নবী নন্দিনী: হযরত ফাতেমাতুয্ যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা –
নবী নন্দিনী: হযরত ফাতেমাতুয্ যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা –
মাওলানা মুহাম্মদ জিল্লুর রহমান হাবিবী >
প্রারম্ভিকা
জান্নাতী রমনীদের সরদার হযরত ফাতেমাতুয্ যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা ছিলেন নবী করীম রাউফুর রহীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর চতুর্থ ও কনিষ্ঠা কন্যা। তিনি ছিলেন নবীজির অত্যন্ত আদরের ও সব চাইতে প্রিয় সন্তান। পৃথিবীর সমস্ত নারী এবং জান্নাতের রমনীদের সরদার হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন সমগ্র মানবজাতির আদর্শ আর নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা হচ্ছেন নারীজাতির অনুপম আদর্শ। তিনি ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত মাওলা আলী শেরে খোদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর স্ত্রী এবং জান্নাতী পুরুষদের সরদার হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম আলী মকাম হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমার মাতা।
শুভজন্ম
সৈয়্যদা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রথম বিবি খাদীজা বিনতে খোআইলিদ ইবনে আসাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার গর্ভে এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নূরানী ঔরসে নবুয়তের পাচঁ বছর পূর্বে মক্কায় জন্ম গ্রহণ করেন। মতান্তরে নবুয়তের এক বছর বা নবুয়তের কিছুকাল পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বয়সে পাঁচ বছরের বড় ছিলেন।
বংশ পরিচিতি
নাম- ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা, উপনাম- উম্মু মুহাম্মদ, উপাধী যাহ্রা। তিনি হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর চতুর্থ ও কনিষ্ঠা কন্যা।
নাম করণের কারণ
‘ফাতেমা’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে পৃথককারিনী, উদ্ধারকারিনী। হযরত ফাতেমার এই নামে নামকরণের কারণগুলো নি¤œরূপ-
প্রথমত: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে- তাঁর নাম ফাতেমা রাখার কারণ হলো, আল্লাহ্ পাক তাঁকে এবং তাঁর ভক্তদেরকে জাহান্নাম থেকে পৃথক করেছেন। [মুসতাদরাক লিল হাকেম] দ্বিতীয়ত: তাঁকে আল্লাহ্ তা‘আলা জাহান্নাম থেকে পৃথক করেছেন। [ইছকাবুর রাগেবীন] তৃতীয়ত: হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর প্রশ্নের জবাবে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ ফরমান- নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে এবং তাঁর আওলাদ হতে কিয়ামত দিবসে জাহান্নামের আগুনকে দূরীভূত করেছেন।
[আত্- তাবারাী, ইবনে জারীর] চতুর্থত: হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- ان فاطمة احصنت فرجها فخرجها الله وذريتها على النار-
অর্থাৎ- ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা তাঁর চরিত্রের আঁচল পবিত্র রেখেছেন। ফলে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে ও তাঁর আওলাদকে জাহান্নামের উপর হারাম করে দিলেন। [আস্ সাওয়াইকুল মুহরিকা]
উপাধীসমূহ
ফাতেমা নামের পাশাপাশি বিশ্ব মুসলিম তাঁকে বিভিন্ন উপনামে আখ্যায়িত করেন। এসব উপনাম হল তাঁর চারিত্রিক গুণাবলীর প্রশংসার বহিঃপ্রকাশ। যেমন তাঁর উপাধি হল ‘যাহ্রা’ যার অর্থ হলো আলোকিত মহিয়সী নারী অথবা জ্যোতির্ময় নারী।
তিনি উম্মে আবিহা (তাঁর পিতার মা) নামেও প্রসিদ্ধ। তাঁকে বতুল (অপবিত্রতা মুক্ত) নামেও অভিহিত করা হয়। তাঁর দু’টি নাম ছিল, শরীফা (মহানুভবা) ও সাইয়্যেদা (সম্মানিতা সরদার) । সাধারণত তিনি ফাতেমাতুয্ যাহ্রা নামে বেশি প্রসিদ্ধ।
শৈশকাল
হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার শৈশবকাল থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পাক পবিত্র পরিবেশে অতিবাহিত হতে থাকে। কেননা তাঁর লালন-পালন স্বয়ং মা খাদীজাতুল কুবরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহাই করেন। তৎকালীন আরব সমাজের নিয়ম ছিল সদ্যজাত শিশুকে লালন-পালন করার জন্য ‘দুধ মা’ নিয়োগ করা। কিন্তু তাঁর বেলায় এ প্রথার ব্যত্যয় ঘটেছে। তাঁর শৈশব কেটেছে মক্কায় পিতা-মাতার নিবিড় সাহচর্যে। এমন অতুলনীয় পরিবেশের মধ্যে যেই শিশুর লালন-পালন হয়, সেই শিশুর প্রতিটি মুহূর্ত কতই না মূল্যবান। এটা কতই না সৌভাগ্যের ব্যাপার। মানব জগতে বিশেষ করে নারী জগতে অন্য কারো ভাগ্যে মিলেছে কিনা জানা নেই। হযরত খাদীজার ইন্তেকালের পর নবীজিকে তিনি এমন ভক্তি সহকারে সেবা যতœ করেছেন যে, তাঁকে ‘উম্মে আবিহা’ অর্থাৎ তাঁর পিতার মা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
হযরত খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার ইন্তেকালের পর পরিবারের দেখা শোনার জন্য রাসূলে পাক সাওদা নামক একজন বিধবাকে শাদী করেন। শিশু ফাতেমাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য সাওদাকে বলা হলে তিনি উত্তরে বলেন, আমি কিভাবে তাঁকে শিক্ষা দিতে পারি যিনি নিজেই একজন পবিত্রা এবং উচ্চ মর্যাদাশীল ব্যক্তিত্ব। বরং তাঁর কাছ থেকে আমার নিজেরই শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
চারিত্রিক গুণাবলী
সৈয়্যদা ফাতেমাতুয্ যাহ্রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা ছিলেন বহুগুণে গুণান্বিত এক অতুলনীয় রমনী। তাঁর সত্যবাদিতা, ধীরস্থিরতা, শিষ্ঠাচারিতা, নমনীয়তাসহ প্রভৃতি গুণের অনন্য বৈশিষ্ট্যসমূহ ছোটকাল থেকে পরিস্ফুটিত হতে থাকে। তাঁর সুন্দর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য অনুপম আদর্শের ধারক-বাহক। আমাদের নারী সমাজ যদি তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে; তাহলে নারীদের কোলে যুগের মহাননিষী জন্ম নেবে, সমাজে কোন ধরণের অশান্তি বিশৃংখলা বিরাজ করবে না। কেননা জগতের অর্ধেক ফিতনাতো বর্তমানে নারীদের আচার-আচরণের কারণেই ঘটছে। নারী জগতের জন্য তাঁর আদর্শ মুক্তির অন্যতম মাধ্যম।
শাদী মোবারক
দ্বিতীয় হিজরীর মহররম মাসের প্রথম দিকে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার বিবাহের চার বা সাড়ে চার মাস পরে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সাথে হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার শাদী মোবারক অনুষ্ঠিত হয়। তখন হযরত ফাতেমার বয়স ছিল পনের বছর সাড়ে পাঁচ মাস আর হযরত আলীর বয়স হয়েছিল একুশ বছর পাঁচ মাস। কোন কোন ঐতিহাসিক এ বিয়ে উহুদ যুদ্ধের পর হয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সুক্ষèভাবে পর্যালোচনা করলে এমতটি বিশুদ্ধ বলে মনে হয় না। কেননা, সহীহ বুখারী শরীফের বর্ণনা মতে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর বিয়ের ওয়ালিমার উট হযরত হামযা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু জবেহ করেছিলেন। আর সর্বসম্মতিক্রমে, হযরত হামযা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু উহুদ যুদ্ধে শহীদ হন। অতএব, এতে প্রমাণিত হয় যে, বিয়ের ঘটনা উহুদ যুদ্ধের পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল।
হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা ছিলেন নবুয়তী ধারায় পৃথিবীর সকল নারীদের জন্য আদর্শ। অন্যদিকে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ছিলেন নবুয়তী মিশনের প্রথম ওলিল আমর বা ইমাম। তাঁরা ছিলেন উত্তম দম্পতির এক অনন্য উদাহরণ।
