Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

শিয়া পরিচিতি : বাংলাদেশে শিয়া মতবাদ

শিয়া পরিচিতি : বাংলাদেশে শিয়া মতবাদ

= শিয়া পরিচিতি: বাংলাদেশে শিয়া মতবাদ
মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম =

আল্লাহর হাবীব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ফরমান- “বনী ইসরাইল বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল, আর আমার উম্মাত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। এক দল বাদে সবাই জাহান্নামে যাবে। আর ঐ দল হলো- যাঁরা আমি ও আমার সাহাবীদের মত ও পথের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।” রাসূলের সেই অমোঘ বাণী সত্য প্রমাণিতএ বর্তমান পৃথিবীতে মুসলিম সম্প্রদায় বিশ্বাসগত ভাবে নানা দলে উপদলে আজ শতধাবিভক্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সাহাবীগণ রাদিয়াল্লাহু আনহুমের মতাদর্শের মূলে কুঠারাঘাত করে জাহান্নামের পথের পথিকদের অন্যতম হলো- শিয়া মতবাদ; যারা ভারতীয় উপমহাদেশে দীর্ঘকাল ধরে থাকলেও বাংলাদেশে তারা তেমন সুবিধা করতে পারেনি। বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতে ইরানের টাকা খেয়ে কিছু ইবনে সাবার প্রেতাত্মা নামে-বেনামে, ছদ্মনামে, অপনামে; দরবার, দরসগাহ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়াতলে, দলে-উপদলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে; দাওয়াতের নামে, সভা-সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের আড়ালে ইলেকট্রোনিক এবং সামাজিক যোগাযোগের সাইটে চটকদার প্রচারণার মাধ্যমে এই ভন্ড, পথভ্রষ্ট ও জাহান্নামী গোষ্ঠি ইসলামের সঠিক মতাদর্শী সুন্নী মুসলমানদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে এই বর্ণচোরাদের মুখোশ উন্মোচন করা এবং বাংলাদেশে শিয়া মতবাদ সম্পর্কে পাঠকমহলকে সংক্ষিপ্ত ধারণা প্রদান করার নিমিত্তেই এ প্রবন্ধ লেখা।

শিয়া পরিচিতি
শিয়া আরবি শব্দ -‎‎اَلشِّيْعَةُ (আশ-শীআ’হ্)-এর অর্থ হলো- দল, জমা‘আত, অনূসারী, অনুগামী ইত্যাদি। ‘শিয়া’ হল ঐতিহাসিক বাক্য ‘শিয়াতু আলি’ (شيعة علي) এর সংক্ষিপ্ত রূপ, যার অর্থ ‘হযরত আলীর অনুগামী বলে দাবীদার’ বা ‘আলির দল’ শিয়া মতবাদের ভ্রান্ত দাবী হল, ‘হযরত আলি এবং তাঁর বংশধরেরাই হলেন খিলাফতের প্রধান দাবীদার; তাই আলি খিলাফতের প্রশ্নে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু, হযরত উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত উসমান যুননূরাইনের মুকাবেলায় অগ্রাধিকার প্রাপ্ত এবং ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকেই খিলাফতের জন্য মনোনীত করে গিয়েছিলেন’। ইসলামের সংখ্যালঘু গোষ্ঠি যারা সুন্নি থেকে ধর্মতত্তীয় ভাবে ভিন্ন, কিন্তু আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করে যে পয়গম্বর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বংশধরদেরই একমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেয়া উচিত। এ ভ্রান্ত চিন্তাধারার অনুসারীদেরকে শিয়া বা শিয়া মুসলিম নামে অভিহিত করা হয়। শিয়ারা বিশ্বাস করে যে, ‘খলিফাদের প্রথম নির্বাচনে পয়গম্বরের নিকট পুরুষ আত্মীয় আলীকে নির্বাচন করা উচিত ছিল’। বস্তুত এ বিশ্বাস ভুল।

