Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

সূফী ও সূফীবাদ

সূফী ও সূফীবাদ

সূফী ও সূফীবাদ

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান

==

‘তাসাওফ’ বা সূফীবাদের বুনিয়াদ ও হাক্বীক্বত সম্পর্কে নানা ধরনের মতবিরোধ ও বিভিন্ন ধরনের ভুল ব্যাখ্যা দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। ত্বরীক্বতের নির্ভরযোগ্য ইমামগণ ও মা’রিফাত বিশিষ্ট বুযুর্গদের এ মর্মে ঐকমত্য রয়েছে যে, ‘তাসাওফ’ (সূফীবাদ) হচ্ছে মূলত নিজের দ্বীনকে নিরেট আল্লাহর জন্য করে নেওয়া। অর্থাৎ নিজে নিজেকে যাহিরে ও বাত্বিনে (বাহ্যিকভাবে ও অন্তরের দিক দিয়ে) আয়াত وَاَخَْلصُوْا دِيْنَهُمْ لِلهِ (তারা তাদের দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য করে নিয়েছে)-এর অনুরূপ করে নেওয়াই। [সূত্র. শামস্ -ই মা’নভী, পৃ.১৬২] ‘তাসাওফ’-এর সর্বোচ্চ মূলনীতি হচ্ছে- ‘খূদী’ ও ‘খোদ গরযী’ (আত্ম গৌরব ও স্বার্থপরতা) বর্জন করা। ‘সূফী’ কখনো নিজের কথা চিন্তা করবেন না, অহংকার ও আত্মদর্শন পরিহার করে কায়মনোবাক্যে ও অর্থ দিয়ে স্বজাতীয়দের সাহায্য ও সহযোগিতা করতে থাকবেন।
[সূত্র. অমুসলিম লেখক এম.এইচ. পি. প্লিউটস্কী কৃত. ‘তাহিয়্যাহ্ সূফী’ থেকে সংক্ষেপিত, লুধিয়ানা থেকে মুদ্রিত ও প্রচারিত] উল্লেখ্য, ‘তাহিয়্যাহ্ সূফী’ পুস্তকের লেখক আরো লিখেছেন যে, ‘তাহিয়্যাহ্ সূফী’ হচ্ছে- ‘ইলমে ইলাহী’ (আল্লাহ্ সম্পর্কিত জ্ঞান) ও ‘ইলমে রূহানী’ (আত্মা সম্পর্কিত জ্ঞান বা শাস্ত্র)-এর অপর নাম। ‘তাহিয়্যাহ্ সূফীকুল সোসাইটী’ ওই সংস্থাকে বলা হয়, যাতে মানববন্ধু খোদাভীরু লোকেরা সম্পৃক্ত থাকেন। আর যাঁরা ‘ইলমে রূহানী’র প্রসারের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা কায়েম করেন। তাঁরা মানব জাতির মধ্যে ভালবাসা ও সমবেদনা বৃদ্ধি করার জন্য সচেষ্ট থাকেন। আর এমন সব পদ্ধতি বের করার জন্য চিন্তা-গবেষণা চালান, যা দ্বারা মানুষের মধ্যেকার পারস্পরিক বিরোধ ও হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদির মতো মন্দচরিত্র সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষ হয়ে যায়’ যাতে প্রতিটি মানুষ অতি সহজে রূহানী (আত্মিক) উন্নতি লাভ করতে পারে। [সূত্র. ‘তাহিয়্যাহ্ সূফী’ কি?]

