জানাযার পর দো‘আ
জানাযার নামাযের পর দো‘আ করা জায়েয; বরং উত্তম
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
======
মুসলমান মৃত্যুবরণ করার পর তার তিন অবস্থাঃ
জানাযার নামাযের পূর্বে, জানাযার নামাযের পর দাফনের পূর্বে এবং দাফনের পর- এ তিনটি অবস্থায় মৃতের জন্য দো‘আ করা ও ঈসালে সাওয়াব করা জায়েয, বরং উত্তম। অবশ্য তাকে গোসল দেওয়ানোর পূর্বে কেউ যদি তার নিকটে বসে ক্বোরআন পড়তে চায়, তবে শবদেহটি যেন ঢেকে দেওয়া হয়; কেননা, তখন সে নাপাক। যখন তাকে গোসল দিয়ে দেওয়া হয়, তখন যে কোনভাবে ক্বোরআন-তিলাওয়াত ইত্যাদি করা যাবে। কিছুলোক জানাযার নামাযের পূর্বে এবং দাফনের পর দো‘আ ইত্যাদি করা জায়েয মনে করে; কিন্তু জানাযার নামাযের পর দাফনের পূর্বে দো‘আ করা না-জায়েয, হারাম, বিদ্‘আত ও শির্ক, জানিনা আরো কি কি বলে বেড়ায়। সুতরাং এ নিবন্ধে এ মাসআলার তাহক্বীক বা বিশ্লেষণধর্মী আলোচনার প্রয়াস পাচ্ছি। দেখুন এর পক্ষের দলিলাদি-
এক. মিশকাত শরীফ: বাবু সালাতিল জানাযা: ফসলে সানী (অধ্যায়: জানাযার নামাযের বিবরণ: দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)-তে উদ্ধৃত اِذَا صَلَّيْتُمْ عَلَى الْمَيِّتِ فَاَخْلِصُوْا لَهُ الدُّعَآءَ (যখন তোমরা মৃত ব্যক্তির উপর নামায (জানাযার নামায) পড়ে নেবে, তখন তাঁর জন্য খাঁটি দো‘আ করো। এখানে ‘ف’ (ফা) বর্ণ এসেছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, নামাযের পর তাৎক্ষণিকভাবে দো‘আ করা হবে; বিলম্ব না করেই। যেসব লোক এর অর্থ বলে- ‘নামাযের মধ্যে তার জন্য দো‘আ করো। তারা فَاَخْلِصُوْا -এর ‘ف’-এর দিকে দৃষ্টিটুকু নিবদ্ধ করে না। ‘ف’ বর্ণটি ‘অব্যবহিত পর’ বুঝায়। সুতরাং জানাযার নামাযের পর বিলম্ব না করে মৃতের জন্য দো‘আ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে এ হাদীস শরীফে।
দ্বিতীয়, এ হাদীস শরীফের প্রথমাংশ (اِذَا صَلَّيْتُمْ عَلَى الْمَيِّتِ) (হলো شرط (শর্ত), আর শেষাংশ (فَاَخْلِصُوْا لَهُ الدُّعَآءَ) হচ্ছে جزاء (জাযা)। ‘শর্ত’ ও ‘জাযা’ পরস্পর ভিন্ন হয়; একটা অপরটার ভিতরে প্রবিষ্ট হয় না। তদুপরি صَلَّيْتُمْ, (ক্রিয়াটা مَاضى (অতীত কালবাচক) আর فَاَخْلِصُوْا -হচ্ছে امر (আদশেসূচক)। সুতরাং স্পষ্টরূপে বুঝা গেলো যে, দো‘আ করার হুকুমটি নামায সমাপ্ত করার পরপরই পালনীয়। যেমন পবিত্র আয়াতে এরশাদ হয়েছে- فَاِذَا طَعِمْتُمْ فَانْتَشِرُوْا (যখন তোমরা আহার সমাপ্ত করবে, তখন চলে যাও!) [সূরা আহযাব: আয়াত-৫৩]
এ আয়াত শরীফেও খাওয়ার পরপর চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আহারের মধ্যবর্তী সময়ে নয়। আর সূরা মা-ইদায় এরশাদ হয়েছে- اِذَا قُمْتُمْ اِلَى الصَّلواةِ فَاغْسِلُوْا وُجُوْهَكُمْ (যখন তোমরা নামাযের জন্য ওঠো, তখন তোমাদের চেহারা ধৌত করো… । আয়াত নং ৬)
এ আয়াতে ‘নামাযের জন্য ইচ্ছা করা’ বুঝানো হয়েছে, ‘নামায কায়েম করা’ নয়, যা الى অব্যয় পদটি দ্বারা প্রতিভাত হয়। সুতরাং ওযূ করার নির্দেশ নামাযের জন্য ‘ইচ্ছা করার পর’ই দেওয়া হয়েছে। বস্তুত: ف’ বর্ণটি ‘বিলম্ব ছাড়া পরবর্তী’ বুঝায়। এ অর্থ বাদ দিয়ে অন্য কোন অর্থ বেরা হবে সেটার রূপক অর্থ (معنى مجازى)। কোন শব্দের প্রকৃত অর্থ (معنى حقيقى ) বাদ দিয়ে, কোন আলামত বা কারণ ব্যতিরেকে, সেটার রূপক অর্থ (معنى مجازى) গ্রহণ করা জায়েয নয়।
দুই. মিশকাত শরীফের একই স্থানে উদ্ধৃত- قَرَأَ عَلَى الْجَنَازَةِ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ (হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম জানাযার পর সূরা ফাতিহা পড়েছেন)-এর ব্যাখ্যায় এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আশি’‘আতুল লুম্‘আত’-এ আছে-
