হুযূর কেবলা আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহ.’র নূরানী তাক্বরীর সম্ভার
নূরানী তাক্বরীর-এক
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
فَتَلَقّٰۤى اٰدَمُ مِنْ رَّبِّهٖ كَلِمٰتٍ فَتَابَ عَلَیْهِؕ-اِنَّهٗ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِیْمُ
[সূরা বাক্বারা : আয়াত ৩৭]
তরজমাঃ অতঃপর হযরত আদম আপন রব থেকে কিছু কলেমা শিখে নিয়েছেন। অতঃপর তিনি তার তাওবা ক্ববুল করেছেন। নিশ্চয় তিনি অত্যন্ত তাওবা কবূলকারী, দয়ালু। [সূরা বাক্বারা: আয়াত-৩৭, কানযুল ঈমান]
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ ফরমায়েছেন-হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম আপন প্রতিপালক হ’তে কিছু কলেমা শিখে নিয়েছেন। অত:পর আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর (হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম-এর) তাওবা কবূল করলেন। নিশ্চয় তিনিই (আল্লাহ্ তা‘আলা) বড় তাওবাহ্ ক্ববূলকারী, অত্যন্ত দয়াবান।
হযরত সাইয়্যেদুনা আদম আলায়হিস সালাম হতে যে বিচ্যুতি প্রকাশ পেয়েছিলো, তিনি ওই বিচ্যুতি ও ভুলের জন্য তিনশ’ বছর যাবৎ ক্রন্দন করতে থাকেন। তাঁর চক্ষুযুগল থেকে এতবেশী অশ্র“ ঝরেছিলো যে, যদি পৃথিবীর সকল লোকের অশ্র“ একত্রিত করা হয়, তবু হযরত আদম আলায়হিস সালাম-এর অশ্রুর সমপরিমাণ হবেনা। হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম নিজের বিচ্যুতির জন্য এতো বেশী ক্রন্দন করেছেন।
তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর হৃদয়ে এক প্রেরণা জাগ্রত (ইলক্বা) করেছিলেন, তাঁর দয়া হলো হযরত আদম আলায়হিস সালাম-এর স্মরণ হলো (ওই সময়ের কথা), যখন তাঁর কায়ায় রূহ ফুৎকার করা হয়েছিলো, ‘তখন তো আমি আরশের প্রতি দৃষ্টি দিতেই আরশের উপর দেখেছিলাম, আল্লাহ্ তা‘আলার নিজের নামের সাথে ‘মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ্’সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নাম লিপিবদ্ধ ছিলো। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ’- কলেমা শরীফ লিখা ছিলো।’
হযরত আদম আলায়হিস সালাম-এর মনে এ ধারণা জন্মালো যে, ‘এ মহান ব্যক্তি মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিশ্চয়ই আল্লাহর এতো প্রিয় যে, তাঁকে তাঁর (আল্লাহ্) নামের সাথে লিখেছেন।’
সুতরাং হযরত আদম আলায়হিস সালাম হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওসীলা নিয়ে নিজের বিচ্যুতির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর (হযরত আদম-এর ত্রুটি বিচ্যুতি ও ভুলকে ক্ষমা করলেন। তাঁর তাওবাহ্ কবূল করলেন। সুবহা-নাল্লাহ্!
আমাদের আক্বা ও মাওলা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর কী শান, কী মহত্ব!
হযরত আদম আলায়হিস সালামকে যে সাজদা করানো হয়েছিলো, তাও হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নূর মুবারককেই করানো হয়েছিলো। তাঁর নিকট (কপালে) যে নূর মওজূদ ছিলো ওই নূরকেই (সম্মানের) সাজদাহ্ করিয়েছেন। অত:পর তাঁর থেকে বিচ্যুতি ও অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে গেলে তাঁর ওসীলায় সেটার ক্ষমাও করা হয়েছিলো, ভুলের ক্ষমা হলো। সুবাহা-নাল্লাহ্! আল্লাহ্র এ কেমন বদান্যতা!
আর আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন-‘এবং যদি এ সব লোক নিজেদের আত্মার প্রতি অবিচার করে, আর তারা, হে হাবীব, আপনার দরবারে আসে, অতঃপর আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে আর রসূল-ই পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামও আল্লাহর কাছে তাদের ক্ষমার জন্য সুপারিশ করেন, তবে তারা আল্লাহকে অত্যন্ত তাওবা ক্ববূলকারী ও দয়াবান পাবে।’
ক্বিসসা খতম। ইতোপূর্বেও বলা হয়েছে যে, হযরত আদম আলায়হিস সালামকে (ফেরেশতাদের দ্বারা) যে সাজদা করানো হয়, তাও হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামা-এর বদৌলতেই।
হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম-এর বিচ্যুতির ক্ষমাও হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওসীলায় হয়েছিলো। এরপর এ বদান্যতার দরজা উন্মুক্ত হলো। তা আর কখনো বন্ধ হয়নি। কারো দ্বারা যদি কখনো কোন অন্যায়, ভুল-ক্রটি বা গুনাহ্ হয়ে যায়, তবে সে যেন তৎক্ষণাৎ নিজের আক্বা ও মাওলা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মনোনিবেশ করে। এমন নয় যে, মদীনা মুনাওয়ারায় চলে যেতে হবে; বরং আল্লাহর অনুগ্রহক্রমে এটাও যথেষ্ট হবে যে, কারো দ্বারা যদি কোন প্রকারের গুনাহ্ হয়ে যায়, তবে সে যেন দু’ রাক‘আত নফল নামায পড়ে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মনোনিবেশ করে এবং তাঁর দরবারে এভাবে আরয করে, “হুযূর! আমার ক্ষমার জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করুন!” আর হুযূর করীমও তার পক্ষে সুপারিশ করেন। তাহলে অবশ্যই আল্লাহ্ তা‘আলা তার গুনাহ্ ক্ষমা করে দেবেন। সুবহা-নাল্লাহ্! রাহমাতুল্লিল ‘আ-লামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এ কী মহা মর্যাদা!