এ দম্পতির বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা ছিল খুবই সাধারণ। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে ডেকে তাঁর ঢালটি বিক্রি করে বিয়ের জন্য অর্থ জোগাড় করার পরামর্শ দেন। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ঢাল বিক্রি করে দু’শ দিরহাম পান যা দিয়ে তিনি হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার দেনমোহর পরিশোধ করেন।
হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সমপরিমাণ দিরহাম মিলিয়ে নব-দম্পতির ঘরের জন্য কিছু জিনিস ক্রয় করার জন্য তাঁর সাহাবীদের দেন। নব-দম্পতির জন্য আলাদা একটি ঘরের ব্যবস্থা করা হয় মসজিদে নববীর কাছাকাছি। বিবাহের তারিখ নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। তবে ধরে নেয়া হয় যে, তাঁদের বিবাহের সাল ছিল ৬২৩ খ্রিস্টাব্দ দ্বিতীয় হিজরী। অপর বর্ণনা মতে সালটা ছিল ৬২২ খ্রিস্টাব্দ। হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার ওফাত পর্যন্ত তাদের দাম্পত্য জীবন প্রায় দশ বছর বিদ্যমান ছিল।
ওয়ালিমার ব্যবস্থা
রহমতে দো’আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মাওলা আলী শেরে খোদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে আদেশ করলেন যে, তুমি ওয়ালিমার ব্যবস্থা কর। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর নিজের লোহার পোষাকটি এক ইহুদীর নিকট বন্ধক রেখে ওয়ালিমার ব্যবস্থা করেন। এবং এটিই হচ্ছে সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। [মাদারিজুন নবুয়ত]
আওলাদ বা সন্তান
বুতুলে মোস্তফা ফাতেমা যাহ্রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার দু’জন পুত্র সন্তান ও দু’জন কন্যা সন্তান ছিল। সৈয়্যদুশবাবি আহলিল জান্নাহ্ হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র জন্মগ্রহণ তৃতীয় হিজরীতে এবং সৈয়্যদুশ্ শোহাদা ইমাম আলী মকাম হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র চতুর্থ হিজরী, তার প্রথম কন্যা হযরত জয়নাব ষষ্ট হিজরীতে ও এবং দ্বিতীয় কন্যা হযরত উম্মে কুলসুম সপ্তম হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন।
আহলে বায়তে রাসূল বা আওলাদে রাসূল তথা রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বংশধর হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার বংশধরদেরকেই বুঝানো হয়েছে। [সাহাবীয়াত, নিয়ায]
অনুপম বৈশিষ্ট্য
নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার শুভজন্ম ও শৈশব জীবনে বেশ কিছু অলৌকিকত্ব প্রকাশ পেয়েছিল। যার কয়েকটি সংক্ষেপে পেশ করছি-
* জন্মের সময়: তাঁর প্রসবকালীন সময়ে সহযোগিতার জন্যে জান্নাতী রমনীদের আগমন ঘটে। এমনকি তাঁর জন্মের সাথে সাথে সমগ্র বিশ্বে আলোক রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে এবং জান্নাতের দশ জন হুরের মাধ্যমে গোসল করানো হয়। বেহেশতের মধ্যে হযরত আদম ও হাওয়া আলায়হিমাস্ সালামের সাথে সাক্ষাৎ লাভ হয়; যার দরুণ জন্মের পর তাঁর কাছ থেকে বেহেশতের সুগন্ধি প্রকাশ পায়।
* ধৈর্যের দৃষ্টান্ত: হযরত ইমরান বিন হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, আমি হুযূর আকদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পাশে বসা ছিলাম। এমতাবস্থায় ফাতেমা নবী পাকের দরবারে আসলেন। তাঁর চেহারা মোবারক ফেকাশে হয়ে গেল। রাসূল আরবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর চেহারা দেখে বুঝতে পারলেন যে, ক্ষুধার কারণে চেহারা এ রকম হয়েছে। তখন সরকারে দো’আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম রবের কাছে দো’আ করেন, ক্ষুধার্তকে পূর্ণরূপে আহার দানকারী, ন¤্রতাকে উচ্চ মর্যাদা দানকারী হে আল্লাহ্! তুমি ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)কে উচ্চ মর্যাদা দান কর। হযরত ইমরান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, এরপর হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার চেহারা থেকে সেই ফেকাশে ভাব চলে গেল। অতঃপর আমি ফাতেমাকে ক্ষুধার ব্যাপারে জিজ্ঞেসা করলে জবাবে ফাতেমা বলেন, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দো’আর পর আমি আর কখনো ক্ষুধা অনুভব করিনি।