‘সূফী’ (صوفى) শব্দের উৎপত্তি
‘সূফী’ শব্দটির উৎপত্তি সম্পর্কে বিরাট মতবিরোধ রয়েছে।
১. কেউ কেউ বলেছেন-এটা ‘আসহাব-ই সুফ্ফাহ্’ (اصحاب صفه) থেকে গৃহীত। সুতরাং এটা আরবী শব্দ। ‘আসহাব-ই সোফ্ফাহ্’ হচ্ছেন ওই সকল সাহাবী, (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম), যারা ‘মসজিদ-ই নবভী’ শরীফে রাতদিন একটি স্থানে অবস্থান করতেন এবং রিয়াযত (সাধনা), ইবাদত ও জ্ঞানচর্চায় মশগুল থাকতেন। এসব হযরত জিহাদ ব্যতীত অন্যত্র যেতেন না।
পর্যালোচনা: কিন্তু আভিধানিক দিক দিয়ে ‘সোফ্ফাহ্’ থেকে ‘সূফী’ (صوفى) হয় না, বরং صفوى (সাফাভী) হয়। তাই ‘সূফী’ শব্দের এ উৎসটি প্রশ্নবিদ্ধ হলো।
২. কেউ কেউ বলেন, ‘সূফী’ (صوفى) শব্দটা صف (সফ্) থেকে গৃহীত। ‘সফ’ও আরবি শব্দ। এর অর্থ ‘কাতার’ বা ‘লাইন’। যেহেতু সম্মানিত সূফীগণ আল্লাহর নৈকট্যের ক্ষেত্রে সবার আগের কাতারের, সেহেতু তাঁদের উপাধি ‘সূফী’ হয়েছে।
পর্যালোচনা:এ অভিমতের ক্ষেত্রেও আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে একই আপত্তি আসে। অর্থাৎ ‘সফ’ (صفٌّ) থেকে হলে শব্দটা صفى (সফ্ফী) হবে, ‘সূফী’ হবে না।
৩. কেউ কেউ বলেছেন, ‘মূলত শব্দটা ‘সফভী’ (صفوى) ছিলো। বহুলভাবে ব্যবহার হবার কারণে শেষ পর্যন্ত صوفى (সূফী) হয়েছে।
৪. আল্লামা ইবনে খুল্লাদূন লিখেছেন, যেহেতু সূফীগণ صوف (সূফ) বা পশমী পোশাক পরিধান করতেন, সেহেতু তাঁরা ‘সূফী’ (صوفى) নামে অভিহিত হন।
পর্যালোচনা: কিন্তু এ ধারণাকেও কেউ কেউ সঠিক বলে মনে করেন না। কারণ, সূফীদের মতে পশমী পোশাক পরা অপরিহার্য নয়। সূফীগণ ও সূফীতত্বের ইমাম, ইমাম ক্বোশায়রী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘রিসালাহ্-ই ক্বোশায়রিয়্যাহ্’তে লিখেছেন, ‘‘পশমী পোশাক পরা এ সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য নয়।’’ যদিও হয়তো প্রাথমিক পর্যায়ে সূফীগণ পশমী পোশাক পরে থাকতেন, পরবর্তীতে এর ব্যবহার বর্জন করা হয়েছে।
৫. কেউ কেউ বলেছেন, ‘সূফী’ শব্দটা ইউনানী (গ্রীক) শব্দ سوف (সূফ) থেকে নেওয়া হয়েছে। গ্রীক ভাষায় ‘সূফ’ (سوف) মানে ‘হিকমত’ (বিজ্ঞান, দর্শন ও রহস্যজ্ঞান)। যেহেতু সূফীদের মধ্যে ‘গ্রীক দার্শনিকদের’ (اشراقى حكماء) মতো জীবনযাত্রার ধরণ পাওয়া যায়, সেহেতু তাঁরা ‘সূফী’ (سوفى) নামে পরিচিত হয়েছেন। পরবর্তীতে আরবি ভাষায় س (সীন) ص (সোয়াদ) দ্বারা পরিবর্তিত হয়ে صوفى হয়েছে। উল্লেখ্য, ‘ইশরাক্বীগণ’ বলা হয়- ওইসব দার্শনিককে, যাঁরা কাশ্ফের মাধ্যমে শীষ্যদেরকে দূরে বসেও শিক্ষা দিতে সক্ষম। [সূত্র. ফী-রূযুল লুগাত]

পর্যালোচনা: এ ধারনাও সঠিক নয়। কারণ, আমাদের সম্মানিত সূফীগণের ‘ইশ্রাক্বী হুকামা’ (গ্রীক-দার্শনিকগণ প্রমুখ)-এর জীবনযাত্রার সাথে কোন সম্পর্কই ছিলো না, এখনো নেই। কারণ, حقائق اشياء (বস্তুগুলোর বাস্তবাবস্থাদি) জানার পদ্ধতিগুলোর ধারকদের বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনা করলে বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট হয়ে যায়।

বস্তুগুলোর হাক্বীক্বত বা বাস্তবাবস্থার জ্ঞানের ধারক এবং এ বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনাকারীদের চারটি দল
এক. ‘সূফী’। এ যোগ্যতা ‘নূর-ই নুবূয়ত’ (নবী আলায়হিস্ সালাম-এর নূর) এবং রসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ, রিয়াযত-মুজাহাজাহ্ (আধ্যাত্মিক সাধনা) সুস্থ বিবেক (আক্বল-ই সলীম) থেকে অর্জিত হয়। একজন সম্মানিত সূফী এগুলো দ্বারা দেখে থাকেন। এ তরীক্বা (পদ্ধতি)’র প্রতিষ্ঠাতা হলেন নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম। তাঁদের উন্নতির কোন সীমা নেই।

দুই. ইশ্রাক্বী। তাঁরা ব্যক্তিগত কাশ্ফ, জ্ঞান ও বিবেকের উপর নির্ভর করে থাকেন। এ পদ্ধতির প্রবর্তক হলেন- ‘আফলাতূন’ (প্লেটো)। তাঁদের উন্নতির শেষ সীমা হচ্ছে ‘সাওয়ানিহ্-ই নূরীয়াহ্’ (আলোকিত ঘটনাবলী দর্শন করা)। এর উপরে নয়।