(একদা) হযরত শীস আলায়হিস সালামকে হযরত আদম আলায়হিস সালাম উপদেশ দিলেন, “প্রিয় বৎস! যদি তোমার থেকে কোন প্রকারের ভুল বা ত্রুটি হয়ে যায়, তাহলে তখনই হযরত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যম নিয়ে আল্লাহর কাছে ওই ক্রটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিও।”
তখন হযরত শীষ আলায়হিস সালাম আরয করলেন, “আব্বাজান, তিনি কে?” তখন হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম বললেন, “তিনি আমার বংশধর; তবে তাঁর অনেক অনেক উঁচু মর্যাদা; আমার বিচ্যুতি তাঁর কারণে ক্ষমা হয়েছে। তাই তোমার থেকেও যদি কখনে কোন ধরনের ক্রটি-বিচ্যুতি সম্পন্ন হয়ে যায়, তবে তাঁর ওসীলা নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করিও।”
(হযরত শীস আলায়হিস সালাম বললেন,) “এরপর যখন আমার কোন ধরনের ভুল-ত্রুটি হয়ে যেতো, তখনই আমি হযরত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওসীলা নিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। এতে আমার দো‘আ ক্ববূল হয়ে যায়।”
এখানে (আয়াতে) আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করছেন, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দরজা হচ্ছে আমাদের গুনাহর ক্ষমা হওয়ার দরজা। এ দরজা দিয়ে এসো, যাতে তোমাদের গুনাহর ক্ষমা হয়ে যায়। কিন্তু বাতিল ফিরক্বার লোকেরা কতই মূর্খতার মধ্যে আছে! তারা কতই হতভাগা যে, তারা ওই দরজা থেকে লোকদের দূরে সরিয়ে রাখে। তারা বলে, ‘‘এ দরজা দিয়ে যেয়ো না।’’ উম্মতের জন্য এটা বড় বিপজ্জনক। অতএব, তোমরা এ দরজার পরিচয় লাভ করো এবং এ দরজার চৌকাঠকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো। এ দরজাই উভয় জগতের সাফল্যের চাবিকাঠি।
আর আপনাদের এ সিলসিলাহ্ (তরীক্বাহ্), যে সিলসিলায় আপনারা আছেন, এ সিলসিলার উদ্দেশ্যও এটাই যে, এটা দ্বারা আমাদের স্ব স্ব গন্তব্যস্থলে অর্থাৎ হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-পর্যন্ত পৌঁছানো।
আর এ যাত্রাপথে নানা ধরনের লোক রয়েছে। এ পথে ডাকাতও রয়েছে। ইনশা-আল্লাহুল আযীয, যখন আমাদের সুদৃঢ় ইচ্ছা থাকবে, নিষ্ঠা ও ভালবাসা থাকবে, তখন আমরা এ কাফেলার সাথে থাকবোই।
যখন কোন কাফেলার সাথে পাহারাদার ও সৈন্য বাহিনী মোতায়েন থাকে, তখনতো সেটার উপর কেউ হামলা করতে এ ভেবে ভয় পাবে যে, ‘সবাই ধরা পড়ে যাবো যদি আমরা হামলা করি।’
আলহামদুলিল্লাহ্! আমাদের এ কাফেলায় সায়্যিদুনা আব্দুল ক্বাদির জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু রয়েছেন, শাহানশাহে চৌহরভী ও শাহান শাহে সিরিকোটী সাথে আছেন। আমাদের ভয় করার কোন কারণ নেই। তবে আমাদের উচিত তাঁদের (আর্দশ ও নীতি)কে ভালোভাবে আকঁড়ে ধরা এবং তাঁদের অনুসরণ করে চলা। আল্লাহ্ তা‘আলা আপনাদেরকে এবং আমাদেরকে বুঝার তাওফীক্ব দিন। আ-মী-ন।
আজ দু’বছর পর আপনাদের মধ্যে উপস্থিত হবার সামর্থ্য আল্লাহ্ তা‘আলা দিয়েছেন। এ বিরাট সমাগম ও তরীক্বতের এ বাগান দেখে অত্যন্ত খুশী ও প্রশান্তি অনুভব করছি। আমাদের ও আপনাদের মধ্যেকার যে সম্পর্ক ও ঘনিষ্টতা রয়েছে, তাও হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কারণে ও তাঁরই মাধ্যমে। আমাদের ও আপনাদের মধ্যে যে আত্মিক বন্ধন রয়েছে, যে সম্পর্ক রয়েছে, তাও রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মহান ওসীলায় প্রতিষ্ঠিত। এটাও স্মরণ রাখবেন যে, আমাদের এ সিলসিলার (শিকলের) শেষ কড়া হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র হাতে রয়েছে। মাশা-ইখ হযরাতের মাধ্যমে আপনাদের নিকট এ সিলসিলা পৌঁছেছে। অতএব, এ সিলসিলার আদর্শকে মজবুতভাবে ধারণ করুন। সিলসিলাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং সমস্ত মাশা-ইখ হযরাতের ফুয়ূয়াত ও বরকতরাজি লাভ করে ধন্য হওয়া যাবে। হৃদয়গুলো আলোকিত হবে। আপনাদের বক্ষ আলোকোজ্জ্বল হবে। আপনাদের কাজে বরকত হবে। আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সন্তুষ্টি অর্জিত হবে। অতএব, সিলসিলাকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরুন। যে এটাকে আঁকড়ে ধরবে, সে এ সিলসিলার সমস্ত মাশা-ইখে কেরাম-এর সান্নিধ্য অর্জন করবে।