* নিজে না খেয়ে ভিক্ষুককে খাওয়ানো: হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমাদের ঘরে ঠিক খাবার গ্রহণের সময় যখন আমার আম্মা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা ছাড়া সবাই খাবার খেয়ে ফেলেছেন। এমতাবস্থায় ঘরের দরজায় এক ভিক্ষুক এসে কিছু চাইলো। তখন আম্মা জান ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা নির্দেশ দিলেন যে, এ খাবারগুলি ওই ভিক্ষুককে দিয়ে আস, আমিতো এক ওয়াক্তের ক্ষুধার্ত হলাম আর ওই ভিক্ষুক দুই ওয়াক্তের ক্ষুধার্ত। শুধু তাই নয়, হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা এবং তার পরিবারের ইফতারী সারাদিন রোযা রাখার পরেও নিজেরা না খেয়ে অভাবীদেরকে দিয়ে দিতেন।
* পারিবারিক জীবন: হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা তাঁর পারিবারিক জীবনে নিজের কাজ নিজেই করতেন। ঘর ঝাড়– থেকে শুরু করে একেবারে চাক্কি দ্বারা গম পিষানোর কাজ পর্যন্ত সব কিছু আপন হাতেই আঞ্জাম দিতেন। যার কারণে তাঁর হাতে জট পড়ে যেত। রান্নার সকল প্রকার কাজ তিনি নিজ হাতে করতেন, মশক দিয়ে পানি ভর্তি করে আনতেন। হাত ও শরীর মোবারক যখম হয়ে যেত। চুলার আগুনের গরম তাপ সহ্য করে খাবার তৈরি করতেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম নারীর মর্যাদা প্রাপ্তির পরও সকল কাজ সুচারুরূপে আঞ্জাম দেয়ার পরও আপন স্বামী হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর খেদমতে কোন ধরনের ব্যাঘাত ঘটেনি। এক মুহূর্তের জন্যও স্বামীর সেবা থেকে বিরত থাকেননি; বরং যথাযথ খেদমতে সদা-সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। এরপরও তিনি কখনো ইবাদত-বন্দেগী থেকে গাফেল থাকেননি। এক ওয়াক্ত নামাযতো দূরের কথা এক রাতের তাহাজ্জুদ পর্যন্ত জীবনে ছুটেনি। তিনি সর্বদা ক্বোরআন তেলাওয়াতে মশগুল থাকতেন। এক কথায় তাঁর পুরা জীবনটাই ছিল ইসলামী তাহজীব-তামাদ্দুনের এক অপূর্ব সমাহার।
ক্বোরআনের আলোকে মর্যাদা
আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামীন ক্বোরআন মজিদের অনেক আয়াতে হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আল আনহা ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যগণের শান ও মর্যাদার কথা বর্ণনা করেছেন। এর মধ্য থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রসিদ্ধ দু’টি আয়াত নি¤েœ পেশ করছি- এক. হে আহলে বায়ত! আল্লাহ্ তা‘আলা চান যে, তোমাদের থেকে সর্বপ্রকার নাপাকী দূরীভূত করতে এবং সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। [সূরা আহ্যাব: আয়াত-৩৩] উক্ত আয়াতের শানে নুযূলে তাঁদেরকে অর্থাৎ হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, হযরত আলী, হযরত ফাতেমা, হযরত হাসান ও হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমকে বলা হয়েছে আহলে বায়ত তথা নবী পরিবার।
এ সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, একদা রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মাটির উপর চারটি রেখা টানেন এবং লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা কি জান এটা কী? সকলেই আরয করলো, আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি ফরমালেন, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ, খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ, মরিয়ম বিনতে ইমরান এবং আসিয়া বিনতে মুজাহিম জান্নাতবাসী মহিলাদের মধ্যে এঁেদর মর্যাদা সবার উর্ধ্বে। [আল্ ইসতিআব] দুই. অতপর হে নবী! যে ব্যক্তি আপনার সাথে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম সম্পর্কে বিতর্ক করে এরপর যে, আপনার নিকট ওহী এসেছে, তবে তাঁদেরকে বলেদিন, এসো! আমরা ডেকে নিই আমাদের পুত্রগণকে ও তোমাদের পুত্রদেরকে এবং আমাদের নারীদেরকে ও তোমাদের নারীদেরকে। অতঃপর মোবাহালা (বাহাস) করি। তারপর মিথ্যাবাদীর উপর অভিসম্পাত দিই।