শিয়া দলের উৎপত্তি ও প্রতিষ্ঠাতা
ইয়েমেনের সান’আ শহরের জনৈক ইয়াহুদী আলিম ছিল আবদুল্লাহ ইবনে সাবা ওরফে ইবনে সাওদা। হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর খিলাফতকালে সে বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে। তার মূল লক্ষ্য ছিল- নিজেকে মুসলমান বলে জাহির করে মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ ও ফাটল সৃষ্টি করা, মুসলমানদের ফিৎনা ও গোলযোগ সৃষ্টি করে ভিতর থেকে ইসলামকে বিকৃত ও ধ্বংস করা। ওই লক্ষ্যে সে মদীনায় কিছু দিন কাজ করে সফলকাম হতে না পেরে বসরা চলে গেল। এক সময় সিরিয়া গেল। কিন্তু এসব জায়গায় পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে না পেরে অবশেষে মিশর গমন করল। এখানে সে কিছু লোককে তার দুরভিসন্ধিতে সাহায্যকারী পেয়ে গেল। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মতে- সে সর্বপ্রথম এ ধোঁয়া ছাড়ল যে, ‘মুসলমানদের প্রতি আমার আশ্চর্য লাগে, যারা এ পৃথিবীতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম-এর পুনরায় আগমন করার কথা বিশ্বাস করে কিন্তু সাইয়িদুল আম্বিয়া মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরনের পুনঃরাগমনে বিশ্বাস করেন না; অথচ তিনি সকল পয়গাম্বরের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। তিনি অবশ্যই পুনরায় এ পৃথিবীতে আগমন করবেন।

অতঃপর যখন সে দেখল, এ কথাটি মেনে নেয়া হয়েছে, তখন সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে হজরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বিশেষ আত্মীয়তার ভিত্তিতে তাঁর প্রতি আসাধারণ ভক্তি ও মুহাব্বত প্রকাশ করে তাঁর শানে নানা রকম বাড়তি কথাবার্তা শুরু করে দিল।
এক পর্যায়ে সে বলল, প্রত্যেক নবীর একজন ওয়াসী বা ভারপ্রাপ্ত থাকেন। নবীর ইন্তিকালের পর সেই ভারপ্রাপ্তই নবীর স্থানে উম্মাতের প্রধান হয়ে থাকেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পরও নিয়মানুযায়ী একজন ভারপ্রাপ্ত থাকার কথা। তিনি কে? তিনি হলেন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু।’ সে বলল, ‘তাওরাতেও তাঁকেই ভারপ্রাপ্ত বলা হয়েছে। অতএব রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পর খলীফা হওয়ার অধিকারী প্রকৃতপক্ষে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওফাতের পর চক্রান্ত করে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর অধিকারকে ছিনিয়ে নিয়ে তাঁর স্থলে আবু বকরকে খলিফা বানানো হয়েছে। তারপর তিনি পরবর্তী সময়ের জন্য ওমরকে মনোনীত করে গেছেন। ওমরের পরও আলীর বিরুদ্ধে চক্রান্ত হয়েছে এবং উসমানকে খলীফা করা হয়েছে, যে এর মোটেও যোগ্য নয়। (না‘ঊযুবিল্লাহ্) সে হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে অযোগ্য প্রমাণ করার জন্য তাঁর বিভিন্ন গভর্নরদের নানা বিষয়ে ত্রুটি-বিচ্যুতির দিক তুলে ধরতে থাকল। এভাবে এক পর্যায়ে আব্দুল্লাহ ইবনে সাবার আনুসারী একদল লোক হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠল এই বলে যে, উসমান এবং তার গভর্নরদের কারণে উম্মতের মধ্যে যে ভ্রষ্টতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তা দূর করা দরকার।
বস্তুত গভর্ণর নিয়োগের ব্যাপারে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সব ক’টি অমূলক বলে প্রমাণিত হয়েছে।
ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহের এক পর্যায়ে হযরত আলী এবং হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার মধ্যে ভুলবুঝা বুঝির ফলে ‘জঙ্গে জামাল’ আর হযরত আলী এবং তদানীন্তন সমকালীন প্রাদেশিক গভর্ণর হযরত আমীর মু‘আভিয়ার মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে জঙ্গে সিফ্ফীন সংঘটিত হলো। মোটকথা ‘শী’আনে আলী’ কথাটির অর্থ হল, ‘হযরত আলীর দল’। আর আবদুল্লাহ ইবনে সাবা ইয়াহুদী হল শিয়া মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা।