ওই ব্যক্তি কতোই সৌভাগ্যবান, যিনি মাশা-ইখে কেরামের সান্নিধ্য অর্জন করেছেন। আর তিনি হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শুভ দৃষ্টির আওতায় চলে এসেছেন ।
আপনাদের প্রতি এ আরয করবো যে, সিলসিলার ভাইদের মধ্যে একতা ও পরস্পর ভালবাসা বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। আপনাদের পেছনে ইবলীস শয়তান লেগে আছে; আর শয়তান জঘন্য শক্র। বাতিল ফিরকার লোকেরাও আপনাদের পেছনে লেগে আছে। ইবলীস ও বাতিলদের কাছে আপনারা যেন বিষতুল্য কাঁটা। তাদের চোখে আপনারা বড় বিপদই। এ জন্য ভাইদের অত্যন্ত সজাগ হওয়া চাই এবং পরস্পরের প্রতি ভালবাসা ও সকলে একতাবদ্ধ থাকা চাই। কেননা অনৈক্যে মানুষের মর্যাদা বিনষ্ট হয়। আর আপনাদের অনৈক্যের দরুন হযরতদের বদ্নাম হতে পারে। তখন এটা কতই দুঃখের ব্যাপার হবে যে, আমাদের কারণে আমাদের মাশা-ইখে কেরামের বদনাম হবে!
এজন্য ভাইদের ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং ভাইদের পরস্পরের ভালবাসা অত্যন্ত প্রয়োজন। সে সাথে প্রয়োজন বাতিল ফিরকার ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা।
আপনাদের সামনে মাদ্রাসাগুলো রয়েছে। মাদ্রাসার সুষ্ঠু পরিচালনা ও শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি দৃষ্টি রাখা দরকার। কেননা, মাদ্রাসাগুলো হচ্ছে আলেম তৈরীর কারখানা। এখান হতে আলেম বের হবে। তাঁরা দ্বীনের সংরক্ষণের সিপাহ্সালার হবেনÑ ইন্শা-আল্লা-হুল আযীয, এ জন্য জরুরী হচ্ছে (এ সবের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য) পরস্পরের ভালবাসা ও একতা থাকা।
((এবং পরস্পরের মধ্যে বিবাদ করোনা। করলে পুনরায় সাহস হারাবে, এবং তোমাদের সঞ্চিত বায়ু বিলুপ্ত হতে থাকবে।)) [সূরা আন্ফাল: আয়াত-৪৬]
অর্থাৎ তোমাদের অনৈক্যের দরুন তোমাদের যে মর্যাদা ও সম্মান আছে তা’ লোপ পাবে। আপনারা ভাগ্যবান, আপনাদেরকে মুবারকবাদ জানাই আর এটার আপনারা উপযুক্তও। তা এ জন্য যে, আপনাদেরকে আল্লাহ্ তা‘আলা সত্য ও সঠিক পথ- প্রদর্শক ও মুরশিদ-ই বরহক দান করেছেন। সঠিক ও বিশুদ্ধ মুরশিদ পাওয়া গেলে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে পাওয়া যায়।
সে সাথে গর্ব ও অহংকার থেকেও বেঁচে থাকবেন। কেননা, শয়তানের শেষ হাতিয়ার হলো গর্ব ও অহংকারবোধ। নিজেকে বিলীন করে দাও। কবি বলেন-যদি কোন মর্যাদা চাও, তবে নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে দাও। কারণ, এ শস্যবীজ মাটিতে বিলীন হবার ফলেই তা থেকে উদ্ভিদ জন্মে সবুজ-সজীব বাগান সৃষ্টি হয়ে যায়।
কথিত আছে যে, যার যতো উচ্চ মর্যাদা হবে তার মাথা যেন ততো অবনত থাকে। সে যেন সেবক হয়।
আর নিজের ভাইদের প্রতি ভালবাসা থাকা ও পরস্পরের মধ্যে একতা থাকাও অত্যন্ত প্রয়োজন।
আজ আমি খুবই আনন্দিত। আমার সকল চিন্তা দূরীভুত হয়ে গেছে। আর এটা তরীক্বতের সকল ভাইদের ভালবাসার ফলশ্রুতি যে, এ বার্ধক্য অবস্থায়ও আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা আপনাদেরকে উভয় জগতের সফলতা দান করুন।
আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের ও আপনাদের মধ্যেকার যে সম্পর্ক রয়েছে, যে আত্মিক সম্পর্কের বন্ধন রয়েছে, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওসীলায় এ সম্পর্ককে ক্বিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী রাখুন! আ-মী-ন।
নূরানী তাক্বরীর-দুই
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَقُوْلُوْا رَاعِنَا وَ قُوْلُوا انْظُرْنَا وَ اسْمَعُوْاؕ-وَ لِلْكٰفِرِیْنَ عَذَابٌ اَلِیْمٌ
[সূরা বাক্বারা : আয়াত ১০৪]
তরজমাঃ হে ঈমানদারগণ, তোমরা ‘রা-‘ইনা-’ বলোনা এবং বলো, ‘ঊন্যুরনা-’ আর শোনো; কাফিরদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। [সূরা বাক্বারা, আয়াত-১০৪, কানযুল ঈমান]
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ করছেন, হে মু’মিনগণ! যখন তোমরা রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে যাও, তখন ‘রা-‘ইনা-’ বলো না। বরং বলো, ‘উন্যুরনা-’ (অর্থাৎ হে আল্লাহর রসূল, সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম! আমাদের প্রতি কৃপাদৃষ্টি দিন।) ‘উন্যুরনা-’ শব্দ ব্যবহার করো; ‘রা-ইনা-’ বলো না এবং রসূল-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তোমাদেরকে কী বলছেন তা মনযোগ সহকারে শ্রবণ করো। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।
এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট এ যে, হুযূর-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে ইহুদীরাও আসতো আর সাহাবা-ই কেরাম রাদ্বিয়াল্লা-হু তা‘আলা আনহুমও। যখন সাহাবা-ই কেরাম রসূল-ই পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কোন এরশাদ বুঝতে পারতেন না, তখন তাঁরা পবিত্র দরবারে আরয করতেন, ‘রা-‘ইনা ইয়া রসূলাল্লাহ্,’ অর্থাৎ আমাদের প্রতি কৃপা দৃষ্টি দেন, আপনি যে কালাম বা বাক্য শরীফটি এরশাদ করেছেন, তা দয়া করে পুনারায় বলুন, যাতে আমরা ভাল করে বুঝে নিতে পারি।” ইতোপূর্বে আমরা বুঝতে পারিনি।
অতএব, পুনরয়ায় বুঝিার সুযোগ দিন। ইত্যবসরে ইহুদীদের একটি সুযোগ হলো রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ধৃষ্ঠতা দেখানোর। কেননা, তাদের ভাষায় ‘রা-ইনা-’ শব্দটি একটি গালি বিশেষ। তাই, আল্লাহ্ তা‘আলা মু’মিনদেরকে ওই ধরনের শব্দ ব্যবহার করতে নিষেধ করে দিয়েছেন, যে শব্দ দ্বারা, যে বাক্য দ্বারা আমার হাবীব-এ পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শানে (সামান্যতমও) বেয়াদবী করার সম্ভাবনা (সুযোগ) থাকে, ওই বাক্যকেই নিশ্চিহ্ন করে দাও। ওই শব্দ বলোই না। ‘রা-ইনা-’ শব্দের স্থলে ‘উনযুরনা-’ বলো। অর্থাৎ হে আল্লাহর রসূল! আমাদের প্রতি দয়াপরবশ হোন, আমাদের প্রতি দয়ার দৃষ্টি দিন। হে আল্লাহর রসূল, আমাদের দিকে কৃপাদৃষ্টি দিন! আপনি যে বাক্য এখন বলেছেন তা পুনরায় বলুন। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।
যেখানে (আয়াতে) বলা হয়েছে, গভীর মনযোগ সহকারে শ্রবণ করো। অর্থাৎ, এমনভাবে শোনো যেন তোমাদেরকে এটা বলতে না হয়,‘ হে আল্লাহ্র রসূল, (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়কা ওয়া সাল্লাম) আবার বলুন, আপনার বাণী মুবারক পুনরায় বলে দিন।’ এমনটি বলার প্রয়োজন না হওয়া চাই। কারণ, এটাও হুযূর-ই আক্রামের শানের এক প্রকার বিরোধী।
হুযূর-ই করীম যদি কিছু এরশাদ ফরমান, তবে যদি প্রথমবার বুঝে না আসে, তবে বলো, ‘উনযুরনা-’ অর্থাৎ- হে আল্লাহ্র রসূল, আমাদের প্রতি কৃপাদৃষ্টি দিন, ওই কথা পুনারায় এরশাদ করুন।
আমার সম্মানিত ভাইয়েরা!
দেখুন, চিন্তা করুন, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করার জন্য আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার অভিপ্রায় কতো বেশী! তাঁর নিকট এটা কতোই পছন্দনীয় ও কাঙিক্ষত !