واحتمال دارد كه فاتحه هرجنازه بعد از نماز ياپيش ازاں بقصد تبرك خوانده باشد چناں الان متعارف است
অর্থ: হতে পারে হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম ‘সূরা ফাতিহা’ জানাযার নামাযের পর অথবা নামাযের পূর্বে বরকতের জন্য পড়েছেন; যেমন আজকাল প্রচলিত আছে।
এ থেকে বুঝা যায় যে, শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী আলায়হির রাহমাহর যামানায়ও প্রচলিত ছিলো যে, জানাযার নামাযের আগে ও পরে সূরা ফাতিহা ইত্যাদি বরকতের জন্য পড়া হতো। আর হযরত শায়খও তা পড়তে নিষেধ করতেন না; বরং সেটাকে হাদীস শরীফের অনুসরণ বলে মত প্রকাশ করেছেন।
তিন. ‘ফাত্হুল ক্বদীর’: কিতাবুল জানায়েয; ফাস্ল সালাতুল জানাযা’ (জানাযা সম্পর্কিত বিষয়াদির বর্ণনা শীর্ষক পর্ব: জানাযার নামাযের বিবরণ শীর্ষক পরিচ্ছেদ)-এ আছে, হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম মিম্বর শরীফের উপর দাঁড়িয়ে মূতার যুদ্ধের খবর (বর্ণনা) দিলেন। ইত্যবসরে হযরত জা’ফর ইবনে আবূ তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহাদাতের সংবাদ দিলেন-
فَصَلّى عَلَيْهِ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَدَعَا لَه وَقَالَ اِسْتَغْفِرُوْا
অর্থ: অতঃপর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম জানাযার নামায পড়লেন ও তাঁর জন্য দো‘আ করলেন আর লোকজনকে বললেন, ‘‘তোমরাও তার জন্য মাগফিরাতের দো‘আ করো।’ ودعا (এবং দোয়া করেছেন)-এর واؤ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, দো‘আ নামায ব্যতীত স্বতন্ত্র ছিলো।
চার. ‘মাওয়াহিবে লাদুনিয়াহ্’: দ্বিতীয় খন্ড: দ্বিতীয় ভাগ- فِيْمَا اَخْبَرَ مِنَ الْغُيُوْبِ ( ‘অদৃশ্য বিষয়াদি থেকে যা খবর দিয়েছেন’ প্রসঙ্গে তিনি যা এরশাদ করেছেন)-এ এ-ই ঘটনা বর্ণনা করে বলেছেন- ثُمَّ قَالَ اِسْتَغْفِرُوْا لَه (অতঃপর বলেছেন, তোমরাও তার জন্য মাগফিরাতের জন্য দো‘আ করো।) অনুরূপ, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহর জানাযার নামায পড়ার পর দো‘আ করেছেন।
এ থেকেও প্রতীয়মান হয় যে, জানাযার নামাযের পর মাগফিরাতের দো‘আ করা জায়েয।
পাঁচ. ‘মুস্তাখাব-ই কান্যুল উম্মাল’-এর ‘কিতাবুল জানাইয’-এ ইব্রাহীম হিজরীর রেওয়ায়ত-
قَالَ رَأَيْتُ اِبْنَ اَبِىْ اَوْفى وَكَانَ مِنْ اَصْحَابِ الشَّجَرَةِ مَا تَتْ اِبْنَتُه اِلى اَنْ قَالَ ثُمَّ كَبَّرَ عَلَيْهَا اَرْبَعًا ثُمَّ قَامَ بَعْدَ ذلِكَ قَدْ رَ مَا بَيْنَ التَّكْبِيْرَتَيْنِ يَدْعُوْ وَقَالَ رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَصْنَعُ هكَذَا
অর্থ: তিনি বলেন, আমি ইবনে আবূ আওফাকে দেখেছি, তিনি বায়‘আত-ই রিদ্ব্ওয়ানে অংশগ্রহণকারী সাহাবী, তাঁর কন্যার ইনতিক্বাল হয়েছে, তারপর তিনি তার উপর চারবার তাকবীর বলেছেন, তারপর দু’ তাকবীরের ব্যবধানের পরিমাণ দাঁড়িয়ে দো‘আ করেছেন। আর বলেছেন, আমি হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালামকে এমনটি করতে দেখেছি।
ছয়. বায়হাক্বী শরীফে আছে-
وَعَنِ الْمُسْتَظِلِّ بْنِ حُصَيْنٍ اَنَّ عَلَيَّا صَلّى عَلى جَنَازَةٍ بَعْدَ مَا صَلَّى عَلَيْهِ
অর্থ: হযরত মুস্তাযিল ইবনে হোসাঈন থেকে বর্ণিত, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এক জানাযার নামায পড়ার পর দো‘আ-প্রার্থনা করেছেন।
সাত. ‘মুদাওয়ানাতুল কুবরা’য় আছে-