শিয়া দল-উপদল পরিচিতি
শিয়ারা মূলতঃ তিন প্রধান দলে বিভক্ত। এই দল গুলো হলো- (১) তাফদিলিয়্যাহ, (২) সাবয়ীয়্যাহ (৩) গুলাত। সাবয়ীয়্যাহদের তাবারিয়্যাহও বলা হয়। গুলাত বা চরমপন্থীরা ২৪টি উপদলে বিভক্ত। এদরে মধ্যে কয়েকটির পরিচিতি ও মতবাদ আলোচনা করা হলো-

এক: ইস্নাআশারিয়া বা জাফরিয়া উপশাখা
ইরাক, ইরান, আজারবাইজান, লেবানন ও বাহরাইনে এ উপদলের লোক বেশি দেখা যায়। এছাড়া পাকিস্তান, আফগানিস্তান, কুয়েত ও আলবেনিয়ার অনেক মানুষও ইসনা আশারিয়া শিয়া। এদের ধারণা, ‘হযরত মুহম্মদ মোস্তফার ওফাতের পর হযরত আলী হচ্ছেন মুসলমানদের ইমাম। সাহাবীগণ হযরত আলীকে ইমাম না বানিয়ে হযরত আবু বকর-ওমর-উসমানকে খলিফা বানিয়েছেন, যা আল্লাহর আদেশের সরাসরি লঙ্ঘন’। তারা অধিকাংশ সাহাবীকে মুনাফিক মনে করে এবং খুতবায় নিয়মিত গালিগালাজ করে। তারা বিশ্বাস করে বারো ইমামতে , যা হযরত মুহম্মদ মোস্তফা থেকে শুরু করে হযরত আলীর বংশধর ইমাম মাহদীর মধ্য দিয়ে শেষ হয়। তাদের ধারণায় এই ইমামগণের মর্যাদা নবী-রাসুলদের চেয়েও বেশী। ইসনা আশারিয়াদের কিছু কর্মকান্ড অদ্ভূত। এরা মুতা’ বিবাহ বা পতিতাবৃত্তিকে জায়েজ মনে করে। তিনবারে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। হজ্জ্বের চেয়ে হযরত আলীর মাজার দর্শনকে অধিক পূণ্যের বলে বিবেচনা করে। এদের নিজস্ব হাদিস গ্রন্থ আছে। সহীহ বোখারী, মুসলিম প্রমুখ হাদিসগ্রন্থে এরা আস্থা রাখে না।

দুই: জাইদিয়া উপশাখা
ইয়েমেনে এ মতাদর্শের শিয়া বেশি দেখা যায়। বহুল আলোচিত হুথিগণ এদের মধ্যে অন্যতম। শিয়াদের মধ্যে এরা সবচেয়ে প্রাচীন। আগে এদের রমরমা অবস্থা থাকলেও ১৯৬২ সালে ইমামত লোপের পরে তারা বেকায়দায় পড়ে যায়। অনেক শতাব্দী আগে ইমাম নির্বাচনের প্রশ্নে মতানৈক্য হওয়ায় অন্য একদল শিয়া আলাদা হয়ে ইসনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে। এরা বিশ্বাস করে ইমাম মুহাম্মদ আল বাকিরের ইমামতে। আর জাইদিয়া শিয়াগণ জাইদ ইবনে আলীর ইমামতে বিশ্বাস করতে শুরু করে। এরা ইমাম হুসাইন পর্যন্ত আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করে, তারপরের ইমামগণের স্বর্গীয় আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করে না।

