আনা বাশারুম্ মিসলুকুম ইয়ূহা ইলাইয়্যা’-এর আলোকে নূরী রসূলের অতুলনীয় বাশারিয়াত
‘আনা বাশারুম্ মিসলুকুম ইয়ূহা ইলাইয়্যা’-এর আলোকে নূরী রসূলের অতুলনীয় বাশারিয়াত
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি যথাযথভাবে বিশ্বাস স্থাপনই হচ্ছে ‘ঈমান’-এর মূল। এ বিশ্বাসের কথা মুখে ঘোষণা করা হচ্ছে নিজেকে মু’মিন-মুসলমান হিসেবে প্রমাণ করার পূর্বশর্ত। আর ইসলামের বিধানাবলী পালন করা হচ্ছে ওই ঈমানের পূর্ণতা বিধান করা। পক্ষান্তরে, যার মধ্যে ওই ‘বিশ্বাস’ নেই বা ওই বিশ্বাস শুদ্ধ নয়, সে ‘মু’মিন’ নয়; যে ব্যক্তি ওই বিশ্বাসের ঘোষণা দেয়নি তাকে বাহ্যিকভাবে মুসলমান বলে বিবেচনা করা যায় না; আর যে ওই বিশ্বাস রেখে মুখে ঘোষণাও দেয় কিন্তু ইসলামী অনুশাসনগুলো পালন করে না, তাকে খাঁটি ও পূর্ণাঙ্গ ঈমানদার বলার উপায় নেই। সুতরাং যার মধ্যে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের প্রতি ‘বিশ্বাস’ যথাযথ ও বিশুদ্ধভাবে রয়েছে, ঘোষণাও দিয়েছে অকপটে, ইসলামের বিধানাবলীও পালন করেছে বিশুদ্ধভাবে তাকে বলা হয় ‘মু’মিন-ই কামিল’; তাছাড়া, যার মধ্যে প্রথম দু’টি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়; কিন্তু ইসলামী অনুশাসনগুলো পালনে উদাসীন, তাকে বলা হয় ‘মু’মিন-ই ফাসিক্ব’; আর যে ইসলামী অনুশাসন পালন করে, মুখেও নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করে; কিন্তু আক্বীদা বা বিশ্বাস নেই কিংবা থাকলেও তা বিশুদ্ধ নয়, তাকে বলে ‘মুনাফিক্ব’। যে অন্তরে বিশ্বাস রাখে কিন্তু তার ঈমানের কথা প্রকাশ করেনি, সে হলো ‘সাতির’ (ঈমান গোপনকারী)। সুতরাং যার মধ্যে এর কোনটাই নেই সে যে কাফির কিংবা অমুসলমান তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কাজেই, আল্লাহ সম্পর্কে কারো মধ্যে যথাযথভাবে বিশ্বাস না থাকলে যেমন কেউ ‘তাওহীদী’ নয়, তেমনি রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে কারো ঈমান বা বিশ্বাস শুদ্ধ না হলে সেও ‘মু’মিন’ নয়। একই কারণে, আল্লাহ্ ব্যতীত বোত-প্রতিমা ইত্যাদির পূজারী ও আল্লাহর সমকক্ষ থাকায় বিশ্বাসী এবং ইসলামের অপরিহার্য বিষয়াদিতে অবিশ্বাসী, সে যেমন মুশরিক কিংবা কাফির হিসেবে বিবেচিত হতে বাধ্য, তেমনি যে আল্লাহর প্রতি ‘মিথ্যা’ ইত্যাদির অপবাদ রচনা করে এবং তাঁর রসূলকে যথাযথ মর্যাদা সহকারে বিশ্বাস করে না, সেও নিজেকে মু’মিন বলে দাবী করতে পারে না। যেমন- পৌত্তলিকরা মূর্তিপূজা করে আল্লাহর সাথে অনেক কিছুকে শরীক করে এবং আল্লাহর নবী ও রসূলকে অস্বীকার করে, ইহুদীরা হযরত ওযায়র আলায়হিস্ সালামকে আর খিস্টানরা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালামকে খোদার পুত্র বলে বিশ্বাস করে। [আল ক্বোরআন] আর দেওবন্দী-ওহাবীরা এবং তাদের আক্বীদায় বিশ্বাসীরা আল্লাহর পক্ষে মিথ্যাবলাও সম্ভব বলে বিশ্বাস করে।
[ফাতাওয়া-ই রশীদিয়া, ১ম খন্ড, পৃ. ৯ ইত্যাদি।]
মওদুদী ও তার অনুসারীরা নবী ও রসূলগণকে গুনাহ্গার, এমনকি বড় বড় নবীগণ বড় গুনাহ্ করেছেন, দোষে গুণে মানুষ ইত্যাদি বলেও বিশ্বাস করে। [তাহফীমুল ক্বোরআন, রসাইলে মাসাইল ইত্যাদি]
বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ‘তাওহীদ’ (আল্লাহর একত্ববাদ)-এর বিষয়ে নাস্তিকদের পক্ষ থেকে যত বাড়াবাড়ি, তার চেয়ে একশ্রেণীর মানুষকে বেশি বাড়াবাড়ি করতে দেখা যায় ‘রিসালত’-এর মর্যাদার বিষয়ে। কারণ, অনেক অমুসলমানও যেখানে ‘তাওহীদ’কে অস্বীকার করে না, সেখানে অমুসলমানদের সাথে এক শ্রেণীর মুসলমান বলে পরিচয়দাতাদেরকেও রসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মান-মর্যাদা নিয়ে অযথা বাড়াবাড়ি, এমনকি অস্বীকার করতেও দেখা যায়। আল্লাহ্ পাকের অসাধারণ, অতুলনীয় ও নূরানী রসূলকে তারা তাদের মতো সাধারণ মানুষ, মাটির মানুষ, দোষেগুণে মানুষ ইত্যাদি পর্যন্ত বলার দুঃসাহস দেখায়, আর তাঁর অসাধারণত্ব, অতুলনীয়তা এবং নূরানিয়াত জ্ঞাপক অকাট্য প্রমাণাদির, এমনকি পবিত্র ক্বোরআন-হাদীসেরও অপব্যাখ্যা তালাশ করে, যা তাদের ঈমানকেও ধ্বংস করে দেয়, তাকে করে আল্লাহর কঠিন শাস্তির উপযোগী। পক্ষান্তরে, প্রকৃত ঈমানদার, আল্লাহ্ ও তাঁর হাবীবের মর্যাদার প্রতি সচেতন এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের প্রতি ভালবাসার অধিকারী (সুন্নী মুসলমান) নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে নূরের তৈরী, বাহ্যিকভাবে মানবীয় আবরণে প্রেরিত, অতুলনীয় ও অসাধারণ, সর্বোপরি, আল্লাহ পাকের সর্বাপেক্ষা বেশী প্রিয় বান্দা ও সত্তা বলে বিশ্বাস করেন, মানেন ও অনুসরণ করেন। আর বাহ্যিক দৃষ্টিতে এর পরিপন্থী কোন কিছু পাওয়া গেলে কিংবা বাতিলপন্থীদের পক্ষ থেকে কিছু পেশ করা হলে সেগুলোর সঠিক, উপযোগী ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা খুঁজে বের করেন এবং উপস্থাপন করেন। অন্যভাবেও বলা যায়- বিশ্বনবীর অসাধারণ মর্যাদাকে মূল ও বাস্তব মনে করেন, আর এর বিপরীত কিছু কেউ উপস্থাপন করলে সেগুলোকে ‘ব্যাখ্যা-সাপেক্ষ এবং কোন বিশেষ কারণ ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটিত’ বলে বিশ্বাস করেন ও প্রমাণ করেন। বস্তুত সেটাই বাস্তব ও সঠিক বলে প্রমাণিত, সর্বোপরি নিরাপদ ও উপকারী বলে সাব্যস্ত। উল্লেখ্য, এখানেই সুন্নী ও অসুন্নীদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণিত হয়ে যায়।
উদাহরণস্বরূপ ফটোকে হারাম জানে এমন কোন এক অসুন্নীকে বলা হয়েছিলো, ‘‘আমার হাতে আল্লাহর নবীর একটা ফটো (কাল্পনিক) পৌঁছেছে। সেটা আমি কি করবো?’’ তখন সে বললো, ‘‘ফটো হারাম জিনিষ, তাই, সেটাকে নালায় ছুঁড়ে মারো।’’ কিন্তু একজন সুন্নী বিজ্ঞ ব্যক্তিকে যখন সেটা বলা হলো এবং সমাধান চাওয়া হলো, তখন তিনি বললেন, ‘যেহেতু ওই ফটোকে সম্মানিত নবীর দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে, সেহেতু সেটাকে একটি স্বর্ণের থালায় রেখে মুশ্ক-আম্বর ও গোলাবজল দিয়ে সযতেœ ঘষে মুছে ফেলো।’ ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্তি সম্পূর্ণ অপবিত্র ও হারাম। পৌত্তলিকরা কা’বা শরীফে হযরত ইসমাইল আলায়হিস্ সালামেরও একটি মূর্তি স্থাপন করেছিলো বলে প্রমাণ মিলে। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের সময় কা’বা শরীফের ভিতর থেকে অন্যসব মূর্তিকে তো অতি লাঞ্ছিত করে অপসারণ করা হয়েছিলো; কিন্তু যখন হযরত ইসমাইল আলায়হিস্ সালামের মূর্তি অপসারণের পালা আসলো তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর মূর্তিটাকে দাফন করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাও নবীর প্রতি ‘সম্পৃক্ততা’র প্রতি সম্মান দেখিয়ে, মূর্তির প্রতি অবশ্যই নয়।