يَقُوْلُ هكَذَا كُلَّمَا كَبَّرَ وَاِذَا كَانَ التَّكْبِيْرُ الْاخِرُ قَالَ مِثْلَ ذلِكَ ثُمَّ يَقُوْلُ اللهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ
অর্থ: তিনি প্রত্যেক তাকবীরের পর এভাবে বলতেন, আর যখন শেষ তাকবীর হতো, তখনও এভাবে বলতেন, ‘আল্লা-হুম্মা সাল্লি আলা মুহাদ্দিন।’’ এ থেকে বুঝা গেলো যে, জানাযার নামাযের পর দুরূদ শরীফ পড়া চাই।
আট. ‘কাশ্ফুল গেত্বা’য় আছে-
فَاتحه ودعا براۓ ميت پيش از دفن درست است وهميں است بروايت معموله ـ كذا فى خلاصة الفتح
অর্থ: মৃতের জন্য ফাতিহা ও দো‘আ করা দাফনের পূর্বে, জায়েয। এ বর্ণনা অনুসারে আমল রয়েছে। ‘খোলাসাতুল ফাত্হ’-এর মধ্যে এমনটি রয়েছে।
নয়: ‘মাবসূত্ব’, কৃত- শামসুল আইম্মাহ্ সারাখ্সী: ২য় খন্ড: পৃ. ৬০; বাবু গুসলিল মাইয়্যেত’-এর মধ্যে বর্ণিত, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এক জানাযায় নামাযের পর পৌঁছলেন। আর বললেন-
اِنْ سَبَقْتُمُوْنِىْ بِالصَّلوةِ عَلَيْهِ فَلاَ تَسْبِقُوْنِىْ بِالدُّعَاءِ
অর্থ: ‘যদিও তোমরা আমার পূর্বে নামায পড়ে ফেলেছো, তবুও দো‘আ আমার আগে করোনা।’’ অর্থাৎ এসো, আমার সাথে মিলে দো‘আ করে নাও।
এই ‘মাবসূত্ব’-এ এ স্থানে অর্থাৎ ‘বাবু গুসলিল মাইয়্যেত’-এ সর্বহযরত ইবনে ওমর, আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ্ ইবনে সালাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম থেকে বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, এ হযরতগণ জানাযার নামাযের পর দো‘আ করেছেন।
আর فَلاَ تَسْبِقُوْا (আমার আগে বাড়ো না) থেকে বুঝা গেলো যে, এ দো‘আ করা সাহাবা-ই কেরামেরই আমল ছিলো।
দশ. ‘মিফতাহুস্ সালাত’-এ সেটার লেখক মহোদয় মাওলানা ফাত্হ্-ই মুহাম্মদ সাহেব বোরহানপুরী তাঁর এ কিতাবের ১১২ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন-
چوں از نماز فارغ شوند مستحب است كه امام صالح ديرা فاتحه بقرتامفلحون طرف سر جنازه وخاتمه بقرامن الرسو ل طرف بائيں بخواند كه در حديث وار داست ودربعض حديث بعد از دفن واقع شده هردووقت كه ميسر شود مجوزاست
অর্থ: যখন জানাযার নামায সমাপ্ত করবে, তখন মুস্তাহাব হচ্ছে- ইমাম অথবা অন্য কোন নেক্কার লোক সূরা-ই বাক্বারার প্রথম রুকূ ‘মুফলিহুন’ পর্যন্ত জানাযার শির প্রান্তে এবং সূরা-ই বাক্বারার শেষের আয়াতগুলো ‘আ-মানার রসূলু’ থেকে, মৃতের পায়ের দিকে পড়বে। কারণ, হাদীস শরীফে এমনটি বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন হাদীসে ‘দাফনের পর’ বর্ণিত হয়েছে। সম্ভব হলে উভয় সময়ে পড়বে। এটা জায়েয।
এগার. ‘যাদুল আখিরাত’-এ ‘নাহর-ই ফা-ইক্ব শরহে কানযুদ্ দাক্বা-ইক্ব’ এবং ‘বাহরে যাখ্খার’ থেকে উদ্ধৃত-
بعد از سلام بخواند اللهُمَّ لاَ تُحْرِمْنَا اَجْرَه وَلاَ تَفْتِنَّا بَعْدَه وَاغْفِرْلَنَا وَلَه
অর্থ: সালাম ফেরানোর পর পড়বে, হে আল্লাহ্, আমাদেরকে এর সাওয়াব থেকে বঞ্চিত করোনা এবং এরপর ফিৎনায় আক্রান্ত করোনা আর আমাদেরকে ও এ মৃতকে ক্ষমা করো।
বার. ত্বাহত্বাভী শরীফে আছে-
وَاِنَّ اَبَا حَنِيْفَةَ لَمَّا مَاتَ فَخُتِمَ عَلَيْهِ سَبْعُوْنَ اَلْفًا قَبْلَ الدَّيْنِ
অর্থ: যখন ইমাম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ওফাত হলো, তখন তার জন্য তাঁর দাফনের পূর্বে সত্তর হাজার বার খতমে ক্বোরআন করা হয়েছে।
তের. ‘কাশ্ফুল গুম্মাহ্’, ‘ফাতাওয়া-ই আলমগীরী’ ও ‘ফাতাওয়া-ই শামী’: বাদুদ্ দাফন, বাহাস-ই তা’যিয়া’-এ আছে-
وَهِىَ بَعْدَ الدَّفْنِ اَوْلى مِنْهَا قَبْلَه