কেননা, ওই বাক্য, ওই শব্দ, যাতে বেয়াদবীর সম্ভাবনা থাকে, ওই শব্দ ব্যবহার করতে নিষেধ করে দিয়েছেন- এ শব্দ বলোনা, রা-‘ইনা বলে না। রা‘ইনার স্থলে ‘উন্যুরনা’ বলো।
সুতরাং আপনারা ওই সব লোকের অশুভ পরিণতির কথা চিন্তা করে দেখুন, যারা রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র মিম্বরে বসে তাঁর মানহানি করে। ওইসব লোক হতভাগা। আর ওইসব লোকও, যারা বই-পুস্তকে তাঁর মর্যাদার বিরুদ্ধে লিখে, বেয়াদবীপূর্ণ কথাবার্তা লিখে। তাদের ব্যাপারে এরশাদ হচ্ছে- (রসূলে করীমের শানে অশালীনতা প্রদর্শনকারীরা কাফির।) আর কাফিরদের জন্য রয়েছে র্মন্তুদ শাস্তি।
কাজেই, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি আদব প্রদর্শনের যে শিক্ষা আমাদেরকে দেওয়া হচ্ছে, তা হচ্চে এ যে, তোমরা তাঁকে সম্মান করো, তাঁর প্রতি সামান্যতম অশ্রদ্ধা ও বে-আদবী যেন না হয়; কারণ, তা করলে মানুষ কাফির হয়ে যায়। অতএব সেদিকে খুব খেয়াল রাখো।
খুব সম্ভব, ইমাম আবূ ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি একদা বাদশা হারুনুর রশীদের দরবারে উপবিষ্ট ছিলেন। (এমন সময় খাবার উপস্থিত হলো। খাবারের তালিকায় কদু বা লাউও ছিলো।) তখন এক ব্যক্তি বললো, ‘‘হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কদু বেশী পছন্দ করতেন; কিন্তু আমি কদু পছন্দ করি না।’’ তার মুখে এ কথা শুনা মাত্রই ইমাম আবূ ইউসুফ তলোয়ার বের করে নিলেন এবং তাকে কতল করতে উদ্যত হলেন। সে ক্ষমা চাইলো এ বলে যে, তার ভুল হয়ে গেছে। ইমাম আবূ ইয়ূসুফ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বললেন, ‘‘তুমি হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে কী বললে? হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট যা পছন্দনীয় তা কি তোমার নিকট পছন্দনীয় নয়? তুমি মুরতাদ্ হয়ে গেছো। তোমাকে কতল করা ওয়জিব অর্থাৎ অপরিহার্য।’’ লোকটি (তার ভুল বুঝতে পেরে) সাথে সাথে তাওবা করে নিলো।সুতরাং সে প্রাণে বেঁেচ গেলো।
স্মরণ রেখো, এটা অত্যন্ত সূক্ষ্ম জায়গাহ্ ও অত্যন্ত স্পর্শকাতর স্থান, যদি হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মান-মর্যাদায় কারো চিন্তায় এবং ধারণায়ও সামান্যতম পার্থক্য আসে, তাঁর ব্যাপারে অশোভনীয় কিছু যদি প্রকাশ পায়, তবে ইসলাম তার কোন কাজে আসবে না; বরং এরশাদ হয়েছে- ‘কাফিরদের জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে।’
বস্তুত, আদবের কারণে মানুষ এমন উঁচু মর্যাদা লাভ করে, যার কল্পনাও করা যায় না। আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে ও আপনাদের সকলকে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালবাসা দান করুন! আ-মী-ন।
নূরানী তাক্বরীর-তিন
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
كَمَاۤ اَرْسَلْنَا فِیْكُمْ رَسُوْلًا مِّنْكُمْ یَتْلُوْا عَلَیْكُمْ اٰیٰتِنَا وَ یُزَكِّیْكُمْ وَ یُعَلِّمُكُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ وَ یُعَلِّمُكُمْ مَّا لَمْ تَكُوْنُوْا تَعْلَمُوْنَؕۛ فَاذْكُرُوْنِیْۤ اَذْكُرْكُمْ وَ اشْكُرُوْا لِیْ وَ لَا تَكْفُرُوْنِ۠
[সূরা বাক্বারা: আয়াত-১৫১-১৫২]
তরজমাঃ
১৫১।। যেমন আমি (আল্লাহ্) তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে এক মহাসম্মানিত রাসূল প্রেরণ করেছি, যিনি আমার আয়াতসমূহ তোমাদেরকে পড়ে শোনান আর তোমাদেরকে পবিত্র করেন এবং তিনি তোমাদেরকে ক্বোরআন ও হিকমত (বিধানাবলী ও জ্ঞান-বিজ্ঞান) শিক্ষা দেন। আরো শিক্ষা দেন এমনসব বিষয়, যেগুলো তোমরা জানো না।
১৫২।। সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করবো। আর তোমরা আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, আমার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়োনা। [সূরা বাক্বারা: আয়াত-১৫১-১৫২, কানযুল ঈমান]
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেন- যেমন আমি প্রেরণ করেছি তোমাদের মধ্যে তোমাদের মধ্য থেকে একজন মহামর্যাদাবান রসূল, যিনি আমার আয়াতসমূহ তোমাদের নিকট তিলাওয়াত করেন। আর তোমাদেরকে পবিত্র করেন এবং তিনি তোমাদেরকে শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত; তোমাদেরকে আরো শিক্ষা দেন তা, যা তোমরা জানোই না।
হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম ও হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালাম কা’বা শরীফের নির্মাণ কাজ শেষ করার পর প্রার্থনা করলেন- ‘‘হে আমাদের রব! তাদের মধ্যে তাদের মধ্য থেকে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি তাদেরকে তোমার আয়াতসমূহ পড়ে শুনাবেন…।’’
সুতরাং হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম-এর প্রার্থনা, এ দো‘আ আল্লাহ্র দরবারে কবূল হয়ে গেলো।
আর এ আয়াতে (শেষ ভাগে) বলা হচ্ছে- এবং তিনি তোমাদেরকে এমন সব বিষয় শিক্ষা দেন, যা তোমরা (ইতোপূর্বে) জানতেই না।
আরিফ বিল্লাহ্গণ (খোদাপরিচিতিসম্পন্ন বুযুর্গগণ) বলেন, আয়াতে বর্ণিত দ্বিতীয় ‘ওয়া ইয়ু‘আল্লিমুকুম’ দ্বারা আল্লাহ্র ওই নূর, তাজাল্লী, ইল্মে লাদুন্নী (খোদাপ্রদত্ত বিশেষ জ্ঞান), ক্বোরআন পাকের রহস্যাবলী, তত্ত্ব জ্ঞান ও ভেদের কথাগুলোর শিক্ষাদান এবং হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র বক্ষ মোবারক হতে উৎসারিত ওই ফুয়ূয ও বরকাত বুঝানো হয়েছে, যা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তোমাদেরকে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। আয়াতে বর্ণিত প্রথম ‘ইয়ু‘আল্লিমুকুম’ দ্বারা অন্য কিছু বুঝানো উদ্দেশ্য, আর এ ইয়ু‘আল্লিমুকুম দ্বারা ওই কল্যাণ- ধারা বুঝানো উদ্দেশ্য, যা হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্রতম বক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে অর্জিত হয়। আর ফুয়ূযাত, ইল্মে লাদুন্নী, রহস্যাবলী, আস্রার, তত্ত্বসমূহ, যা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামই তোমাদেরকে বলে থাকেন, শিখিয়ে থাকেন।
অতএব, যখন হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় বক্ষ হতে এ বিশেষ জ্ঞান, কামালাত (মর্যাদাবলী), এ আলোরাশি ও তত্ত্বজ্ঞান অর্জিত হয়ে থাকে, তখন তা অর্জন করার জন্য তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার বেশী পারিমাণে যিকর করো, তাঁকে সর্বদা স্মরণ করো। আর যিক্র করার ফলে এ মর্যাদা, এ বিশেষ জ্ঞান, এ রহস্য জ্ঞান, এ ফয়ূযাত, এ বরকাত, এ আলোরাশি তোমাদের অর্জিত হবে। তাছাড়া, এ ফয়ূযাত, আলোরাশি ও তাজাল্লী তোমাদের বক্ষের উপর, তোমাদের হৃদয়ের আয়নার উপর প্রতিফলিত হয়ে যাবে। এ ফয়যান ও জ্ঞানরাশি হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট থেকে অর্জিত হয়। এটা কিতাবাদির সাথে সম্পৃক্ত নয়। এটা খাস দয়া; যার সম্পর্ক হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বক্ষ মুবারকের সাথেই। পবিত্র বক্ষ থেকে এগুলো অর্জিত হয়।
আবার আল্লাহ্র যিক্র ও মুরাক্বাবা ব্যতীত এ নি’মাত অর্জিত হয় না; বরং যিক্র ও মুরাক্বাবা দ্বারা হৃদয়ের ভেতর এ ফয়ূযাত ও ইল্ম সঞ্চারিত হয়। আল্লাহ্র দয়ায়, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট থেকে এ নূর, তাজাল্লী, এ গূঢ় রহস্য, ইল্মে লাদুন্নী হাসেল হয়ে যায়।
তাই, আমাদের উচিতÑ আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার বেশি পরিমাণে যিক্র করা, তাঁকে বেশি করে স্মরণ করা। নিজেকে নিজে অত্যন্ত পাপী বলে মনে করা। আর আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার যিক্রকে দৃঢ়ভাবে আকঁড়ে ধরা চাই, যাতে ওই নি’মাতগুলো আমাদের অর্জিত হয়ে যায়।
পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন, ‘‘তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করবো।’’ বান্দার জন্য এর চেয়ে আর বেশি কী মর্যাদা হতে পারে যে, স্বয়ং আল্লাহ্ তাঁর বান্দাকে স্মরণ করছেন। আর এ সম্মান কি করে অর্জিত হয়? খোদ্ আল্লাহ্ তা‘আলা আপন বান্দাদের স্মরণ করার মতো সম্মান কে অর্জন করতে পারে? যে সব লোক আল্লাহর যিক্র করে, সর্বদা আল্লাহ্র স্মরণে মশগুল থাকে, আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা তাদেরকেই স্মরণ করেন।
এ প্রসঙ্গে একটি হাদীসে ক্বুদসীও শুনুন, আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ করেন, বান্দা আমার প্রতি যে রূপ ধারণা রাখে আমিও তার সাথে ওইরূপ ব্যবহার করে থাকি। যদি বান্দা আমাকে আম মজলিসে স্মরণ করে, আমিও তাকে আম মজলিসে (অর্থাৎ এর চেয়ে উত্তম মজলিসে, ফেরেশতাদের মজলিসে) স্মরণ করি। আর যদি বান্দা আমার প্রতি এক বিঘত পরিমাণ এগিয়ে আসে, আমার রহমত ও দয়া তার প্রতি এক হাত পরিমাণ এগিয়ে যায়। সুবহা-নাল্লাহ্! আল্লাহ্র বদান্যতার কী শান ও মর্যাদা!