[সূরা আলে ইমরান: আয়াত-৬১] অত্র আয়াতে খ্রিস্টান প্রতিনিধিদলের সামনে চ্যালেঞ্জ (মোবাহালা) প্রসঙ্গে তাঁদের পূতঃপবিত্র সত্তার প্রতি ইঙ্গিত করে হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার মর্যাদার গুপ্ত রহস্য প্রকাশ করা হয়েছে। মোবাহালার আয়াত নাযিলের সেই সংকটজনক সময়ে আল্লাহ্ তা‘আলা যাঁদেরকে বিশেষ মানুষ হিসেবে প্রদর্শন করেন এবং অন্য সকলের ধ্বংস হবার বিপরীত তাঁদের নিরাপত্তার জামিনদার হন তাঁদের একজন ছিলেন নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা।
হাদীসের আলোকে মর্যাদা
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অসংখ্য হাদীসে পাকে হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা-এর ফযিলত তথা মর্যাদা বর্ণনা করেছেন। তার থেকে কয়েকটি হাদীস নিম্ন পেশ করছি-
এক. হযরত মিসওয়ার ইবনে মখরমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ফাতেমা আমার নূরানী শরীর মোবারকের একটি টুকরা। যে তার সাথে শত্রুতা রাখে, সে আমার সাথে শত্রুতা রাখে। [বুখারী শরীফ, যখায়েরুল ওকরা] দুই. হযরত আবু মুসা আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আমি, আলী, ফাতেমা আর হাসান ও হোসাইন কিয়ামত দিবসে এক গুম্বুজের নিচে একত্রিত হবো। [মাজমাউয জাওয়াইদ] তিন. হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অত্যন্ত প্রিয় পাত্র ছিলেন। হযরত ইবনে ওমাইর হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে জিজ্ঞেস করলেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি কে? তিনি উত্তরে বলেন, ফাতেমা। ইবনে ওমাইর আবার জিজ্ঞেস করেন, পুরুষের মধ্যে কে? তিনি বলেন, তাঁর স্বামী হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। [আল্ ইসতিআব] চার. হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, জান্নাতের মধ্যে এমন একটি স্থান আছে যার নাম ওসিলা। তোমরা দো‘আ করার সময় আমার জন্য ওই ওসিলা চাও। আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার সাথে ওই স্থানে কে থাকবে? নবীজি উত্তরে বললেন, আলী, ফাতেমা আর হাসান ও হোসাইন আমার সাথে থাকবে। [কানযুল উম্মাল] পাঁচ. হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জানে দো’আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, হে আমার আদরের কন্যা ফাতেমা! আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তোমার অসন্তুষ্টিতে অসন্তুষ্ট হন আর তোমার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন।[যখায়েরুল উকবা]
ইন্তিকাল ও কাফন-দাফন
বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে, হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর্দা করার পর ছয় মাস পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তিনি ১১ হিজরী মাহে রমজানে ০৩ তারিখ মঙ্গলবার ইন্তিকাল করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ২৯ বছর। ইমাম যাহভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, বিশুদ্ধ মত হলো, মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ২৪ বা ২৫ বছর হয়েছিল। [সিয়ারু আলামিন নুবালা] বিদায় হজ্বের পর হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহাকে তাঁর ইন্তিকালের আগাম সংবাদ দেন এবং বলেন, আমার আহলে বায়তের সদস্যদের মধ্যে তুমি আমার