অর্থ: শোক প্রকাশ করা দাফনের পর দাফনের পূর্বে শোক প্রকাশ করা অপেক্ষা উত্তম।
এখানেই শামী ও আলমগীরী প্রণেতা মহোদয়গণ এ কথাও বলেছেন-
وَهذَا لَمْ يُرَمِنْهُمْ جَزَعٌ شَدِيْدٌ وَ اِلاَّ قُدِّمَتْ
অর্থ: এটা তখনই, যখন ওই ওয়ারিশদের মধ্যে কঠোর ভয়-ভীতি দেখা দেয় না, অন্যথায় শোক প্রকাশ দাফনের পূর্বে করা হবে।
‘হাসান যহীরিয়াহ্’য় আছে- وَهِىَ بَعْدَ الدَّفْنِ اَوْلى مِنْهَا قَبْلَه
অর্থ: দাফনের পর শোক প্রকাশ করা দাফনের পূর্বে শোক প্রকাশ অপেক্ষা উত্তম।
চৌদ্দ. ইমাম শা’রানী তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘মীযান’-এ লিখেছেন-
قَالَ اَبُوْ حَنِيْفَةَ وَالثَوْرِىُّ اِنَّ التَّعْزِيَةَ سُنَّةٌ قَبْلَ الدَّفْنِ لاَ بَعْدَه لِاَنَّ شِدَُّةَ الْحُزْنِ تَكُوْنُ قَبْلَ الدَّفْنِ فَيُعَزِّى وَيَدْعُوْلَه
অর্থ: ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম সাওরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বলেছেন, শোক প্রকাশ করা দাফনের পূর্বে সুন্নাত। পরে নয়; কেননা, শোক-বেদনা বেশী থাকে দাফনের পূর্বে সুতরাং শোকও প্রকাশ করবে এবং তার জন্য দো‘আও করবে।
এসব উদ্ধৃতি থেকে প্রমাণিত হলো যে, দাফনের পূর্বে, হোক না নামাযের পূর্বে কিংবা নামাযের পরে, শোক প্রকাশ করা জায়েয; বরং সুন্নাত। এ শোক প্রকাশে মৃত ও তার রেখে যাওয়া লোকদের জন্য সাওয়াব ও সবরের দো‘াআই তো হয়ে থাকে।
আক্বল বা যুক্তির দাবীও এ যে, জানাযার নামাযের পর দো‘আ করা বৈধ হোক। কেননা, জানাযার নামায এক বিবেচনায় তো দো‘আই, কারণ এ’তে মৃতকে সামনে রাখা হয়; আর তাতে রুকূ’, সাজদা, আত্তাহিয়্যাত ইত্যাদি নেই। আবার অন্য বিবেচনায় এটা নামাযও। এজন্য এ’তে গোসল, ওযূ, সতর ঢাকা, ক্বেবলামুখী হওয়া, স্থান ও কাপড় পবিত্র হওয়া পূর্বশর্ত। আর জামা‘আত সুন্নাত। যদি এটা নিছক দো‘আ হতো, তবে নামাযের মতো এসব পূর্বশর্ত এতে কেন নির্দ্ধারণ করা হলো? আর অন্যান্য দো‘আর মতো এটাও সম্পন্ন করলে যথেষ্ট হতো। সুতরাং একথা মানতে হবে যে, এটা এক দিক দিয়ে নামাযও। আর প্রত্যেক নামাযের পর দো‘আ করা সুন্নাত এবং বেশি কবূল হবার উপযোগী।
সুতরাং ‘মিশকাত শরীফ: বাবুয্ যিক্রি বা’দাস্ সালাত’-এ বর্ণিত হয়েছে-
قِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللهِ اَىُّ الدُّعَآءَ اَسْمَعُ قَالَ جَوْفَ اللَّيْلِ الاخِرِ وَدُبُرَ الصَّلواتِ الْمَكْتُوْبَةِ
অর্থ: হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর পবিত্র দরবারে আরয করা হলো- ‘‘কোন দো‘আ বেশি ক্ববূল হয়?’’ হুযূর-ই আকরাম এরশাদ করেছেন- শেষ রাতের মাঝমাঝি অংশ এবং ফরয নামাযগুলোর পর।
জানাযার নামাযও ফরয নামায। সুতরাং এর পরক্ষণে কেন দো‘আ করা হবে না? তাছাড়া, দো‘আ সব সময় করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং অতি তাকীদ দেওয়া হয়েছে। ‘মিশকাত শরীফ: কিতাবুদ্ দাওয়াত’-এ আছে- اَلدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ (দো‘আ হচ্ছে ইবাদতই)। এখানে একথাও আছে- اَلدُّعَاءُ مُخُّ الْعِبَادَةِ (দো‘আ ইবাদতের সারবস্তু)। দো‘আ করার জন্য কোন বিশেষ ওয়াক্বত নির্দ্ধারিত নেই। সুতরাং এর কারণই বা কি হতে পারে যে, জানাযার নামাযের পূর্বে তো দো‘আ জায়েয এবং দাফনের পরেও জায়েয কিন্তু নামাযের পর, দাফনের পূর্বে হারাম? জানাযার নামায কি এমন কোন যাদু যে, তা পড়তেই দো‘আ করা, ঈসালে সাওয়াব করা সবই হারাম হয়ে যায়, আর মৃতকে ‘দাফন করা’ মাত্র ওই যাদুর প্রভাব খতম হয়ে যায় আর দাফনের সাথে সাথে সব জায়েয হয়ে যায়?