তিন: ইসমাঈলিয়া উপশাখা
এরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভারত, চীন, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপে এদের দেখা মেলে। এরা বলে, ‘ইসলামের সপ্তম ইমাম হচ্ছেন ইসমাঈল ইবনে জাফর। অন্যদিকে জাফরিয়া শিয়াগণ বলে, সপ্তম ইমাম মুসা ইবনে কাজিম। এ থেকে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে শিয়াদের এই নতুন উপশাখা জন্মলাভ করে। এদের বিশ্বাস হলো, আধ্যাত্মিকতা হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা হতে হয়রত আলী এবং তার থেকে বংশানুক্রমে প্রবাহিত হতে হতে বর্তমান পর্যন্ত চলে এসেছে। এই স্বর্গীয় আধ্যাত্মিকতা এখন অবস্থান করছে তাদের বর্তমান ইমাম প্রিন্স করিম আগা খানের শরীরে। আগা খান তাদের ৪৯তম ইমাম। কোন পাপ বা ভুল তাকে স্পর্শ করতে পারে না। প্রতিটি ইসমাঈলিয়াকে তাদের আয়ের বারো ভাগের এক ভাগ ইমাম আগা খানের ভান্ডারে প্রদান করতে হয়। অধঃস্তনদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থে ফুলে-ঁেফপে ওঠা এই সম্পদশালী ব্যক্তিকে প্রায়ই খবরে দেখা যায়। বর্তমানে ঈসমাইলিয়া শিয়াগণ নিজারি, হাফিজি, তাইয়াবি প্রভৃতি বিভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে।

চার: আলাভী নুসাইরি বা আনসারি উপশাখা
সিরিয়ার ক্ষমতাসীন সরকারসহ তুরস্কের বেশকিছু মুসলমান আলাভী শিয়া। এরা মূলত ইসনা আশারিয়া থেকে এসেছে। এরা মনে করে, ‘আল্লাহ অনেকবার মানুষের রূপ ধরে পৃথিবীতে আগমন করেছেন। এমনকি হযরত মুহাম্মদ ও হযরত আলী ও হযরত সালমান ফার্সি’র বেশ ধরেও তিনি পৃথিবীতে এসেছেন’। অর্থাৎ হযরত মুহম্মদ, হযরত সালমান ফার্সি ও হযরত আলী ছিলেন মূলতঃ আল্লাহ (নাউজুবিল্লাজ!)। তারা পূনর্জন্মে বিশ্বাস করে।

ধর্মীয় শিয়া মতবাদের জন্ম ও প্রতিষ্ঠা
১০ মুহররম ৬১ হিজরী কারবালা প্রান্তরে ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ আহলে বাইতে রাসূলগণের মর্মান্তিক পরিণতি রাজনৈতিক শিয়া মতবাদকে রাজনীতির খোলস ছেড়ে ধর্মীয় চরমপন্থী মতবাদে রূপ দেয়। ইতহাসবিদ পি, কে হিট্টির মতে, ১০ মুহররম ‘শিয়া মতবাদ’এর জন্ম হয়। উমাইয়া খিলাফতে এদের উপর দমন-নীপিড়ন চলতে থাকে। দ্বিতীয় ওমরের সময় কিছুটা কমে। আববাসী যুগে এর স্বাতন্ত্র স্বীকৃত হয়। এ সময় প্রকাশ্যে এ মতের চর্চা করারও অনুমতি দেওয়া হয়। খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল বিল্লাহ ৮৫০ সালে খিলাফতে আরোহন করলে শিয়াদের উপর নির্যাতনের পুরোনো নীতি আবার চালু করেন। ৯৬২ খ্রিস্টাব্দে সার্বজনীনভাবে ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাতবরণ উপলক্ষে শোক প্রকাশ করা হয়। ষোড়শ শতকে যখন সাফাভি বংশ (রাজত্বকাল ১৫০১-১৭২২ খ্রিষ্টাব্দ)। পারস্যের ক্ষমতায় আসে তখন শিয়া মতবাদ প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনায় প্রচারিত হতে থাকে। সাফাভি শাসকরা শিয়া মতবাদকে পারস্যের রাষ্ট্রধর্ম করেন।