অনুরূপ, পবিত্র ক্বোরআন ও হাদীস শরীফে বর্ণিত এবং সম্মানিত সাহাবা-ই কেরাম ও ইসলামী বরেণ্য মনীষীদের আক্বীদা ও অভিমতানুসারে, আমাদের আক্বা ও মাওলা হুযূরে আকরাম বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নূরের তৈরী, বাশারিয়াত (মানবীয়তা) তাঁর বাহ্যিক আবরণ এবং তাঁর একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। একাধারে এ ‘নূর হওয়া’ ও ‘মানব হওয়া’ একই সত্তায় সমন্বিত হয়েছে আল্লাহ্ পাকের বিশেষ সৃষ্টি-কৌশল ও ক্ষমতায়। তাই, তিনি স্বভাবগতভাবে নিষ্পাপ (জিবিল্লীভাবে মা’সূম), অসাধারণ ও অতুলনীয় ‘নূরী মানব’। আহলে সুন্নাতের আক্বীদানুসারে, এটাই বাস্তব ও সঠিক। কারণ, হুযূরের ‘নূরানিয়াত’ ও ‘বাশারিয়াত’ উভয়টিই পবিত্র ক্বোরআন ও সুন্নাহ ইত্যাদি দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। তাই, হুযূরের এ উভয় বৈশিষ্ট্যের একটিকে মেনে অপরটিকে অস্বীকার করার কোন অবকাশ বা উপায় নেই। কোন একটিকে মেনে অপরটিকে অস্বীকার করলে ঈমানতো বিশুদ্ধ হবেই না, থাকলেও তা বিনষ্ট হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, বিশ্বনবী হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে নীরেট নূর মেনে তাঁর ‘বাশারিয়াত’কে অস্বীকার করে এমন কেউ আছে বলে আমার জানা নেই, কিন্তু হুযূরকে নিছক ‘বাশার’ (মানুষ), তাদের মতো মানুষ, এমনকি মাটির মানুষ বলে বিশ্বাস করে তাঁর ‘নূরানিয়াত’ (নূর থেকে সৃষ্টি হওয়া)কে অস্বীকার ও অবিশ্বাস করার এবং তা লিখার ও বলার মানুষও রয়েছে। তারা হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে এমনি অ-ইসলামী আক্বীদা পোষণ করে ‘বিশ্বনবীর নূর’ সম্পর্কিত সব অকাট্য প্রমাণকে হয়তো উপেক্ষা নতুবা ওইগুলোর অপব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। তাই, আমি এ নিবন্ধে হুযূর পুরনূরের ‘নূরানিয়াত’ (নূরের সৃষ্টি ও নূর হওয়া) এবং তাঁর ‘বাশারিয়াত’ (বাহিক্যভাবে বাশার বা মানব হওয়া) এবং তাঁর মধ্যে ওই ‘নূরানিয়াত’ বা ‘বাশারিয়াত’-এর সমন্বয় হওয়া সম্পর্কিত প্রমাণাদি উল্লেখ করে হুযূরের ‘অতুলনীয় বাশারিয়াত’ সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছিঃ
হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে খোদ্ মহান ¯্রষ্টা আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ ফরমায়েছেন, ‘ক্বাদ-জা-আকুম মিনাল্লাহি ‘নূ-রু ওয়া কিতা-বুম্ মুবীন’।
[সূরা মা-ইদাহ্, আয়াত-১৫]
তরজমা: নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হতে একটা নূর এসেছে এবং স্পষ্ট কিতাব। [কানযুল ঈমান] তাছাড়া, ‘সূরা আন্-নূর’-এর ৩৫নং আয়াত ও ‘সূরা আহযাব-এর ৪৫নং আয়াতেও হুযূরকে ‘নূর’ হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে মর্মে এরশাদ হয়েছে। বিশেষতঃ ‘নিশ্চয় তোমাদের নিকট একটি নূর এসেছে’ আয়াতাংশটির তাফসীরে ‘নূর’ হিসেবে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামই তাশরীফ এনেছেন মর্মে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে, সব নির্ভরযোগ্য তাফসীর ও অন্যান্য গ্রন্থে। যেমন-তাফসীর-ই রূহুল মা‘আনী, খাযিন, মাদারিক, বায়দ্বাভী, রূহুল বয়ান, কবীর, জালালাঈন, জুমাল, মাযহারী, জামে‘উল বয়ান, দুররে মানসূর, সাওয়ত্বি‘উল ইলহাম (তাফসীর-ই বে-নুক্বাত্ব), জামে‘উত্ব ত্বাবারী, তাফসীর-ই ইবনে আব্বাস, সেরাজে মুনীর, তাফসীর-ই আবুস্ সা‘ঊদ, সাভী, হোসাঈনী, মা‘আলিমুত্ তানযীল, কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান ও নুরুল ইরফান ইত্যাদি, তাছাড়া শরহে যারক্বানী, শেফা শরীফ, শরহে শেফা শরীফ, নসীমুর রিয়াদ্ব, আল-মুফরাদাত, মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ্, আত্-তাহ্ক্বীক্বুল হাক্বীক্ব ফী নূরিন নবিয়্যিশ শফীক্ব (বিশ্বনবীর নূর) ইত্যাদি।