পরিশেষে, দো‘আ সব সময় করা যায়, ঈসালে সাওয়াব সব সময় জায়েয। এ জন্য কোন ওয়াক্বতের পাবন্দি (বাধ্যবাধকতা) নেই। সুতরাং জানাযার পরও দো‘আ করার মধ্যে কোন ক্ষতি নেই। বরং তাও জায়েয এবং সাওয়াবের কাজ।
।। দুই।।
জানাযার নামাযের পর দো‘আ করার বিপক্ষে
বিরুদ্ধবাদীদের আপত্তিসমূহ ও সেগুলোর খন্ডন
এ দো‘আর বিপক্ষে শুধু চারটা আপত্তি করতে শুনা যায়- তিনটি যুক্তিগত (عقلى) আর একটা মাত্র দলীলগত (نقلى)। এতদ্ব্যতীত অন্য কোন আপত্তি নেই বললেও চলে-
এক. ওহাবীদের ওই পুরানা সবক, যা তারা কণ্ঠস্থ করেছে, তা-ই তারা আওড়িয়ে যায়। তা হচ্ছে- এ দো‘আ বিদ্‘আত, প্রত্যেক বিদ্‘আত হারাম। সুতরাং এ দো‘আ করাও হারাম, শির্ক ও দ্বীন-বহির্ভূত।
এর জবাব হচ্ছে- এ দো‘আ বিদ্‘আত নয়। কারণ, এটা হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী শরীফ ও আমল শরীফ দ্বারা প্রমাণিত। তাছাড়া, সাহাবা-ই কেরামেরও এতদনুযায়ী আমল রয়েছে। ফক্বীহ্গণ এর অনুমতি দিয়েছেন। যেমনটি ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। আর তাদের কথা মতো কিছুক্ষণের জন্য যদি এটাকে বিদ্‘আতও ধরে নেওয়া হয়, তবে জেনে রাখা উচিৎ যে, বিদ্‘আত পাঁচ প্রকার। তন্মধ্যে এটা বিদ্‘আত-ই হাসানাহ্ (উত্তম বা সাওয়াবদায়ক বিদ্‘আত)।
দুই. বিরুদ্ধবাদীরা বলে বেড়ায়, জানাযার নামায তো খোদ্ দো‘আ। এরপর পুনরায় দো‘আ করা জায়েয (বৈধ) নয়; প্রথম দো‘আ (জানাযার নামায) তো যথেষ্ট।
এর জবাবে আমাদের বক্তব্যও স্পষ্ট। তা হচ্ছে এ আপত্তিসম্পূর্ণ অকেজো। কারণ, পঞ্জেগানা নামাযে দো‘আ আছে, ইস্তিখারা কুসূফ কিংবা খুসূফের নামায, ইস্তিস্কার নামায সবই তো দো‘আর জন্য সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু এ সব ক’টির পরতো দো‘আ করা জায়েয বরং সুন্নাত। হাদীসে পাকে এরশাদ হয়েছে اَكْثِرُوْا الدُّعَاءَ (দো‘আ বেশী করো)। দো‘আর পর দো‘আ করাই দো‘আ বেশী করা। তদুপরি, এ নামাযকে যদি নিছক দো‘আই ধরে নেওয়া হয়, তবুও কখনো কখনো তো জানাযার নামাযের পর জানাযার নামায পড়া হয়; যদি মৃতের ওলী জানাযার নামায না পড়ে থাকে; অন্যান্য লোক পড়ে নেয়। এমতাবস্থায় পুনরায় জানাযার নামায পড়া যেতে পারে। হুযূর সাইয়্যেদে আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ভেসাল (ওফাত) শরীফ হয়েছে সোমবার। আর দাফন শরীফ হয়েছে বুধবার। [সূত্র. ফাতাওয়া-ই শামী: কিতাবুস্ সালাত, বাবুল ইমামত]
এ দু’ দিনে লোকেরা দলে দলে আসতে থাকেন, আর জানাযার নামায আদায় করতে থাকেন; কেননা, ততক্ষণ পর্যন্ত হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব-ই আকবার, যিনি ওলী ছিলেন, নামায পড়েননি; অতঃপর যখন সর্বশেষ দিনে হযরত সিদ্দীক্ব নামায পড়ে নিলেন, তখন থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত কারো জন্য, হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর জানাযার নামায পড়া জায়েয থাকেনি। [সূত্র. ফাতাওয়া-ই শামী: বাবু সালাতিল জানাযা: বাহাস ওয়া মান আহাক্বক্বু বিল ইমামত]
হে বিরুদ্ধবাদীরা! এখন বলো, এ নামায তো দো‘আ ছিলো। তা তো পুনঃপুনঃ সম্পন্ন করা হয়েছে। এ নামায পুনরায় পড়া কিভাবে জায়েয হলো? তাদের এমন আপত্তি তো তেমনি হলো, কেউ বললো, আহারের পর পানি পান করোনা; কেননা, খাবারগুলোর মধ্যে পানি ছিলো, তাতো পানি মিশিয়ে রান্না করা হয়েছে।
