বিশেষণ আযীম। যেমন পবিত্র ক্বোরআনের সূরা ক্বালাম-এ এসেছে اِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيْمٍ (অর্থাৎ হে মাহবুব, নিঃসন্দেহে আপনি ‘খুলুক্বে আযীম’ তথা সুমহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত আছেন। এ ছাড়া ক্বোরআন-সুন্নাহ’র সাথে সংযোজিত বিশেষণ দেখা যায়, مَكَارِمُ الْاَخْلاَقِ (মাকারিমে আখলাক্ব), مَحَاسِنِ اَخْلاَقْ (মাহাসিনে আখলাক্ব) ইত্যাদি শব্দমালা। সবগুলো বর্ণিত সচ্চরিত্রেরই অর্থবোধক শব্দ।
উম্মুল মু’মিনীন সায়্যিদা আয়েশা সিদ্দীক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহাকে আখলাক্বে নবভী সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, প্রিয় নবীর অনুপম চরিত্র-মাধূর্যের স্বরূপ ছিল মূর্ত ক্বোরআন। অর্থাৎ পবিত্র ক্বোরআনের বাস্তব নমুনা হল তাঁর পবিত্র আখলাক্ব। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যে শুধু ক্বোরআনে বর্ণিত ‘উস্ওয়া-ই হাসানা’ ও ‘খুলুক্বে আযীম’র জীবন্ত নমুনাই ছিলেন, তা নয় বরং মানব জগতে তাঁর প্রেরিত হওয়ারও এক মহান উদ্দেশ্য ছিল উম্মতের মধ্যে সচ্চরিত্রের বিকাশ সাধন। সেই মহান লক্ষ্যের কথা তাঁর পবিত্র বাণীতেই নিহিত।
عَنْ مَالِكٍ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ بَلَغَهٗ اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ بُعِثْتُ لِاُ تَمِّمَ حُسْنَ اَلْاَخْلاَقِ رَوَاهُ فِى الْمُؤَطَّا وَرَوَاهُ اَحْمَدُ عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ ـ
অর্থাৎ হযরত মালেক ইবনে আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তাঁর নিকট (সংবাদ) পৌঁছেছে যে, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আমি চরিত্র সৌন্দর্যের পূর্ণতা বিধানের জন্য প্রেরিত হয়েছি। তিনি (বর্ণনাকারী) এ হাদীস শরীফ তাঁর ‘মুওয়াত্তা’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। আর ইমাম আহমদ এটি আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন।
এ হাদীস মুবারকের ব্যাখ্যায় শাইখে মুহাক্কিক হযরত আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, ‘‘বর্ণনান্তরে حُسْنَ الْاَخْلاَق (হুসনাল আখলাক্ব) এ শব্দের স্থলে مَكَارِمَ الْاَخْلَاقِ (মাকারিমাল আখলাক) শব্দ রয়েছে। ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, আরব জনগোষ্ঠীদের মধ্যে যতদিন হযরত ইবরাহীম আলায়হিস্ সালামের শরীয়তের সুন্দর নমুনাগুলো অবশিষ্ট ছিল, ততদিন তারা সুন্দরতম চরিত্রে সমৃদ্ধ ছিল। এর অধিকাংশই প্রত্যাখ্যান করে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে এবং সেখানে জাহেলী যুগের আহকামগুলোর সংমিশ্রণ ঘটায়। তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সুন্দরতম চরিত্র সুষমার পূর্ণতা বিধানের মহান লক্ষ্যে প্রেরিত হন।
সরকার-ই দোআলম আরো এরশাদ করেন, সচ্চরিত্র ব্যক্তিই উত্তম ব্যক্তি। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলে আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়ার্সারাম এরশাদ করেন, اِنَّ مِنْ اَحَبِّكُمْ اِلَىَّ اَحْسَنُكُمْ اَخْلَاقًا অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সুন্দর চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়।