তিন.মুতাকাল্লিমীন। অর্থাৎ ‘ইলমে কালাম’-এর ধারকগণ। তাঁরা ‘ইল্ম-ই দ্বীন’ ও ‘মানতিক্ব’ (যুক্তিবিদ্যা)’র উপর নির্ভর করে থাকেন। এর প্রবর্তক হলেন ‘ইলম-ই মানতিক্ব-এর আলিমগণ।

চার.‘মাশ্শা-‘ঈন’। অর্থাৎ বিশেষ পথে বিচরণকারীগণ। পারিভাষিক অর্থে, তাঁরা হলেন ওইসব দার্শনিক, জ্ঞানী ও বিবেকসম্পন্ন লোক, যাঁরা দলীলাদি ও বাহ্যিক আলামত বা চিহ্ণাদির সমন্বয়ে বস্তুগুলোর হাক্বীক্বত উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে নিজেদের লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে থাকেন। এর প্রবর্তক হলেন এরিস্টটল। উপরোক্ত বর্ণনা থেকে একথা সুস্পষ্ট হলো যে, ‘সূফী’ ও ‘ইশরাক্বী’ (গ্রীক দার্শনিক ইত্যাদির)-এর মধ্যে কত বেশী ব্যবধান রয়েছে। তরাং ‘সূফী’ শব্দটা গ্রীক শব্দ سوف (সূফ) থেকে গৃহীত বলা সঠিক নয়।

৬. কেউ কেউ লিখেছেন যে, ‘সূফী’ ‘আলে সূফ’ (ال صوف) বা পশমের লেবাসধারী সংসারত্যাগী জনগোষ্ঠীর প্রতি সম্পৃক্ত। কারণ, জাহেলিয়্যাহ্ বা অন্ধকার যুগে এক শ্রেণীর লোক ছিলো, যারা সংসার ত্যাগ করে ইবাদত করতো, খানা-ই কা’বার খিদমত করতো। ইসলামের বিজয়ের পর এ সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব আর নেই।

৭. কেউ কেউ বলেছেন, ‘সূফী’ (صوفى) صوفة القفا (সূফাতুল ক্বাফা)’র দিকে সম্পৃক্ত। মাথার পেছনের অংশের চুলগুচ্ছকে আরবীতে ‘সূফাতুল ক্বাফা’ বলা হয়। যদি কারো মাথার পেছনের চুলের গুচ্ছ ধরে ফেলা হয়, তবে সে বাধ্য ও অসহায় হয়ে যায়। সুতরাং যেহেতু ‘সূফী’ আল্লাহর ইবাদত করতে বাধ্য থাকেন, সেহেতু এটা বুঝে নেওয়া হয় যেন তার মাথার চুলগুচ্ছ ধরে তাকে বাধ্য করে ফেলা হয়েছে এবং এভাবে তাকে আল্লাহর দিকে ফেরানো হয়েছে।

৮. হযরত জুনায়দ বাগদাদী আলায়হির রাহমাহ্র অভিমত হচ্ছে – ‘সূফী’ (صوفى) صفا (সাফা) থেকে গৃহীত। ‘সাফা’ মানে পরিচ্ছন্নতা। সূফীর যাহির ও বাত্বিন পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে।

পর্যালোচনা: কেউ কেউ এ অভিমত সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন যে, এ কথাটা যদিও আভিধানিক নিয়মের পরিপন্থী, কিন্তু যেহেতু ‘সূফী’ যাহেরী ও বাতেনী (বাহ্যিক ও আত্মিক) পরিচ্ছন্নতা দ্বারা সজ্জিত থাকেন, সেহেতু শব্দটার এ উৎস তার অবস্থার অনুরূপই। এ শব্দটিও ওইসব প্রাচীন শব্দাবলীর অন্যতম, যেগুলো মৌলিক নিয়মাবলী রচনা বা প্রণয়নের পূর্ব থেকে প্রচলিত ছিলো।

৯. হাফেয ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর ‘ফাতাওয়া-ই হাদীসিয়্যাহ্’য় লিখেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর স্মরণে মশগুল থাকে আর উদাসীনতা থেকে আপন ক্বলব (হৃদয়)কে মুক্ত রাখে তার নাম ‘সূফী’ রাখা হয়েছে। এ নামকরণও করা হয়েছে আজ থেকে দু’শত বছর আগে। এক ওহাবী মৌলভী আবদুস্ সালাম নদভী বলেছে- ইসলামে ‘তাসাওফ’ (সূফীবাদ) যেমন অতি সাম্প্রতিককালীন নব আবিস্কৃত শব্দ, তেমনি ‘সূফী’ উপাধিটাও বাগদাদবাসীদের আবিস্কৃত। তার খণ্ডন ইন্শা-আল্লাহ্ এক্ষুণি করার প্রয়াস পাচ্ছি।
‘তাসাওফ’ ও ‘সূফী’ সাম্প্রতিককালীন আবিস্কার নয়, বরং বহু প্রাচীন
‘নদভী’ সাহেবদের উপরোক্ত খেয়াল বা ধারণাটা ভুল। কেনন-