তিন. তারা বলে- যেহেতু দো‘আ করতে কিছুক্ষণ সময় লেগে যায়। এ কারণে দাফনকার্যও বিলম্বিত হয়ে যায়; এটাতো হারাম। সুতরাং দো‘আ করাও হারাম।
এর জবাবে আমরা বলবো- এ আপত্তি বেকার। কারণ- প্রথমত এ জন্য যে, তোমরা তো দো‘আ করতে যেকোন অবস্থায়ই নিষেধ করো। তোমাদের কথামতো একথাও বুঝা যায় যে, যদি দাফন-কার্য বিলম্বিত হয়, তবে নিষিদ্ধ; অন্যথায় নয়। বলোতো, যদি এমন হয় যে, এদিকে কবর তৈরী হতে দেরী হচ্ছে; ওদিকে জানাযার নামায হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় দো‘আ-প্রার্থনা ইত্যাদি করতে পারবে কিনা? কেননা, এখানে তো দাফন দো‘আর কারণে বিলম্বিত হচ্ছে না; বরং কবর তৈরী করতে দেরী হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত এজন্য যে, দো‘আ করতে বেশী দেরী হয় না; বড়জোড় শুধু দু’/তিন মিনিট দেরী হয়। এ পরিমাণ বিলম্ব তো অনুভবও হয় না এমন দেরীতো দেরী হিসেবে গণ্য করা হয় না। এতটুকু দেরীতো রাস্তায় আস্তে আস্তে চললে, মৃতকে গোসল আস্তে আস্তে করানো হলে এবং কবরকে অতি যতœ সহকারে খনন করলেও হয়ে যায়। যদি এ পরিমাণ দেরী করাও হারাম হয়, তবে তো একথা অপরিহার্য হয়ে যাবে যে, গোসল ও কাফন পরানোর কাজ যারা সম্পন্ন করে তা যেন অতি তীব্র গতিতে এ কাজ সম্পন্ন করে নেয়, কবর খননকারীরা যেন মেশিনের মতো ঝটপট কবর খুঁড়ে নেয় আর মৃতকে যারা নিয়ে যায়, তারা যেন ইঞ্জিনচালিত গাড়ির গতিতে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে কফীন নিয়ে যায়, আর তাৎক্ষণিকভাবে যেন শবদেহটা কবরে নিক্ষেপ করে ফিরে এসে যায়।
তৃতীয়ত, এজন্য যে, আমি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, দাফনের পূর্বে মৃতের পরিবারবর্গকে সমবেদনা জানানো, তাদেরকে শান্ত¦না দেওয়া জায়েয; বরং সুন্নাত, নামাযের পরে করুক, কিংবা নামাযের পূর্বে করুক। এ সমবেদনা জানাতে ও শান্ত¦না দিতেও কিছুক্ষণ তো লেগেই যায়। কিন্তু যেহেতু এটা একটা দ্বীনী কাজের জন্য করা হয়; সেহেতু তা জায়েয।
চতুর্থত, এজন্য যে, আমি এখনই আরয করেছি যে, হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর ওফাত শরীফ সোমবারে এবং দাফন শরীফ বুধবারে হয়েছে। আল্লামা শামী এ-ই কিতাবুস্ সালাত: বাবুল ইমামত’-এ এ ঘটনা বর্ণনা করে লিখেছেন-
وَهذِه السُّنَّةُ بَاقِيَةٌ اِلى الان لم يُدْفَنْ خَلِيْفَةٌ حَتّى يُوَلّى غَيْرُه
অর্থ: এ সুন্নাত এখনো পর্যন্ত স্থায়ী রয়েছে। খলীফাকে তখন পর্যন্ত দাফন করা হয় না, যতক্ষণ না অন্য খলীফা নিযুক্ত হন।
এ থেকে বুঝা যায় যে, দাফনে ওই বিলম্বই মাকরূহ, যা পার্থিব কারণে করা হয়; দ্বীনী কারণে কিছুটা বিলম্ব করা জায়েয। খলীফা বানানো দ্বীনী কাজ। এর কারণে দাফনে বিলম্ব করা হয়েছে। দো‘আ করাও দ্বীনী কাজ। যদি কোন নামাযী শেষভাগে এসে মিলিত হয়; তবে সে দো‘আ পড়ে সালাম ফেরাতে পারে। কিন্তু যদি নামাযের পরে তাৎক্ষণিকভাবে কফীন তুলে নেওয়া হয়, তাহলে তো এ ব্যক্তি দো‘আ পূর্ণ করতে পারবে না। কারণ, তুলে নেওয়া কফীনের জন্য জানাযার নামায নেই। সুতরাং জানাযার পর দো‘আর মধ্যে ‘মাসবূক্ব’ নামাযীদের (যারা নামাযের প্রথমাংশ পায়নি) কথাও বিবেচনা করা চাই। যদি এজন্য কিছুটা (অতিসামান্য) বিলম্ব করা হয়, তবে জায়েয হবে।