বাংলাদেশে শিয়া মতবাদ
৭১২ সালে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে মুসলিম সৈন্যবহিনী কর্তৃক সিন্ধু বিজয়ের পূর্বেই ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রবেশ করে এবং ইসলামী মতাদর্শ চর্চা শুরু হলেও রাফেয়ী তথা শিয়া মতবাদ বাংলায় প্রচারিত হয় সতেরো শতকের প্রথমভাগে। পারস্যের বণিক ও ভ্রমণকারীরা এ মতবাদ প্রচার করে। বাংলার মুঘল শাসক শাহ সুজা সুন্নি হলেও শিয়া ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর মা মমতাজ বেগম ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী। তাঁর দরবারের অনেক আমির ছিলেন পারস্যের এবং শিয়া মতানুসারী। শুধু তাই নয়, আঠারো শতকের প্রথমভাগের অধিকাংশ নবাবই ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। সুতরাং এটা নিশ্চিত যে, তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার মুসলিম সমাজে শিয়া সম্প্রদায়ের দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটেছিল। ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর এবং তাঁর অনুসারীদের শাহাদাতবরণের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নবাব মুর্শিদকুলী খান মুহররম মাসের প্রথম দশদিন ছুটি ঘোষণা করেন। কালক্রমে মুহররম বাংলার অন্যতম বৃহৎ অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। এমনকি, নবাবদের এবং শিয়া অভিজাত সম্প্রদায়ের সন্তুষ্টির জন্য হিন্দু জমিদাররাও জাঁকজমকপূর্ণভাবে মুহররম অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ নাটোর ও বর্ধমানের রাজাদের কথা উল্লেখ করা যায়। তাঁরা সারা বাংলায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় তাজিয়া নির্মাণ এবং তাজিয়া মিছিলের আয়োজন করতেন। বড় বড় জমিদারদের প্রতিটি কাচারি থেকে সঙ্গীতসহ তাজিয়া মিছিল বের হতো। এসব তাজিয়া মিছিল বিদেশী পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত এবং তাঁদের অনেকেই এ মিছিলের ছবি এঁকেছেন। ঢাকার নায়েবে-নাজিমরা ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ব বাংলার মুহররম অনুষ্ঠান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যদিও এখানকার মুসলমানদের অধিকাংশই সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত। ঢাকার নবাব খাজা আবদুল গণি ছিলেন সুন্নি সম্প্রদায়ের, কিন্তু তিনি তাঁর কাচারিতে ব্যাপকভাবে মুহররম অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। নবাব পরিবারে মুহররম অনুষ্ঠান পালনের এই ঐতিহ্য ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত অক্ষুন্ন্ ছিল। বাংলাদেশে শিয়ারা সংখ্যায় কম এবং তারা প্রধানত ঢাকা শহরে বসবাস করে। ঢাকায় এখন শিয়া সম্প্রদায়ের মুহররম পালনের প্রধান কেন্দ্র ‘হোসেনী দালান’। এটি আঠারো শতকে জনৈক শিয়া বণিক নির্মাণ করেছিলেন।

বাংলাদেশী শিয়াদের বৈশিষ্ট্য
বাংলাভাষী সুন্নী মুসলমানরা ঈমানঘাতী-বাতিল শিয়া মতবাদ ও মতবাদীদের খপ্পর হতে যাতে নিজেদের মহামূল্যবান ঈমান রক্ষা করতে পারেন এবং অন্যদেরও সতর্ক করতে পারেন তার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কৌশল নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
১. তারা বিভিন্ন সময় হযরত সৈয়্যদা ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং ইমাম খোমেনীর জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে আলোচনা সভা করে এবং প্রথম তিনজনের নামের শেষে ‘আঃ বা আলাইহিস সালাম’ শব্দটি যুক্ত করে।