এক.‘ক্বুরূন-ই সালাসাহ্’ (ইসলামের প্রাথমিক তিন স্বর্ণযুগ) থেকে এ ‘শব্দ দু’টি’ প্রচলিত। এমন শব্দ বা বিষয়কে নব আবিস্কৃত বলা যেতে পারে না। একটি হাদীস শরীফেও এ শব্দের ব্যবহার হয়েছে। যেমন ‘কাশ্ফুল মাহজূব’ শরীফে আছে, হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন,-
مَنْ سَمِعَ صَوْتَ اَهْلِ التَّصَوُّفِ فَلَمْ يُؤْمِنْ عَلَى
دُعَائِهِمْ كُتِبَ عِنْدَ اللهِ مِنَ الْغَافِلِيْنَ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আহলে তাসাওফ (তাসাওফপন্থী তথা সূফীগণ)-এর আওয়াজ শুনে তাঁদের দাওয়াত কবূল করেনি, সে আল্লাহর নিকট গাফিলদের মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়। [সূত্র. কাশ্ফুল মাহজূব: তৃতীয় অধ্যায়: দশম পরিচ্ছেদ]

দুই. শায়খ আবুন্ নাস্র র্সারাজ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর ‘কিতাবুল লাম’ইতে লিখেছেন, ইসলামের পূর্বে এক ‘সূফী’ মক্কা মুর্কারমায় আসতেন।

তিন.‘আখ্বার-ই মক্কা’য় আছে- ‘সূফী’ শব্দটা আরবে ইসলামের পূর্বেও প্রচলিত ছিলো। ‘তাসাওফ-ই ইসলাম’ নামক কিতাবের ৩২ নং পৃষ্ঠায় হযরত ইমাম হাসান বসরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির অভিমত উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘‘আমি এক সূফীকে তাওয়াফ করতে দেখেছি।’’ ইমাম হাসান বসরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হিজরী প্রথম শতাব্দির শেষ ভাগে, ১১০ হিজরিতে ওফাত বরণ করেছিলেন।

উক্ত কিতাবের অন্যত্র লিপিবদ্ধ হয়েছে- ‘সূফী’ শব্দটা ইমাম হাসান বসরী ও ইমাম সুফিয়ান সওরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির বক্তব্যে রয়েছে। ড. যোবায়র আহমদ, লেকচারার, আরবী-ফার্সী বিভাগ, এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি, লিখেছেন, ‘তাসাওফ’ শব্দটা হযরত হাসান বসরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি (ওফাত ১১০ হি.)’র যুগে প্রচলিত ছিলো। কেননা, তাঁর ও হযরত সুফিয়ান সওরী রহমাতুল্লাহি আলায়হিমার বাণীগুলোতে এ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ইমাম সুফিয়ান সওরী আলায়হির রাহমাহ্ ১৬১ হিজরীতে ওফাত বরণ করেন। সুতরাং একথা প্রমাণিত হলো যে, ‘তাসাওফ’ শব্দটা আরবে ইসলামের পূর্বেও ছিলো। আর মুসলমানদের মধ্যে প্রথম শতাব্দি থেকে বহুলভাবে প্রচলিত হয়ে আসছে। এ কারণে সেটাকে নব আবিস্কৃত বলা ঠিক হবে না।

চার. আল্লামা লুত্বফী হাজ‘আহ্ মিশরী তাঁর কিতাব ‘ফালাসাফাতুল ইসলাম’-এ লিখেছেন, ‘সূফী’ ইউনানী (গ্রীক) শব্দ ‘সূফিয়ানাহ্’ (سوفيانه) থেকে নির্গত। এর অর্থ ‘হিকমত-ই এলাহী’। (আল্লাহ্ সম্পর্কিত দর্শন)। সূফীগণ এ জ্ঞান ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকাশ করেননি এবং ততক্ষণ পর্যন্ত ‘সূফী’ উপাধি গ্রহণ করেননি, যতক্ষণ পর্যন্ত ইউনানী (গ্রীক) ভাষার কিতাবাদি আরবী ভাষায় অনুবাদ করা হয়নি। উল্লেখ্য, তাঁর একথা সঠিক নয়। কেননা, এ বিষয় অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, হযরত আবূ হাশিম ১৬১ হিজরীর পূর্বে ‘সূফী’ হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। সুতরাং হযরত সুফিয়ান সওরী, যাঁর ওফাত হয়েছিলো ১৬১হিজরীতে বসরায়, শায়খ আবূ হাশেম ক্বুদ্দিসা সিররুহু সম্পর্কে এরশাদ করেছিলেন, ‘‘যদি শায়খ আবূ হাশেম সূফীর মহান সত্তা সৃষ্টি না হতো, তাহলে আমরা ‘রিয়া’ (লোক দেখানো)’র সূক্ষ্ম বিষয়গুলো বুঝতে পারতাম না।’’ হযরত সূফিয়ান সওরী একথাও বলতেন, ‘‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমি শায়খ আবূ হাশিমকে দেখিনি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার জানা ছিলো না ‘সূফী’ কাকে বলে।’’ [সূত্র. নাফহাতুল উন্স, অনুবাদ,
কৃত. মাওলানা জামী. পৃ. ১৭৭ ও আওয়ারিফুল মা‘আরিফ, পৃ. ২৫৪]