পঞ্চমত, এ জন্য যে, ‘দাফনে যেকোন বিলম্ব হারাম’ কথাটা কোথায় লিখা আছে? ফক্বীহগণ বলেন, জুমার দিনে কারো মৃত্যু হলে জুমার জন্য অপেক্ষা করো না; বরং যদি সম্ভব হয় জুমার পূর্বেই দাফন করে নেবে। তাঁরা এটা বলেন নি যে, অপেক্ষা করা হারাম; শির্ক ও কুফর। (না‘ঊযুবিল্লাহ্)
চার. বিরুদ্ধবাদীরা আরো বলে বেড়ায় যে, জানাযার নামাযের পর দো‘আ করতে ফক্বীহ্গণ নিষেধ করেছেন। যেমন- ‘জামে‘উর রুমুয’-এ আছে- لاَ تَقُوْمُ دَاعِيًا لَّه (নামাযের পর দো‘আর জন্য দন্ডায়মান থাকবে না), ‘যাখীরাহ্-ই কুবরা’ ও ‘মুহীত্ব’-এ আছে- لاَ يَقُوْمُ بِالدُّعَاءِ بَعْدَ صَلواةِ الْجَنَازَةِ (জানাযার নামাযের পর দো‘আর জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে না),
ফাতাওয়া-ই আলমগীরীতে আছে- لاَ يَدْعُوْ بَعْدَه فِى ظَاهِرِ الْمَذْهَبِ(এরপর দো‘আ করবে না- যাহেরী মাযহাবে), ‘মিরক্বাত শরহে মিশকাত’-এ আছে-
وَلاَ يَدْعُوْ لِلْمَيِّتِ بَعْدَ صَلواةِ الْجَنَازَةِ لِاَنَّه يَشْبَهُ الزِّيَادَةَ فِى صَلواةِ الْجَنَازَةِ
অর্থ: জানাযার নামাযের পর মৃতের জন্য দো‘আ করবে না। কেননা এটা জানাযার নামাযে পরিবর্দ্ধনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ। কাশফুল গিত্বা’য় আছে-
قَائم نه شود بعد از نماز براۓ دعا
অর্থ: নামাযের পর দো‘আর জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে না।
জামে‘উর রুমূয’-এ আরো আছে-
وَلاَ يَقُوْمُ بِالدُّعَاءِ بَعْدَ صَلواةِ الْجَنَازَةِ لِاَنَّه يَشْبَهُ الزِّيَادَةَ
অর্থ: জানাযার নামাযের পর দো‘আর জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে না। কারণ, এটা পরিবর্দ্ধনের মতোই।
আবূ বকর ইবনে হামিদ থেকে বর্ণিত-
اِنَّ الدُّعَاءَ بَعْدَ صَلواةِ الْجَنَازَةِ مَكْرُوْةٌ
অর্থ: জানাযার নামাযের পর দো‘আ করা মাকরূহ।
এসব ফিক্বহী ইবারত দ্বারা বুঝা গেলো যে, জানাযার নামাযের পর দো‘আ ইত্যাদি করা জায়েয নয়।
আমরা এর দু’টি জবাব দেবো- একটি ইজমালী (সংক্ষিপ্ত) এবং দ্বিতীয়টি তাফসীলী (বিস্তারিত)।
ইজমালী জবাব হচ্ছে- এ দো‘আ করতে নিষেধ করার তিনটি কারণ থাকতে পারে-১. যদি চতুর্থ তাকবীরের পর সালাম ফেরানোর পূর্বে হয়, ২. দো‘আ যদি এতো বেশী দীর্ঘ হয় যে, দাফনে বেশী বিলম্ব হয়ে যায়। এ কারণে জুমার জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে দাফনে বিলম্ব করা নিষিদ্ধ এবং ৩. এভাবে কাতারবন্ধি হয়ে নামাযের আকারে দাঁড়িয়ে দো‘আ করলে, তা নিষিদ্ধ হতে পারে। কারণ, তখন যারা তাদেরকে এভাবে দেখবে তারা মনে করবে যেন নামায হচ্ছে। এটা অবশ্য পরিবর্দ্ধনের সদৃশ হয়ে যায়।
সুতরাং যদি সালাম ফেরানোর পর বসে কিংবা কাতার ভেঙ্গে ফেলে কিছুক্ষণ দো‘আ করা হয়, তবে তা জায়েয, মাকরূহও হবে না। এসব পদ্ধতি এজন্য বের করা হয়েছে যাতে ফক্বীহ্গণের ইবারতগুলো পরস্পরবিরোধী না হয়। আর এ অভিমতগুলোও যেন উপরোক্ত হাদীসগুলো এবং সাহাবা-ই কেরামের বাণী ও কর্মের বিপরীত না হয়।