সাথে শ্রীঘ্রই মিলিত হবে। এর কিছু দিন পর নবীজি ইন্তিকাল করেন। হযরত ফাতেমা খুবই দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং এ অবস্থার মধ্য দিয়ে ওফাত পর্যন্ত প্রায় নব্বই দিন অতিবাহিত করেন। হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার খাদেমা আসমা বিনতে উমাইস তাঁর ওফাতের ঘটনা বর্ণনা করেন। ওফাতের দিন তিনি বাচ্চাদের জন্য খাবার প্রস্তুত করেন এবং আসমাকে কিছু নির্দেশ দিয়ে তিনি তাঁর ইবাদতের কক্ষে চলে যান। তিনি কিছুক্ষণ পর তাঁর কক্ষের মধ্যে জোরে জোরে তাকবির ধ্বনি দিতে থাকেন। আসমা যখন তাঁর তাকবির ধ্বনি আর শুনছেন না, তখন তিনি বুঝতে পারলেন হযরত ফাতেমা ওফাত করলেন। অতঃপর তিনি মসজিদে গিয়ে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে তাঁর স্ত্রীর ওফাতের সংবাদ দিলেন।
আসমার প্রতি নির্দেশিত ছিল ছেলে-মেয়েরা ঘরে ফিরে এলে এ খবর দেয়ার পূর্বেই তাঁদের খাবার খাইয়ে দিতে হবে। আসমা সেই কাজটিই করলেন। হযরত ইমাম হাসান ও হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা ঘরে এলে তিনি তাঁদের খাবার দিলেন। তাঁরা তাঁদের মায়ের হাতে ছাড়া খাবেন না বলে বায়না ধরলে আসমা তাঁদের মায়ের ওফাতের খবর দেন। তাঁরা মায়ের ঘরে প্রবেশ করার পর পরই হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু উপস্থিত হন এবং নিজেকে সামলে নিয়ে সন্তানদেরকে শান্তনা দিয়ে কাফন-দাফনের প্রস্তুতি নেন।
খাতুনে জান্নাত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা অত্যন্ত লজ্জাবতী মহিলা ছিলেন। ওফাতের সময় ঘনিয়ে এলে তিনি আসমাকে বললেন, কোন মহিলার মৃত দেহ খোলা অবস্থায় কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া আমার অপছন্দ। আসমা বললেন, আমি হাবশায় একটা চমৎকার ব্যবস্থা দেখেছি, অনুমতি দিলে তা পেশ করতে পারি। এ বলে কয়েকটি খেজুরের ডাল এনে তার উপর কাপড় টানিয়ে দেন। এভাবে পর্দার ব্যবস্থা করা হয়। এ উপায়টি হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার নিকট বেশ পছন্দ হয় এবং তিনি খুব খুশি হন। [ইবনুল আসীর] অসিয়ত মোতাবেক, তাকে রাতের অন্ধকারে জান্নাতুল বাকী শরীফে দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কলিজার টুকরা কন্যা জানাযায় মাত্র কয়েকজন পারিবারিক সদস্য উপস্থিত ছিলেন। হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মতান্তরে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর জানাযার নামায পড়ান। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর লাশ মোবারক দাফন করতে নামান।
উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে একথা সুস্পষ্ট হয় যে, বুতুলে মোস্তফা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম নারী আদর্শের নমুনা। তাঁর সর্বোত্তম আদর্শ ও সৎচরিত্রের জন্য নারী সমাজে তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অনুপম আদর্শ। তাই তিনি সকল মুসলমানের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্রী। কেননা, তাঁর পার্থিব জীবনের শুরু থেকে প্রতিটি সময় পুতঃপবিত্র হিসেবে অতিবাহিত হতে থাকে। আমাদের নারী সমাজ যদি হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার আদর্শকে অনুসরণ করে, তাহলে নারীদের ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি মিলবে নিঃসন্দেহে। অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার এ যুগে হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার সর্বোত্তম আদর্শই পারে নারী সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। তাই তাঁর অনুপম জীবন ও কর্ম অনুসরণের মাধ্যমেই আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসৃত পথ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আ-মী-ন।