পর্যালোচনা: ইমাম হাসান বসরী আলায়হির রাহমাহ্র পুস্তক ‘ইখলাস’ তাসাওফ শাস্ত্রে লিখিত কিতাবাদির অন্যতম। বস্তুত এ ‘তাসাওফ’ ও ‘সূফী’ উপাধি হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দির প্রথম চতুর্থাংশে প্রচলিত হয়েছে। আর ‘সূফী’ শব্দটা আরবী। সুতরাং সেটাকে ইউনানী ভাষার কোন শব্দ থেকে নির্গত বলে মনে করা এবং সূফীয়ানা ধ্যান-ধারনাকে ‘গ্রীক তাসাওফ’ (গ্রীক সুফিবাদ) থেকে গৃহীত বলে মনে করা ভুল। কারণ, হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দির প্রথম চতুর্থাংশ পর্যন্ত কোন ইউনানী (গ্রীক) ভাষার কিতাব (গ্রন্থ-পুস্তক) অনূদিত হয়নি। আব্বাসী খিলাফতামলে অনুবাদ কর্ম বহুলভাবে আরম্ভ হয়েছে।
‘সূফী’ (صوفى)’র সংজ্ঞা প্রসঙ্গে মাশাইখে কেরামের আরো কিছু অভিমত

এক.‘কাশ্ফুল মাহজুব’-এ হুযূর দাতা গঞ্জে বখ্শ আলায়হির রাহমাহ্ ‘সূফী’র সংজ্ঞা এভাবে দিয়েছেন-
جو محبت كےذريعه صاف هوا وه صافى هوا اور جو محبت حبيب
ميں مستغرق هوا وه غير محبوب سے برى هوا وه صوفى هوگيا
অর্থাৎ যে ব্যক্তি ভালবাসার মাধ্যমে সাফ বা পরিচ্ছন্ন হয়েছে, সে ‘সাফী’ হয়েছে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মধ্যে ভালবাসায় নিমজ্জিত হয়েছেন, তিনি মাহবূব ব্যতীত অন্য সব থেকে মুক্ত হয়ে ‘সূফী’ হয়েছেন। [সূত্র. কাশ্ফুল মাহজূব, পৃ. ১১৯]

দুই. অভিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে صوفى (সূফী) গুণবাচক নামটি مشتق তথা অন্য কোন শব্দ থেকে নির্গত বলা শুদ্ধ হবে না। কারণ, ‘সূফী’ (صوفى) শব্দটি তারা আভিধানিক অর্থ থেকে বহু দূরে। কারণ, সেটাকে আভিধানিক অর্থ অনুসারে দেখা হলে جنس (জাতিবাচক বিশেষ্য) বলতে হবে, যাতে ওই جنس (জাতিবাচক বিশেষ্য) অন্য جنس (জাতিবাচক বিশেষ্য) থেকে নির্গত হতে পারে। কেননা প্রতিটি مشتق (নির্গত শব্দ) তার উৎসের স্বজাতীয় হওয়া অপরিহার্য। আর সূফী (صوفى) শব্দটা যে অর্থের সাথে সম্পৃক্ত, তা হচ্ছে صافى ও مصفّى (যথাক্রমে, পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন)। অথচ صوفى শব্দের মূল অক্ষরগুলো صافى ও مصفى-এর মূল অক্ষরগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। (যেমন- صوفى-এর মূল অক্ষরগুলো হচ্ছে ص ـ و ـ ف আর صافى ও مصفى-এর মূল অক্ষরগুলো হচ্ছে ص ـ ف ـ و) সুতরাং কোন শব্দ তার বিপরীত বা সামঞ্জস্যহীন শব্দ থেকে নির্গত হওয়া শুদ্ধ নয়। সুতরাং এ কথা মধ্যাহ্ণ সূর্যের চেয়েও স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, সম্মানিত সূফীগণ (তাসাওফপন্থী ইমামগণ) -এর মতে ‘সূফী’ শব্দটা সংজ্ঞার মুখাপেক্ষী নয়; সেটার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। কারণ, ‘সূফী’ বচন ও ইঙ্গিত (عبارت واشاره)-এরও ঊর্ধ্বে। সুতরাং সমগ্র জাহান সেটার জন্য অর্থ ও ব্যাখ্যা চয়ন করবে। আর কেউ সেটার হাক্বীক্বতকে বুঝুক কিংবা না-ই বুঝুক ‘সূফী’ নামের জন্য ওই ব্যাখ্যার ব্যাপারে কোন আশঙ্কা নেই।
তিন.এভাবেও বলা যায়- যে সব লোকের ‘অর্থ ও হাক্বীক্বত’ উভয়টি হাসিল হয়ে যায় কামিল-বুযুর্গগণ তাঁদেরকেই ‘সূফী’ (صوفى) বলেন। আর যে সব লোক ওই পূর্ণতা অšে¦ষণকারী হয়; কিন্তু এখনো তাদের পূর্ণতার হাক্বীক্বত অর্জিত হয়নি; তবে কামিল বুযুর্গ ব্যক্তিবর্গের সাথে তাদের সম্পর্ক অটুট রয়েছে। তাদেরকে পরিভাষায় ‘সূফী’ বলা যাবে না বরং ‘মুতাসাওভিফ (متصوف) বলা হবে।
চার. ‘তাসাওফ’ (تُصَوُّفٌ)‘ইলমে সরফ’ অনুসারে بَاب تفعُّلٌ -এর মাসদার। এ ‘বাব’-এর خاصيت (বৈশিষ্ট্য) সরফবিদগণ تكلف (তাকাল্লুফ) বলেছেন। تَكلّف -এর অর্থ শুধু ‘লৌকিকতা’ ও ‘বানোয়াট’ অবলম্বন করা নয় বরং ‘কঠোর পরিশ্রম’ও হতে পারে। ‘তাসাওফ’-এর পথ অবলম্বন করতে গিয়ে ‘তাসাওফপন্থীদের’কে কঠোর পরিশ্রম ও বহুবিধ কষ্টের বিভিন্ন সোপান অতিক্রম করতে হয়।