আর তাফসীলী জবাব এ’যে, ইবারতগুলো থেকে ‘জামে‘উর রমূয’, মুহীত্ব, যাখীরাহ্ ও কাশফুল গেত্বার ইবারতগুলোর মধ্যে তো দো‘আ করা নিষিদ্ধ নয়; বরং দাঁড়িয়ে থেকে দো‘আ করতে নিষেধ করা হয়েছে। তা করতে আমরাও তো নিষেধ করি। (আমরা তো বসে কিংবা কাতার ভেঙ্গে দো‘আ করতে বলে থাকি।) ‘মিরক্বাত’ ও ‘জামেউর রুমূয’-এ একথাও বলা হয়েছে لِاَنَّه يَشْبَهُ الزِّيَادَةَ (এটা পরিবর্দ্ধনের সাথে সাজুয্যপূর্ণ)। অর্থাৎ এমন দো‘আর ফলে ধোঁকা হয়ে যায় যে, জানাযার নামাযে কিছু পরিবর্দ্ধন করা হলো কিনা। এ থেকে বুঝা গেলো যে, তেমনিভাবে দো‘আ করতে নিষেধ রয়েছে, যাতে পরিবর্দ্ধনের আশঙ্কা ও ধোঁকা হয়। তা এমতাবস্থায় হয়, যদি জানাযার নামাযের কাতারে দাঁড়িয়ে দো‘আ করা হয়। যদি কাতার ভেঙ্গে কিংবা বসে দো‘আ করা হয়, তবে ক্ষতি নেই। যেমন- ফরয নামাযের জামা‘আতের বিধান হচ্ছে- এ জামা‘আতের পর লোকেরা কাতার ভেঙ্গে সুন্নাত পড়বে; যাতে কেউ এ ধোঁকা না খায় যে, জামা‘আত হচ্ছে। [সূত্র. ফাতাওয়া-ই শামী, মিশকাত শরীফ: বাবুস্ সুনাম] সুতরাং এ’তে একথা অপরিহার্য হয় না যে, ফরযের পর সুন্নাত পড়া নিষিদ্ধ; বরং ফরযের সাথে মিলিত হয়ে পড়া নিষিদ্ধ। এটাও তেমনি। আলমগীরীর ইবারত ভুলভাবে উদ্ধৃত হয়েছে। সেটার মূল ইবারত নি¤œরূপ-
وَلَيْسَ بَعْدَ التَّكْبِيْرِ الرَّابِعَةِ قَبْلَ السَّلاَمِ دُعَاءٌ
অর্থ: চতুর্থ তাকবীরের পর সালামের পূর্বে কোন দো‘আ নেই। অর্থাৎ জানাযার নামাযে প্রথম তিন তাকবীরের পর কিছু না কিছু পড়া হয়; কিন্তু এ চতুর্থ তাকবীরের পর কিছুই পড়া যাবে না, যেমন আমি ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। সুতরাং বাদা-ই, কিফায়াহ্ ও ইনায়াহ্’য় আছে- وَلَيْسَ بَعْدَ التَّكْبِيْرِ الرَّابِعَةِ قَبْلَ السَّلاَمِ دُعَاءٌ
অর্থ: চতুর্থ তাকবীরের পর সালামের পূর্বে দো‘আ নেই।
আবূ বকর ইবনে হামেদের যে ইবারত পেশ করা হয়েছে। বস্তুত: এটা ক্বুনিয়ার ইবারত। কিন্তু ক্বুনিয়া কোন নির্ভরযোগ্য কিতাব নয়। সেটার উপর ফাত্ওয়া দেওয়া যায় না। ফাতাওয়া-ই শামীর মুক্বাদ্দামায়: রস্মুল মুফতীতে আছে- ‘‘ক্বুনিয়া প্রণেতা দুর্বল অভিমতও গ্রহণ করেন। সেটার উপর ভিত্তি করে ফাত্ওয়া দেওয়া জায়েয নয়। সুতরাং তিনি বলেন-
اَوْ لِنَقْلِ الْاَقْوَالِ الضَّعِيْفَةِ فِيْهَا كَالْقُنْيَةِ لِلزَّاهِدِىِّ فَلاَ يَجُوْزُ الْاِفْتَاءُ مِنْ هذِه
অর্থ: অথবা এজন্য যে, সেগুলোতে দুর্বল অভিমতগুলো উদ্ধৃত হয়েছে, যেমন- যাহেদীর ‘ক্বুনিয়াহ্’। সুতরাং এগুলো থেকে (দলীল গ্রহণ করে) ফাত্ওয়া দেওয়া জায়েয হবে না।
আ’লা হযরত ক্বুদ্দিসা র্সিরুহ্ ‘বযলুল জাওয়া-ইয’-এ লিখেছেন- قنيه والا معتزلى بدمذهب ھے (অর্থাৎ ক্বুনিয়া প্রণেতা হচ্ছে মু’তাযেলী। তার আক্বীদা সঠিক নয়)। আর যদি ক্বুনিয়ার এ ইবারত বিশুদ্ধ বলে মেনেও নেওয়া হয়, তা হলে তা বিরুদ্ধবাদীদেরও বিপক্ষে চলে যায়। কেননা, তারা বলে, জানাযার নামাযের পর দো‘আ করা নিষিদ্ধ। সুতরাং দাফনের পরও দো‘আ করা না-জায়েয হওয়া চাই। কেননা, এটাও তো নামাযের পরবর্তী। মোটকথা, কোন ইবারতই বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষে নেই। সুতরাং একথা নির্দ্ধিধায় বলতে হয় যে। জানাযার নামাযের পর দো‘আ করা জায়েয বরং সুন্নাত।