দ্বিতীয়তঃ ইমাম শিহাব উদ্দীন আহমদ ক্বাস্তলানী প্রণীত প্রসিদ্ধ কিতাব ‘মাওয়াহিব-ই লাদুন্নিয়া’: ১ম খন্ড, ৯ম পৃষ্ঠায় হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে পাকে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমায়েছেন, ‘হে জাবির! নিশ্চয় সমস্ত বস্তুর পূর্বে আল্লাহ্ পাক স্বীয় নূর থেকে তোমার নবীর নূরকে সৃষ্টি করেছেন।’’ এরপর দীর্ঘ হাদীসে হুযূর পুরনূর থেকে অন্যান্য সৃষ্টি পয়দা করার বিবরণ এসেছে। তাছাড়া, মিরক্বাত, খাসাইসে কুবরা, সীরাত-ই হালাবিয়াহ, সীরাতে নবভী (কৃত ইবনে হিশাম), আল্লামা ইবনে জরীর কৃত বয়ানুল মীলাদিন্ নবভী, কিতাবুল আনওয়ার ওয়াল মিসবাহিল সুরূরি ওয়াল আফকার, ওয়াফাউল ওয়াফা, হুজ্জাতুল্লাহি আলাল আলামীন, দালাইলুন্ নুবূয়ত, মিশকাত শরীফ, তিরমিযী শরীফ, আল-ইস্তি‘আব, বোখারী শরীফ, মাত্বালি‘উল মুসাররাত, মাদারিজুন্নুবূয়ত, শেখ সাদী কৃত বোস্তাঁ, আ’লা হযরত কৃত হাদাইক্বে বখশিশ ও মৌং আশরাফ আলী থানভীর নশরুত্ব ত্বীব ইত্যাদিতে একথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিশ্বনবী নূর থেকে সৃষ্ট, তাই তিনি নূরী সত্তা আর ‘বাশারিয়াত’ হচ্ছে তাঁর বাহ্যিক রূপমাত্র।
তৃতীয়ত, বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নূরানিয়াতের সাথে বাশারিয়াতের সমন্বয় ঘটানো মহান ¯্রষ্টার জন্য মোটেই অসম্ভব নয়। বাস্তবেও তাই ঘটেছে। নূরী সত্তার মধ্যে বাশারিয়াতের রূপ সন্নিবিষ্ট হবার প্রমাণও ক্বোরআন এবং বিশুদ্ধ হাদীস শরীফে পাওয়া যায়। যেমন, ‘সূরা মরিয়মের ১৭নং আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমায়েছেন, ‘‘তারপর তার (মরিয়ম) প্রতি আপন ‘রূহানী’ (জিব্রাঈল)কে প্রেরণ করেছি। সে তার সামনে একজন সুস্থ-সুঠাম মানুষরূপে আত্মপ্রকাশ করলো।’’ তাছাড়া, মিশকাত শরীফের ১১ নং পৃষ্ঠায় প্রসিদ্ধ হাদীস-ই জিব্রাঈলে বর্ণিত হয়েছে, একদা হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম হুযূরের দরবারে এসেছিলেন। তখন তাঁর পরনে ছিলো ধবধবে সাধা কাপড় আর চুল ছিলো গাঢ় কালো। এতে তো হযরত জিব্রাঈলের নূরানিয়াত বিলুপ্ত হয়নি। তখন তাঁর মধ্যে নূরানিয়াত ও বাশারিয়াতের সমাবেশ ছিলো অনায়াসে। সুতরাং আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন ‘নূরী বাশার’। অন্যভাবে বলতে হয় তিনি হলেন বাহ্যিকভাবে বাশার; কিন্তু হাক্বীক্বতের মধ্যে নূর। এটাই বাস্তব, এটাই ইসলামী আক্বীদা। সুন্নী মুসলমান মাত্রই এটা বিশ্বাস করে। মহান ¯্রষ্টার এ অনন্য সৃষ্টির মধ্যে তাঁরই প্রদত্ত ও ওই দু’টি বৈশিষ্ট্যকে মেনে নিলে অসুবিধার কিছুই নেই; এমন বাস্তবতায় বিশ্বাস করার মধ্যে কেউ আপ্রাণ চেষ্টা করলেও শির্কের নাম গন্ধ খুঁজে পাবে না; বরং হুযূরের কোন একটি খোদাপ্রদত্ত বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করলে তার ঈমান যাবার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি।