‘তাসাওফ’-এর বিভিন্ন স্তর
‘তাসাওফ’ বা সূফীবাদের সাথে সম্পৃক্ত লোকেরা তিন প্রকার: ১. ‘সূফী, ২. মুতাসাওয়িফ ও ৩. মুস্তাস্ভিফ (مستصوف)।
ওইগুলোর ব্যাখ্যা: ১. ‘সূফী’ হচ্ছেন তিনি যিনি, নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে আল্লাহর সাথে মিলিত হয়ে ‘বাক্বী’ (স্থায়ী) হয়ে গেছেন; নিজের মেযাজ ও স্বভাবের বন্দি থেকে মুক্ত হয়ে ‘হাক্বীক্বতুল হাক্বা-ইক্ব’ (হাক্বীক্বতগুলোর হাক্বীক্বত) অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলাতে বিলীন (ফানা) হয়ে গেছেন।

২. ‘মুতাসাওভিফ’ (متصوف) হলেন তিনি যিনি, ওই মর্যাদা অর্জন করার মধ্যে কঠোর পরিশ্রম ও সাধনায় রত আছেন, সম্মানিত সূফীগণের পন্থা ও পদ্ধতির অনুসরণে নিজের সংশোধন (আত্মশুদ্ধি) করতে সচেষ্ট আছেন। আর

৩. ‘মুস্তাসভিফ’ (مستصوف) হচ্ছে ওই ব্যক্তি, যে পার্থিব সম্পদ ও কাক্সিক্ষত সুনাম ও সমৃদ্ধি অর্জনের উদ্দেশ্যে সম্মানিত সূফীগণের কর্মপন্থা (নিছক লোক দেখানোর জন্য) অবলম্বন করে থাকে, সূফীগণের বিভিন্ন উক্তি আওড়িয়ে বেড়ায়, কিন্তু নিজে ওইগুলো সম্পর্কে অবগত নয়। এসব লোক সম্পর্কে মাশাইখ-ই কেরাম মন্তব্য করেছেন- এ তৃতীয় প্রকারের লোক, অর্থাৎ ‘মুস্তাস্ভিফ’ সম্মানিত সূফীগণের মতে হীন মাছির মতোই। আর জনসাধারণের জন্য এ মুস্তাস্ভিফ (ভণ্ড সূফী) নেকড়ে বাঘের মতো। কারণ, সে যা কিছু করে, তা দ্বারা তার উদ্দেশ্য থাকে কিছুটা পার্থিব যশখ্যাতি ও সম্পদ- সমৃদ্ধি অর্জন করা। স্মর্তব্য যে, এমন চরিত্র ও উদ্দেশ্য শুধু এ তৃতীয় প্রকারের মধ্যে বিদ্যমান, প্রথমোক্ত দু’প্রকারের বৈশিষ্ট্যাদি ওই দু’প্রকারের সংজ্ঞা থেকে স্পষ্ট হয়েছে।
সারকথা হলো- ‘সূফী’ হলেন ‘সাহেব ওসূল’ (صاحب وصول)। অর্থাৎ আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছেছেন এমন, ‘মুতাসাওভিফ’ হলেন ‘সাহেবে উসূল’ (صاحب اصول), অর্থাৎ সূফীগণ ও কামিল মুর্শিদের প্রদত্ত সবক্ব-আসবাক্ব, ওযীফা-ওযাইফ ও অন্যান্য নিয়মাবলী মেনে চলে ‘সম্মানিত সূফী’র মর্যাদায় পৌঁছার জন্য প্রচেষ্টা (সাধনা) চালায় এমন। আর ‘মুস্তাস্ভিফ’ হলো- ‘সাহেবে ফুযূল’ (صاحب فضول), অর্থাৎ অনর্থক কর্মপন্থা অবলম্বনকারী। সুতরাং ‘মুতাসাওভিফ’ হলো প্রকৃত সূফীর মর্যাদা অন্বেষণকারী আর ‘মুস্তাস্ভিফ’ (বানোয়াট সূফী) হলো নিছক বাজে লোক।  [সূত্র. কাশ্ফুল মাহজূব, কৃত. হযরত দাতাগঞ্জে বখ্শ হাজভীরী-লাহোরী আলায়হির রাহমাহ্]