২. তাদের বই-পত্র ও সাময়িকী-ম্যাগাজিনে বিভিন্ন প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র হাদিস বাদ দিয়ে তাদের ইমামগণ যেমন, ইমাম জাফর সাদিক, ইমাম বাকের, ইমাম জয়নুল আবেদীনের নামের বিভিন্ন বাণী বেশি লেখা থাকে। ইরানী দূতাবাস থেকে তাদের প্রকাশিত “নিউজলেটার” ও “কিশোর নিউজলেটার” ইত্যাদিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র হাদীসের চাইতে ইমামগণের বাণীই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে এবং তাদের ইমামদের নামের শেষে শুধুমাত্র “আঃ বা আলাইহিস সালাম” শব্দটিই লেখেন। ‘রাদিয়াল্লাহু আনহু’ বা ‘রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’ লেখেন না। অথচ সম্মাণিত সাহাবীগণ রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন এর শানে আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে এই দো’য়ামূলক বাক্যটিকে ব্যবহার করেছেন।

৩. শিয়ারা তাদের বইগুলোতে এবং ম্যাগাজিনে হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা ও তাদের বার ইমামগণের নামের শেষে ‘আলাইহিস সালাম /আঃ’ শব্দটি যুক্ত করে। অথচ আলাইহিস সালাম শব্দটি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র আগের নবী-রাসূল ও চারজন সম্মানিত ফিরিশতার (হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম, হযরত আযরাঈল আলাইহিস সালাম, হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালাম ও হযরত মীকাঈল আলাইহিস সালাম) নামের শেষে যুক্ত করা হয়।

৪. মহরম মাস এলেই তাজিয়া মিছিলে ঢোল-তবলা বাজিয়ে এবং রং-বেরংয়ের কাপড় রশির মত মুডিয়ে শরীরে পেছায়। শিকল দিয়ে আপন দেহের ডান-বাম পাশ দিয়ে আঘাত করে; যাতে রক্ত প্রবাহিত হয়।
৫. তাজিয়া মিছিলে হায় হোসেন! হায় হোসেন! বলে মাতম করে।

৬. নব্য শিয়াদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- জীবিত ব্যক্তির নামের পাশে ‘আলাইহির রাহমা’ লেখা ও বলা। (উল্লেখ্য, বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জনৈক ভন্ডও শিয়াদের টাকা খেয়ে নিজেকে ইমাম এবং তার নামের সাথে আলায়হির রহমাহ্ সংজোন করছে।

৭. দাওয়াতের কথা বলে ইমামের কথা শুনার মজলিসে নিয়ে যাওয়া।
৮. দরবারী শিয়ারা ওরছের নামে মাহফিলে হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুকে গালাগালি করা ও কাফির বলা।

৯. তথাকথিত আন্দোলনের নামে মিছিলে বেপর্দা নারীদের সামনে দিয়ে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা।
১০. যুব সমাজকে এই আন্দোলনে টানার জন্য গোপনে মু’তার নামে সুন্দরী নারীদের সাথে অবাধে মেলা মেশার সুযোগ করে দেয়া।

মূলতঃ ইসলামের প্রতি এক বিদ্বেষী মতবাদের নামই হলো ‘শিয়া মতবাদ’। শিয়া মতাদর্শের বাতুলতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। ‘শিয়া মতবাদ’ হলো মূলতঃ ইয়াহুদী মতবাদের দ্বিতীয় সংস্করণ। সুতরাং বাংলার সুন্নীরা সাবধান! আল্লাহ আমাদের হক-বাতিল মেনে চলার তাওফীক দান করুন। আমীন! বিহুরমাতি সাইয়্যিদিল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।