কিন্তু কিছুলোক বিশ্বাস করে সম্পূর্ণ উল্টোটাই। হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নাকি তাদের মতো মানুষ, নিছক রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ, মাটির তৈরী মানুষ, দোষেগুণে মানুষ, আরো কতো কি! (উল্লেখ্য, এমন আক্বীদা পোষণ করে নজদী ওহাবী, দেওবন্দী ও মওদূদী মতবাদীরা। সূত্র তাক্বভিয়াতুল ঈমান, মাসিক মুঈনুল ইসলাম, ইসলামে নবীর মর্যাদা ইত্যাদি ওহাবী ও মওদূদী মতবাদী বই-পুস্তক ও ম্যাগাজিন) তাদের প্রধান দলীল সূরা কাহ্ফের ১১০নং আয়াত ‘‘ক্বুল ইন্নামা… আনা বাশারুম মিসলুকুম ইয়ূহা-ইলাইয়্যা..আল-আয়াত।’’ (আপনি বলুন, প্রকাশ্য মানবীয় আকৃতিতে, আমি তোমাদের মতো, আমার প্রতি ওহী আসে.. আল-আয়াত, তরজমা, কানযুল ঈমান] তারা এ ধরনের আরো কিছু আয়াত ও ব্যাখ্যাযোগ্য ঘটনা পেশ করে থাকে। এখন দেখুন তাদের উপস্থাপিত ওই আয়াতের প্রকৃত তাফসীর বা ব্যাখ্যা কি এবং তাদের দাবীর জোরও কতটুকু।
প্রথমে দেখুন, সূরা কাহফের উক্ত আয়াত শরীফটুকু। এ আয়াতের ‘কু¦ল’, ‘বাশার’ ‘মিসলুকুম’ এবং ‘ইয়ূ-হা ইলাইয়্যা’ (যথাক্রমে ‘আপনি বলুন,’ ‘মানুষ’ ও ‘তোমাদের মতো’ এবং ‘আমার প্রতি ওহী আসে’)- এ চারটি বিষয় নির্ভরযোগ্য তাফসীরের আলোকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে বুঝা যাবে আহলে সুন্নাতের সত্যতা আর বিরুদ্ধবাদীদের জ্ঞান ও ঈমানের দীনতা ও পথভ্রষ্টতা।
প্রথমত, নূরী রসূলকে ‘বশর’ বলে ঘোষণা দিতে বলার হিকমত হচ্ছে, মানুষ সমস্ত জিনিষের হাক্বীক্বত (বাস্তব অবস্থা) জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে; কিন্তু নিজের ব্যাপারে সে উদাসীন। অথচ যে নিজেকে চিনেছে সে খোদ্ মহান রবকে চিনেছে। ‘মান (আরাফা নাফসাহু ফাক্বাদ আরাফা রাব্বাহু’।) কোন বাতিলও মিথ্যা ধর্ম বলতে পারেনি, ইনসানের বাস্তব অবস্থা কি? কোন কোন তথাকথিত ধর্ম মানুষকে এতো উপরে তুলেছে যে, খোদাকে পর্যন্ত অস্বীকার করেছে এবং নিজে খোদা সেজে বসেছে কিংবা মানুষকে খোদার সমকক্ষ দাঁড় করিয়েছে। কোন কোন আসমানী ধর্মকে বিকৃত করে কিছু সংখ্যক বিবেকহীন মানুষ সম্মানিত নবীগণকে খোদা, খোদার পুত্র কিংবা খোদার শরীক বানিয়ে নিয়েছে। আরেক শ্রেণীর বোকা মানুষ ওই সম্মানিত নবী ও রসূলকে নিজেদের মতো অকেজো বা ত্রুটিপূর্ণ মানুষ বলে বিশ্বাস করে নিয়েছে। বলাবাহুল্য, প্রথমোক্ত লোকেরা ইফরাত্ব (অতিরঞ্জিত) আর শেষোক্ত লোকেরা তাফরীত্ব (শৈথিল্য) করেছে। ইসলাম উভয় প্রকারের দোষ থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। ইসলামের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ যেন সীমাতিক্রম না করে, সম্মানিত নবীগণের ব্যাপারেও যেন ইফরাত্ব বা তাফরীত্ব না করে।
হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর কয়েকটা মাত্র মু’জিযা দেখে লোকেরা তাঁকে খোদার পুত্র বলে ফেলেছে; নিজেরা সিটকে পড়েছে তাওহীদের গন্ডী থেকে অনেক দূরে। কারণ, তখন হযরত মরিয়মকে খোদার স্ত্রী ও স্বয়ং আল্লাহ্ পাককে জনক আর তাঁদের প্রত্যেককেই খোদা বলে বসেছে। অনুরূপ, হযরত ওযায়র আলায়হিস্ সালামের মু’জিযাদি দেখে ইহুদীরা তাঁকে খোদার পুত্র বলে ফেললো। সবশেষে আমাদের আক্বা ও মাওলা নবীকুল সরদার হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শুভ আবির্ভাব হলো। আল্লাহ্ পাক ঘোষণা করলেন, ‘‘নিঃসন্দেহে তোমাদের নিকট নূর এসেছে।’’ ‘‘নিশ্চয় তোমাদের নিকট ‘বোরহান’ (আপাদমস্তক শরীফ মু’জিযা) এসেছে’’, ইত্যাদি। বাস্তবেও তাই ঘটেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা হুযূর মোস্তফার নূরানিয়াত দেখলো। দেখলো- অগণিত মু’জিযা। আর খোদাপ্রদত্ত অসাধারণ ক্ষমতা ও মর্যাদা। তারা আঙ্গুল মুবারকের ইঙ্গিতে আকাশের চাঁদ দ্বিখন্ডিত হতে দেখলো, ডুবন্ত সূর্য উঠে আসতে দেখলো, গাছপালা ও পশুদেরকে তাঁকে সাজদা ও সালাম করতে দেখলো ও শুনলো। তারা তাঁর নাম মুবারকের বরকতে মৃত জীবিত হতে দেখলো ইত্যাদি। সুতরাং আশঙ্কা ছিলো অজ্ঞ লোকেরা ওই পবিত্র সত্তাকেও খোদা বলে বিশ্বাস করে বসে কিনা। এর জঘন্য কুফল থেকে বাঁচানোর জন্য ইসলামের প্রবর্তক রহমাতুল্লিল আলামীন নিজের প্রতিটি কাজে নিজের আবদিয়াত (আল্লাহর বান্দা হওয়া)’রই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এ আয়াতে নিজের বাশারিয়াতের ঘোষণা দিলেন, মুসলমানদের মাধ্যমে ‘আবদুহূ ওয়া রসূলুহু’ (তাঁর বান্দা ও রসূল) পড়িয়েছেন, যাতে মানুষ তাঁর মু’জিযাদি দেখে তাঁকে খোদা বলে না বসে।
অথবা বিনয় প্রকাশের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর মাধ্যমে এ ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং কেউ যদি হুযূরের এ ঘোষণার কারণ ও হিকমত না বুঝে কিংবা বুঝেও না বুঝার ভান করে, তবে তো পথভ্রষ্টতা ও অশুভ পরিণাম অনিবার্য।
দ্বিতীয়ত, ‘ক্বুল’ (আপনি বলুন!) দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ‘বাশারুম্ মিসলুকুম’ (তোমাদের মতো মানুষ) বলার অনুমতি শুধু হুযূরকেই দেওয়া হয়েছে, প্রত্যেককে দেননি; অন্যথায় ‘ক্বুলূ’- তোমরা বলো) বলে সম্বোধন করা হতো। এখন যদি ‘ক্বুল হুয়াল্লা-হু আহাদ’ (আপনি বলুন, তিনি আল্লাহ্ এক)কে পেশ করে আপত্তি করা হয় যে, ‘আল্লাহ্কে এক বলার অনুমতিও কি শুধু হুযূরকে দেওয়া হয়েছে? অন্য কেউ কি তা বলতে পারবে না?’ তখন উত্তরে বলবো, সেখানেও দু’টি বিষয় লক্ষ্যণীয়। একটি হচ্ছে হুযূরের অনুসরণে যদি আল্লাহর একত্ববাদ ঘোষণা করা হয়, তাহলেই তা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে। হুযূরের বাতলানো তাওহীদের মোকাবেলায় কেউ যদি নিজের মনগড়া তাওহীদে বিশ্বাসী হয় অথবা হুযূরের উপর ঈমান না এনে তাওহীদের ঘোষণা দেয়া হয়, তবে তা গ্রহণযোগ্য হবেনা। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে ক্বোরআনে করীমে অন্যান্য জায়গায় সাধারণভাবে মুসলমানদেরকে তাওহীদ ঘোষণা দেওয়ার হুকুম দেওয়া হয়েছে; কিন্তু ক্বোরআন মজীদের কোথাও নবীকে ‘বশর’ (নিছক মানুষ) বলে সম্বোধন করার অনুমতি দেওয়া হয়নি; বরং ‘বশর’ বলা কাফিরদেই উক্তি বলে এরশাদ করা হয়েছে, ‘‘ফাক্বা-লূ… আবাশারুইঁ ইয়াহ্দূ-নানা- ফাকাফারা- ওয়াতাওয়াল্লাউ’’।
[তরজমা: তখন তারা বলেছে, মানুষই কি আমাদেরকে পথ প্রদর্শন করবে? সুতরাং তারা কাফির হয়ে গেছে এবং ফিরে গেছে। [কানযুল ঈমান, সূরা তাগাবুন: আয়াত-৬]
‘ক্বা-লূ- মা— আনতুম ইল্লা- বাশারুম্ মিসলুনা-।’ তরজমা: তারা বললো, ‘তোমরাতো আমাদের মতোই মানুষ। কানযুল ঈমান, সূরা ইয়াসীন, আয়াত-১৫] ‘‘ওয়া লাইন আত্বোয়া’তুম বাশারাম মিসলাকুম ইন্নাকুম ইযাল্ লাখা-সিরূ-ন।’’ [তরজমা: এবং (তারা বললো) যদি তোমরা তোমাদের মতো কোন মানুষের আনুগত্য করো তবে তো তোমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। [কানযুল ঈমান, সূরা মু’মিনুন, আয়াত-৩৪]
সুতরাং বুঝা গেলো যে, ‘বাশার’ বলার অনুমতি শুধু হুযূরকেই দেওয়া হয়েছে, অন্য কাউকে নয়। তাই, আমাদেরকে হুযূরের ‘বাশারিয়াত’-এর বৈশিষ্ট্যে ঈমান রাখতে হবে; কিন্তু নিছক মানুষ, আমাদের মতো মানুষ ইত্যাদি বলে হুযূরের মানহানি করার অনুমতি নেই বরং হুযূরের মানহানি করলে সেটার পরিণাম হবে ভয়াবহ।
তদুপরি, হযরত আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী প্রমুখ মুহাক্বক্বিক্ব বলেছেন, এ আয়াত (ক্বুল ইন্নামা আনা বশরুম মিসলুকুম) ‘মুতাশাবিহ্ (দ্ব্যর্থবোধক) আয়াতগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এর সঠিক অর্থ আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলই ভাল জানেন।