এ ‘কাশ্ফুল মাহজূব’-এ আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত যুন্নূন মিসরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেছেন, ‘সূফী’ হচ্ছেন তিনিই, যিনি কথা বলার সময় তাঁর কথার অবস্থার হাক্বীক্বত (বাস্তবতা) প্রকাশ পায়। আর তিনি এমন কোন কথা বলেন না, যা তাঁর মধ্যে নেই। যখন তিনি নিশ্চুপ থাকেন, তখন তাঁর নীরবতাও তাঁর অবস্থার নীরব বর্ণনা দেয়। আর পার্থিব-সম্পর্কগুলোর প্রতি অনাসক্তির প্রমাণ তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে স্পষ্ট হয়। একথা এভাবেও বলা যায়-
گفتار صوفى اس كےحسب حال هو اور كردار صوفى ميں شان تجريد (تنهائى) اس قدر هوكه دنيا سےاسكا قطع تعلق واضح طور نظر ائے
অর্থাৎ সূফীর কথা তাঁর অবস্থার অনুরূপ হবে, সূফীর কর্মের মধ্যে একাকীত্বের শান এতবেশী পরিমাণে থাকবে যে, দুনিয়ার প্রতি তাঁর অনাসক্তি একেবারে স্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হবে।
মোটকথা, যদি তিনি কথা বলেন, তবে তাঁর কথায় তাঁর সত্যতা ও বাস্তবতা ভেসে ওঠে, শুধু সত্যতাই গোচরীভূত হয়; আর চুপ থাকলে তাঁর নীরবতা থেকে তাঁর ‘আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষিতা’ই নজরে পড়ে।

হযরত জুনায়দ বাগদাদী আলায়হির রাহমাহ্ বলেছেন- ‘তাসাওফ’ এমন এক গুণ যে, বান্দা এ গুণ সহকারে ‘বান্দা’ হিসেবে স্থির থাকে। অর্থাৎ ‘তাসাওফ’-এর হাক্বীক্বত বা বাস্তবতা হচ্ছে- বান্দা তার গুণ (অবস্থা)কে ফানা (বিলীন) করবে। অতঃপর যখন বান্দার গুণাবলী ফানা হয়ে যাবে, তখন তার ‘সিফাতে হক্ব’ (বাস্তবাবস্থা বা খোদা প্রদত্ত বিশেষ গুণ) অবশিষ্ট থেকে যাবে। এটাই তো প্রকৃত তাসাওফ। আর ‘রসমী তাসাওফ’ (প্রথাগত সূফীবাদ)-এর দাবীও হচ্ছে এ যে, বান্দা সবসময় রিয়াযত বা সাধনা করতে থাকবে এবং আপন ‘সিফাতে বশরী’ (মানবীয়গুণ বা অবস্থা সর্বদা) নিয়মিতভাবে ফানা বা বিলীন করতে থাকবে।

হযরত আবুল হাসান নূরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেছেন, ‘তাসাওফ’ হচ্ছে সমস্ত রিপুগত প্রবৃত্তি ও চাহিদা বর্জন করার নাম। আর এটা দু’ভাবে হতে পারে-একটা হচ্ছে প্রথাগতভাবে, আর অপরটি প্রকৃত ও বাস্তবাকারে। সুতরাং হযরত হাসান নূরী ‘সূফী’র সংজ্ঞা এভাবে দিয়েছেন: সূফীগণ হচ্ছেন তাঁরাই, যাঁদের রূহ্ মানবীয় পঙ্কিলতা থেকে পাক-সাফ হয়ে গেছে এবং সমস্ত রিপুগত আপদ থেকে পবিত্র হয়ে লোভ ও মনের কুপ্রবৃত্তিগুলো থেকে মুক্তি লাভ করে আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে প্রথম কাতারে, আল্লাহর নৈকট্যের মর্যাদা পেয়ে গেছে। আর আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কেউ তথা খোদাদ্রোহীদের থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে।