সচ্চরিত্র ও দুশ্চরিত্র উভয় প্রকার অবস্থায় মানুষের মাঝেই বিদ্যমান। নন্দিত-নিন্দিত উভয় প্রকারের মানুষ নিয়েই আমাদের সমাজ। তাই এর স্বরূপ কী? আমরা এ মানদন্ডে কীভাবে নিজেকে যাচাই করবো। মুসলিম শরীফের এক হাদীসে রাসূলে আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন, যেহেতু বিষয়টি মনঃস্তত্ত্ব সম্পর্কিত ও আপেক্ষিক, তাই আমাদের জন্য তাঁরই নির্দেশনা আত্মবিশ্লেষণের সহায়ক হবে নিঃসন্দেহে। হযরত নাওয়াস ইবনে সাম‘আন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘পূণ্য’ আর ‘পাপ’-এর স্বরূপ সম্পর্কে আমি একবার রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিকট জানতে চাইলাম। তিনি এরশাদ করলেন, সচ্চরিত্রই পুণ্য এবং যা তোমার অন্তরে খটকা জাগায়, যা মানুষের গোচরীভূত হওয়াকে তুমি অপছন্দ কর, তা-ই পাপ।
নিজেরা আমরা যা-ই হই না কেন, মানুষের কাছে নিজেকে সুন্দর, নান্দনিক ও প্রশংসার পাত্র হিসেবে দেখাতে চাই, প্রমাণ করতে চাই। তা ছাড়া অধিকাংশ মুসলমান যাকে সুন্দর হিসাবে দেখে, আল্লাহর কাছেও তা সুন্দর। কারণ মানুষ আল্লাহর কাছে একে অপরের স্বাক্ষী হিসাবে বিবেচিত। তাই মানুষের দৃষ্টিতে যা গর্হিত, অনৈতিক, অপছন্দের, তা সচ্চরিত্রের পরিপন্থী। যা অপরের কাছে আমি দেখতে পছন্দ করি না, যে আচরণের প্রশংসা করা যায় না, তার সবটাই সচ্চরিত্রের বিপরীত। মোল্লা আলী ক্বারী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি সচ্চরিত্রের বিশ্লেষিত সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন-
هُوَ الْاِنْصَافُ فِى الْمُعَامَلَةِ وَبَذْلُ الْاِحْسَانِ وَالْعَدْلِ فِى الْاَحْكَامِ وَالْاَظْهَرُ اَنَّهٗ هُوَ الْاِتَّبَاعُ بِمَا اَتٰى بِهِ النَّبِىُّ صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ اَحْكَامِ الشَّرِيْعَةِ وَاٰدَابِ الطَّرِيْقَةِ وَاَحْوَالِ الْحَقِيْقَةِ ـ
অর্থাৎ তা হলো লেনদেনে ইনসাফ রক্ষা করা, সৌজন্য ব্যয় করা, আহকামের মধ্যে মধপন্থিতা। সর্বোপরি ব্যাখ্যার সারকথা হল, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শরীয়তের নীতিমালা তরীক্বতের বিধি-বিধান, হাক্বীক্বতের অবস্থাদির যে বিবরণ দিয়েছেন, তার পরিপূর্ণ ইত্তেবা’ বা আনুগত্যে সমর্পিত হওয়ার মানসিকতাই সচ্চরিত্র।
সচ্চরিত্রের প্রকৃত উৎস অন্তর। এখান থেকে মার্জিত রূপ আচরণে প্রকাশিত হয়। যেমন খনি থেকে সম্পদ উৎসরিত হয়, আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা। তাই এই আখলাক্বের ও আত্মিক ও বাহ্যিক উভয় প্রকার সৌন্দর্যই বাঞ্ছনীয়।
ইমাম গায্যালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, ‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা ইনসানকে দু’টি বস্তুর সমন্বয়ে সৃষ্টি করেছেন। একটি দেহ ও অপরটি রূহ। দেহ বাহ্যিক দৃষ্টি দিয়ে দেখা হয়, আর রূহকে ‘আক্বল বা প্রজ্ঞা দিয়ে। একটির সৌন্দর্য خُلْق (খালক্ব বা) দৈহিক সৌন্দর্য, অপরটির সৌন্দর্যকে حُسْنِ خُلْق (হুসনে খুল্ক্ব) বা আত্মিক সৈৗন্দর্য বলে অভিহিত করা হয়।
যাহির-বাত্বিন উভয় প্রকার সৌন্দর্যে ধন্য হলে একজন মানুষ হয় পরিপূর্ণ সুন্দর। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উভয়বিধ সৌন্দর্যের জন্য নিয়মিত প্রার্থনা করতেন। মু’মিন জননী সায়্যিদা আয়েশা সিদ্দীক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রায়শঃ (প্রার্থনায়) বলতেন, হে আল্লাহ্, তুমি আমার বাহ্যিক আকৃতিকে সৌন্দর্যমন্ডিত করেছ, অতএব, আমার প্রকৃতিগত আচরণগুলো (স্বভাব-চরিত্র)ও সৌন্দর্যমন্ডিত রেখো।