তাছাড়া, নিয়ম হচ্ছে- যাঁকে বিশেষ গুণে ভূষিত করা হয়, তাঁকে সাধারণ গুণবাচক নামে ডাকলে তাঁর মানহানি হয়। যেমন- যিনি প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী, খান বাহাদুর, নবাব সাহেব ও কালেক্টর সাহেব ইত্যাদি কোন সম্মানিত পদে ভূষিত, তাঁকে যদি কেউ তার পদবী বাদ দিয়ে সাধারণ মানুষ হিসেবে সম্বোধন করে, তবে তা মানহানিজনিত শাস্তি কিংবা অভিযোগের শিকার হবে। সুতরাং যেই পবিত্র অনন্য সত্তাকে আল্লাহ্ তা‘আলা নবী, রসূল, মুযযাম্মিল, মুদ্দাস্সির, নূর, বোরহান, উজ্জ্বল প্রদীপ ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করেছেন, তাঁকে যদি কেউ বলে সাধারণ মানুষ, এমনকি দোষে-গুণে মানুষ ইত্যাদি, তবে ওই হতভাগার কি অবস্থা হতে তাতো সহজে অনুমেয়। এখানে আরো লক্ষণীয় যে, হুযূরকে কীভাবে সম্বোধন করতে হবে, তাও শিক্ষা দিয়েছেন খোদ্ আল্লাহ্ তা‘আলা। তিনি নিজে তাঁর নাম ধরে সম্বোধন না করে বরং উপাধি সহকারে সম্বোধন করেছেন ‘ইয়া আইয়্যুহান্ নাবিয়্যু’ (হে অদৃশ্যের সংবাদদাতা, নবী), ‘ইয়া আইয়্যুহার রসূ-ল’ (হে রসূল), ‘ইয়া মুযযাম্মিলু’ (হে মুযযাম্মিল), ‘ইয়া মুদ্দাস্সিরু (হে মুদ্দাস্সির) ইত্যাদি। পক্ষান্তরে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে এরশাদ করেছেন, ‘‘ওয়ালা- তাজ’আলূ- দু‘আ—-র রাসূ-লি বায়নাকুম কাদু‘আ—-ই বা’দ্বিকুম বা’দ্বোয়া…। আল-আয়াত।
রসূলের আহ্বানকে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে তেমনি স্থির করানো যেমন তোমরা একে অপরকে ডেকে থাকো…। আল-আয়াত। তরজমা-কানযুল ঈমান, সূরা আননূর: আয়াত-৬৩]
তৃতীয়ত, ‘আনা বাশারুম্ মিসলিকুম’-এর মধ্যে ‘বাশার’ এরশাদ হয়েছে, ‘ইনসান’ও বলা হয়নি, ‘আদমী’ও বলা হয়নি। ‘বাশার’ মানে ‘যূ-বাশারাতিন’ (বাশারাতুন্ বা ত্বকধারী), যেমন ‘হাসানুন’ মানে ‘যূ- হুসনিন’ (হুস্ন বা সৌন্দর্যের ধারক)। সুতরাং ‘ইন্নামা আনা বাশারুম্ মিসলুকুম’-এর অর্থ হচ্ছে- বাহ্যিক রং, রূপ, চেহারা ও আকৃতিতে আমি তোমাদের মতো, কিন্তু ‘ইয়ূ-হা—ইলাইয়্যা।’’ অর্থাৎ ‘আমার প্রতি ওহী আসে।’ আর যদি ‘বাশার’ না বলে ‘ইনসান’ বা ‘আদমী’ এরশাদ হতো, তবে আয়াতের অর্থ দাঁড়াতো- দেহ ও আত্মায় আমি তোমাদের মতো। কারণ, এ উভয়ের সমন্বয়ের নাম ‘ইনসান’ ও ‘আদমী’। অথচ নবীর আত্মা ও আমাদের আত্মা এক নয়। সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর হাবীবকে ‘বাশার’ বলে ঘোষণা দেওয়ানোর মাধ্যমে একথা জানিয়ে দিয়েছেন যে, সামঞ্জস্য শুধু বাহ্যিক চেহারা ও আকৃতিতে; কিন্তু হাক্বীক্বতের দিক দিয়ে বিরাট ব্যবধান রয়েছে। তাঁর হাক্বীক্বত নূর। সুতরাং তাঁর এ নূরী বাশারিয়াত (নূরী মানব হওয়া) ‘মালাকিয়াত’ (ফিরিশতাদের হাক্বীক্বত) অপেক্ষাও বেশি শক্তিশালী। মি’রাজে ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’য় হযরত রূহুল আমীন জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম-এর ফিরিশতা সুলভ ক্ষমতা শেষ হয়ে গিয়েছিলো। তিনি আর একটি লোম পরিমাণও অগ্রসর হতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। অথচ হুযূর-ই আক্রাম অনায়াসে অগ্রসর হয়ে লা-মাকানে আল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন। সমস্ত নবীও নূরের তৈরী। হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম হযরত মালাকুল মাওতকে চড় মেরেছিলেন। তখন তাঁর ফিরিশতাসুলভ ক্ষমতা হযরত মূসা আলায়হিস্ সালামের নূরানিয়াত সমন্বিত বাশারিয়াতের আঘাত সহ্য করতে পারে নি। তাঁর চোখ বের হয়ে পড়েছিলো। সুতরাং বুঝা গেলো যে, নবীগণের নূরী-বাশারিয়াত ফিরিশতাদের মালাকিয়াত অপেক্ষাও উচ্চ পর্যায়ের।