তিনি (হযরত হাসান নূরী) আরো বলেন, ‘সূফী’ হলেন তিনি, যিনি না কোন কিছুর মালিক হন, না তিনি (আল্লাহ্ ও রসূল ব্যতীত) অন্য কারো মালিকানাধীন হন। অর্থাৎ ‘সূফী’ হলেন তিনি, যার করায়ত্ব না কিছু বন্দি থাকে, না তিনি কারো নিকট বন্দি থাকেন।’’

এর ব্যাখ্যা: ‘সূফী’ নিজে নিজে না দুনিয়া ও আখিরাতে কোন জিনিষের মালিক হতে চান, না তিনি নাফ্স (প্রবৃত্তি), লোভ ও মনের ইচ্ছাদির মালিকানাধীন হন। তিনি আপন ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যকে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছু (খোদাদ্রোহী) থেকে মুক্ত করে নেন, যাতে ওই খোদাদ্রোহী, এ বান্দা থেকে তার আনুগত্যের আশা করতে না পারে।

হযরত আবুল মুরতা‘ইশ আলায়হির রাহমাহ্ ‘সূফী’র সংজ্ঞায় বলেছেন- ‘সূফী’ হলেন তিনিই, তাঁর মনের খেয়াল বা ধারণাও তাঁর ইচ্ছার কদম থেকে মোটেই আগে বাড়তে পারে না। সবসময় তাঁর ইচ্ছা, আশঙ্কা ও মনের খেয়াল বা ধারণা এক সমান থাকে। অর্থাৎ তাঁর দেহ্ যেখানে থাকে, তার হৃদয়ও সেখানে থাকে। যে মাক্বামে হৃদয় থাকে ওই স্থানে তার দেহও থাকে। যেখানে তার কদম থাকে, সেখানেই তার কথা থাকে, যেখানে তার কথা থাকে সেখানেই তার কদম থাকে।

হযরত শিবলী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, ‘সূফী’ হলেন তিনি, যিনি উভয় জাহানে ‘যাত-ই ক্বদীম’ (অবিনশ্বর সত্তা) অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলার মহান সত্তা ব্যতীত অন্য কিছু দেখেন না। যেহেতু বান্দা নিজেও ‘গায়রুল্লাহ্’ বা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছু, সেহেতু ‘গায়রুল্লাহ’কে না দেখার মধ্যে নিজে নিজেকে না দেখাও সামিল রয়েছে। সুতরাং ‘সূফী’ যেন ‘নফী ও ইসবাত’-এর অবস্থায় নিজের ব্যাপারেও বে-খবর থাকেন।

হযরত যুন্নূন মিসরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ‘সূফী’র সংজ্ঞায় বলেছেন, ‘সূফী’ হলেন তিনি, যার অস্তিত্বে অস্তিত্বহীনতা নেই। আবার তাঁর অস্তিত্বহীনতা অস্তিত্ব পায় না। অর্থাৎ তিনি যা পান, তা মোটেই কম হয় না, আবার তিনি যা কিছু হারিয়ে ফেলেন, তা আর কখনো অস্তিত্বে আসে না। অন্য ভাষায় এ কথার অর্থ এও হতে পারে যে, ‘সূফী’ হলেন তিনি, যিনি প্রাপ্ত জিনিষকে প্রাপ্ত বলে মনে করেন না, আর যা তিনি পান না, সেটাকে তিনি তাঁর প্রাপ্য বলে মনে করেন না।

পরিশেষে, সারকথা হলো- এ মর্যাদার স্তরে পৌঁছলে একজন ‘সূফী’ এমন হন যে, তিনি মানবীয় অবস্থা থেকে সম্পূর্ণরূপে পতিত হন। অর্থাৎ তাঁর শারীরিক সাক্ষীগুলো তথা অস্তিত্ব আল্লাহ্ তা‘আলার যাত বা সত্তায় বিলীন হয়ে যায় এবং তাঁর পার্থিব সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষ হয়ে যায়, যাতে মানবীয়তার রহস্য তার উপর আল্লাহ্ তা‘আলার ক্বুদরতরূপে প্রকাশ পায়। সুতরাং আমরা নির্দ্ধিধায় একথা বলতে পারি যে, ‘তাসাওফ’ যেমন একজন ঈমানদার মুসলমানদের মধ্যে পূর্ণতা আনতে পারে, তেমনি এমনই পূর্ণতা সম্পন্ন খাঁটি-মু’মিন মুসলমানই হলেন একজন সম্মানিত ‘সূফী’। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের প্রত্যেককে একেকজন খাঁটি সূফী মুসলমান হবার তাওফীক্ব দিন! আমীন।