আল্লামা খাকানী বলেন-অর্থ: খাকানীর তিন হাজার বছর ঈমানের সাথে রয়ে একটা মাত্র মুহূর্ত আল্লাহর সাথে (আল্লাহর যিক্রে) অতিবাহিত করা হযরত সুলায়মান আলায়হিস্ সালাম-এর বাদশাহী অপেক্ষাও উত্তম।
অর্থাৎ মানুষের একটা মাত্র মুহূর্ত আপন রবের যিক্রে অতিবাহিত হওয়া, হযরত সুলায়মান আলায়হিস্ সালাম-এর বাদশাহী অপেক্ষাও শ্রেয়।
হযরত সুলাইমান আলায়হিস্ সালাম-এর বাদশাহী ছিল একজন নবীর বাদশাহী, যা দুনিয়ার জন্য রহমত ছিলো। এমন রহমতপূর্ণ বাদশাহী থেকেও উত্তম হচ্ছে আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করা, তাঁর স্মরণে সদাসর্বদা নিবিষ্ট থাকা।
‘‘এবং আমার (আল্লাহ)র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, অকৃতজ্ঞ হয়োনা।’’ আল্লাহর শোকর আদায় করো, এ জন্য যে, তোমরা মূল্যবান ঈমান পেয়েছো, ইসলাম পেয়েছো, ক্বোরআন পেয়েছো-এ সবের শোকরিয়া আদায় করো।
আমাদের ক্বাদেরিয়া তরীক্বার দু’জন মাশা-ইখ হযরত সারিউস্ সাক্বত্বী ও হযরত জুনাইদ বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হিমা যখন হজ্বে গেলেন, তখন মক্কা শরীফে ওলামা-ই কেরামের এক মজলিস দেখতে পেলেন। তাঁদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো যে, আল্লাহ্র শোকরিয়া কিভাবে আদায় করা যায়। ওলামা-ই কেরাম নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করলেনÑ “এভাবে এভাবে আল্লাহ্র শোকরিয়া আদায় করা যায়।” (কিন্তু সবাই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারলেন না।) তাই, হযরত সারিউস্ সাক্বতী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হিকে বললেন, “এবার আপনি বলুন, এটার জবাব কি হতে পারে?” তখন তিনি বললেন, “আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার শোকরিয়া আদায় করার অর্থ এ যে, আল্লাহ্ তাঁর বান্দাকে যে সব নি’মাত দান করেছেন, ওই সব নি’মাতের শোকরিয়া আদায় করাই হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার শোকরিয়া।’’ আল্লাহ্রই পবিত্রতা! গভীরভাবে লক্ষ্য করুন। তখন সকল আলিম হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির একথা মেনে নিলেন। আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা আমাদেরকে ও আপনাদেরকে আল্লাহ্র শোকর করার তাওফীক্ব দিন।
আমরা যে ইবাদত-বন্দেগী করে থাকি এতে আল্লাহর কোন উপকার হয় না; বরং আমাদের তাঁর সামর্থ্য লাভ হওয়ার উপর এ বলে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করো, “আল্লাহ্ তোমার নিকট থেকে কাজ নিচ্ছেন। যদি আল্লাহ্ তোমার নিকট থেকে কাজ না নিতেন, তবে সম্মুখে এক কদমও অগ্রসর হওয়া সম্ভবপর হতো না। একটা সাজদাও করতে পারতে না। আর আল্লাহ্ যে তোমার নিকট থেকে কাজ নিচ্ছেন তা তাঁর বিশেষ দয়া ও অনুগ্রহ। এজন্য আল্লাহ্র শোকরিয়া আদায় করো। তিনি এরশাদ ফরমাচ্ছেন, “যদি তোমরা আল্লাহ্র শোকরিয়া আদায় করো, তবে আমি তোমাদেরকে আরো বেশি দান করবো।” আল্লাহ্ আমাদেরকে তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দাদের মধ্যে শামিল করুন। আ-মী-ন।
নূরানী তাক্বরীর-চার
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
وَ اِذْ اَخَذَ اللّٰهُ مِیْثَاقَ النَّبِیّٖنَ لَمَاۤ اٰتَیْتُكُمْ مِّنْ كِتٰبٍ وَّ حِكْمَةٍ ثُمَّ جَآءَكُمْ رَسُوْلٌ مُّصَدِّقٌ لِّمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهٖ وَ لَتَنْصُرُنَّهٗؕ-قَالَ ءَاَقْرَرْتُمْ وَ اَخَذْتُمْ عَلٰى ذٰلِكُمْ اِصْرِیْؕ-قَالُوْۤا اَقْرَرْنَاؕ-قَالَ فَاشْهَدُوْا وَ اَنَا مَعَكُمْ مِّنَ الشّٰهِدِیْنَ