আরো লক্ষণীয় যে, আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘মিসলুকুম’ (তোমাদের মতো)। আর সহীহ্ হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, ‘‘আইয়্যুকুম মিসলী ইয়ুত্ব‘ইমুনী রাব্বী ওয়া ইয়াস্ক্বী-নী’) (তোমাদের মধ্যে আমার মতো কে আছো? আমাকে আমার রব পানাহার করান।) [নূরুল আনওয়ার: সওম-ই ভিসাল]
অন্য হাদীস শরীফে হুযূর এরশাদ ফরমাচ্ছেন, ‘ওয়ালা-কিন্নী লাসতু কাআহাদিম্ মিনকুম’ (অর্থাৎ কিন্তু আমি তোমাদের কারো মতো নই।) সুতরাং স্পষ্ট হলো যে, হুযূরকে ‘বশর’ বাহ্যিক আকৃতিতেই অন্য মানুষের মতো বলা হয়েছে।
আর হাদীসশরীফগুলোতে হুযূরের হাক্বীক্বত বা বাস্তব অবস্থাদির কথা বলা হয়েছে, যেমনিভাবে কেউ ‘যায়দুন্ কা-আলসাদ, (যায়দ সিংহের মতো) বললে যায়দের সামঞ্জস্য সিংহের সাথে বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্যে (সাহসিকতা) বুঝানো হয় মাত্র, সবদিক দিয়ে বুঝানো হয়না।
চতুর্থতঃ আয়াতে ‘আনা বাশারুম মিসলুকুম’ (আমি তোমাদের মতো)-এর পরপরই কোন ওয়াক্বফ বা বিরতি ছাড়াই ‘ইয়ূ-হা ইলাইয়্যা’ (আমার প্রতি ওহী আসে) এরশাদ হয়েছে। সুতরাং যৌক্তিক সংজ্ঞানুসারেও ‘বাশারুন’-এর দ্বিতীয় এ গুণটি এমন এক বৈশিষ্ট্য, যা হুযূরকে অন্য সব ‘বাশার’ থেকে অনন্য ব্যবধান সহকারে পৃথক করে দেখায়। নবী ও উম্মতের মধ্যে এ ব্যবধান (ওহী আসা) একটি অকল্পনীয় ব্যবধান। যেমন- যদি বলা হয়, ‘মানুষ বাকশক্তি সম্পন্ন প্রাণী’ তবে ‘বাকশক্তিসম্পন্ন’ বৈশিষ্ট্যটি মানুষকে দুনিয়ার অন্যসব প্রাণী থেকে আলাদা করে দেয়। সুতরাং ‘আমার নিকট ওহী আসে’ বৈশিষ্ট্যটিও হুযূরকে সাধারণ মানুষ থেকে পৃথক করে দেয়। আর ‘আনা সাইয়্যেদু ওলদে আদাম লা-ফাখরা’ (আমি আদম সন্তানদের সরদার…)’ এর মতো সহীহ্ হাদীস শরীফগুলো এবং অন্যান্য বহু অকাট্য প্রমাণ হুযূরের নবীগণেরও সরদার হওয়াও প্রমাণিত হয়। সুতরাং কেউ যদি ক্বোরআন থেকে দলীল দিতে গিয়ে ‘আনা বাশারুম্ মিসলুকুম’ পর্যন্ত পড়ে ‘ইয়ূ-হা ইলাইয়্যা’-কে বাদ দেয়, তবে তা তবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও জঘন্য ভ্রান্তি, যা মানুষকে ঈমানের গন্ডি থেকেও বের করে দেবে। নবীর মানহানি করতে গিয়ে, তা তাকে ঈমানহারা হতে বাধ্য করবে যেমন- মদ হারাম করার প্রাথমিক পর্যায়ে, অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘লা- তাক্বরাবুস্ সোয়ালা-তা ওয়া আনতুম সুকা-রা।’ (অর্থাৎ] তোমরা নামাযের নিকটে যেওনা তোমাদের নেশাগ্রস্ত অবস্থায়।) এখন যদি কেউ আয়াতের শেষাংশ বাদ দিয়ে পড়ে, তবে তো নামাযই সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। (না‘ঊযুবিল্লাহ্)
পরিশেষে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নূরের তৈরী। তিনি ‘বাশারিয়াত’ বা মানবের রূপে দুনিয়ায় তাশরীফ এনেছেন। ‘বশর হওয়া’ নূর নবীর অসংখ্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি বিশেষ গুণ।
সুতরাং হুযূর-ই আক্রামের বশরিয়াতকে মেনে নেওয়া যেমন অপরিহার্য, তেমনি হুযূর-ই আক্রামের নূরানিয়াত (নূর হওয়া)কেও মেনে নেওয়া একান্ত অপরিহার্য।