মানুষের কথা-বার্তা, চাল-চলন সবকিছুতে বিন¤্র হওয়া, শালীন ও মধুর আচরণ সচ্চরিত্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। এভাবে আমানতদারী, ওয়াদা রক্ষা, কথা ও কাজে সততা ও সামঞ্জস্য রাখা অন্যের বিপদে সমবেদনা, সহানুভূতিসহ সাধ্যমত সহায়তা প্রদান করা, সহিষ্ণুতা, অল্পে তুষ্টি, ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ ইত্যাদি সচ্চরিত্রের উল্লেখযোগ্য দিক। ইমাম গাযযালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস চয়ন করেছেন যে, এক ব্যক্তি হুযূর-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে হাযির হয়ে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম), দ্বীন কী? তিনি এরশাদ করলেন, সচ্চরিত্র। লোকটি ডানে-বামে ঘুরে ঘুরে একই প্রশ্ন করতে লাগল, আর প্রিয়নবীও বারবার একই উত্তর দিলেন। শেষে তিনি দৃঢ়তার সাথে বললেন, তুমি জান না, দ্বীন তো এটিই (অর্থাৎ সচ্চরিত্র)।
টিকা:
. সূরা বাক্বারা: আয়াত-২-৫
. خزائن العرفان فى تفسير كنز الايمان از قلم صدرالافاضل حكيم الامة علامه سيد نعيم الدين مرادابآدى عليه الرحمة
. সূরা নিসা: আয়াত- ১৩৬
. খাযা-ইনুল ইরফান
. মিসবাহুল লুগাত, মু’জামুল ওয়াসীত্ব
. মুফতী সায়্যিদ আমীমুল ইহসান: কাওয়াইদুল ফিক্বহ্, পৃ. ২০০
. সূরা আসর: আয়াত-২-৪
. সূরা নিসা: আয়াত-১২৪
. সূরা নাহল: আয়াত-৯৭
. সূরা আম্বিয়া: আয়াত-৯৪
.সূরা আল-ই ইমরান, আয়াত-৯১
. বুখারী ও মুসলিম শরীফের বরাতে মিশকাতুল মাসাবীহ্, পৃ. ১৭৩
. বুখারী ও মুসলিম
. মিশকাতুল মাসাবীহ্, পৃ. ৩০, (মিরক্বাত প্রণেতা মোল্লা আলী ক্বারী রহ. তাঁর গ্রন্থে এ ব্যাখ্যাই দিয়েছেন)। এবং ক্বোরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামের মূলধারা ও বাতিল ফিরকা, পৃ. ২০, কৃত. আল্লামা কাজী মঈনুদ্দীন আশরাফী।
. আহমদ, নাসাঈ ও দারেমী মিশকাত গ্রন্থে সংকলিত, পৃ. ৩০
. শরহুস সুন্নাহ্ গ্রন্থে এ হাদীস বর্ণিত। দ্র. প্রাগুক্ত।
. সূরা মূলক: আয়াত-২
. متفق عليه (মুত্তাফাক আলাইহি) যে হাদীস অভিন্ন শব্দমালায় বুখারী ও মুসলিম উভয় সহীহ গ্রন্থদ্বয়ে লিপিবদ্ধ তা হাদীস শাস্ত্রে ‘মুত্তাফাক্ব আলাইহি’ বলা হয়। গ্রন্থদ্বয় হতে মিশকাত (পৃ.২০) গ্রন্থে সংকলিত।
. তাফসীরে কুরতুবী
. সূরা আল-ই ইমরান: আয়াত-৩১
. সূরা নিসা: আয়াত-৮০
.মুসলিম শরীফের বরাতে মিশকাতুল মাসাবীহ্, পৃ. ২৭
. সূরা আহযাব: আয়াত-২১
. সূরা কাহ্ফ: আয়াত-১১০
. সূরা আনআম: আয়াত-১৬০
. খাযা-ইনুল ইরফান, (কৃত. মূল: সদরুল আফাযিল আল্লামা সায়্যিদ নঈম উদ্দীন মুরাদাবাদী রহ. অনুবাদ, মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান)
. মুওয়াত্তার বরাতে মিশকাতুল মাসাবীহ্, পৃ. ৪৩২
. প্রাগুক্ত হাদীসের হাশিয়া (প্রান্ত টীকা)
. বুখারী ও মুসলিম থেকে প্রাগুক্ত গ্রন্থে সংকলিত
. মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ্, পৃ. ৪৩১
. মোল্লা আলী ক্বারী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি কৃত. মিরকাত শরহে মিশকাত
. কিমিয়া-এ সা‘আদাত, (১ম পরিচ্ছেদ, ৩য় রুকন,) কৃত. হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মদ গায্যালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি, ওফাত-৫০৫হি.
. মিশকাতুল মাসাবীহ্, পৃ.
. কিমিয়া-ই সা‘আদাত।
—০—