তরজমা: ৮১. এবং স্মরণ করুন! যখন আল্লাহ্ নবীগণের নিকট থেকে (এ মর্মে) তাদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, ‘আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত প্রদান করবো, অতঃপর তাশরীফ আনবেন তোমাদের নিকট রাসূল, যিনি তোমাদের সঙ্গে যা আছে (অর্থাৎ কিতাবগুলো)-এর সত্যায়ন করবেন, তখন তোমরা নিশ্চয় নিশ্চয় তাঁকে সাহায্য করবে।’এরশাদ করলেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করলে এবং এ সম্পর্কে আমার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করলে?’ সবাই আরয করলো, ‘আমরা স্বীকার করলাম।’ এরপর এরশাদ করলেন, ‘তবে (তোমরা) একে অপরের উপর সাক্ষী হয়ে যাও এবং আমি নিজেও তোমাদের সাথে সাক্ষীদের মধ্যে রইলাম। [সূরা আ-লে ইমরান: আয়াত-৮১, কানযুল ঈমান]
আল্লাহ্ তাবারকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ করেন, আর স্মরণ করুন, যখন আল্লাহ্ তাবারাকা তা‘আলা নবীগণ থেকে এ মর্মে সুদৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, ‘যখন আমি তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত দান করবো, অতঃপর যখন তোমাদের কাছে ওই মহান সম্মানিত রসূল আসবেন, (শেষ যামানার নবী তাশরীফ আনবেন) যিনি তোমাদের সঙ্গেকার কিতাবগুলোর সমর্থন করবেন, তখন যেন অবশ্যই অবশ্যই তোমরা তাঁর উপর ঈমান আনো এবং অবশ্যই অবশ্যই তাঁকে সাহায্য করো।’ তিনি (আল্লাহ্ তা‘আলা) বললেন, ‘‘তোমরা কি তা স্বীকার করলে? এবং এর উপর আমার ভারী দায়িত্ব গ্রহণ করলে?’’ তখন তারা (সকল সম্মানিত নবী) আরয করলেন, “আমরা স্বীকার করলাম।” তিনি (আল্লাহ্ তা‘আলা) বললেন, তা’হলে তোমরা একে অপরের উপর সাক্ষী হয়ে যাও। আর আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত রইলাম।
কী আশ্চর্য! আল্লাহরই পবিত্রতা, যখন আয়াতটি একথা প্রকাশ করছে যে, প্রতিশ্রুতি নেওয়া হচ্ছে সম্মানিত নবীগণের নিকট থেকে, কিন্তু তাতে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এমন মহত্ব এবং মর্যাদাও বর্ণনা করা হয়েছে, যার তুলনা নেই। আল্লাহ্ তা‘আলা নবীগণ থেকে এ মর্মে অঙ্গীকার নিচ্ছেন যে, ‘যখন তোমাদের নুবূয়ত ও রেসালতের ডঙ্কা চতুর্দিকে বাজবে, যখন তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত দেয়া হবে, ওই সময় যদি শেষ যমানার নবী তোমাদের নিকট তাশরীফ নিয়ে আসেন, যিনি তোমাদেরকে প্রদত্ত কিতাবগুলোকে, তোমাদের দ্বীনকে সত্যায়নকারী হবেন, তখন তোমাদের করণীয় হবে-তাঁর উপর ঈমান আনা এবং তাঁকে সাহায্য করা। এখানে আশ্চর্যের বিষয় এ যে, আল্লাহ্ তা‘আলা নিজের ‘রাবূবিয়াত’ (পতিপালক হওয়া) সম্পর্কে অঙ্গীকার নেওয়ার সময় বললেন, ‘‘আমি কি তোমাদের পতিপালক নই?’’ সমগ্র সৃষ্টিজগৎ জবাবে বললো, ‘‘হাঁ! আপনি আমাদের প্রতিপালক।’’ ব্যাস্, এখানেই সব কিছু চূড়ান্ত হয়ে গেলো। (অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা এতে কোন সাক্ষী ইত্যাদি বানান নি।) কিন্তু যখন হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে এ মর্মে অঙ্গীকার নেয়া হলো যে, ‘‘তোমরা কি এটা স্বীকার করছো যে, তোমরা তাঁর প্রতি ঈমান আনবে? তাঁকে সাহায্য করবে?’’ তখন সকল নবী বললেন, ‘‘হাঁ! আমরা স্বীকার করলাম যে, এমনটিই করবো।’’ এমনকি আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বললেন, ‘ক্বা-লা ফাশহাদূ-’ অর্থাৎ তা’হলে তোমরা একে অপরের উপর সাক্ষী হয়ে যাও। এভাবে যে, হযরত আদম আলায়হিস সালাম হযরত নূহ আলায়হিস সালাম-এর পক্ষে, হযরত নূহ আলায়হিস সালাম হযরত আদম আলায়হিস সালাম-এর পক্ষে, হযরত মূসা আলায়হিস সালাম হযরত ঈসা আলায়হিস সালাম-এর পক্ষে সাক্ষী হয়ে যাও। এ অঙ্গীকার ও প্রতিশ্র“তির উপর একে অপরের উপর সাক্ষী হয়ে যাও। আর আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম।
বস্তুতঃ এ বিষয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসে মি’রাজ রজনীতে প্রমাণিত হয়েছে। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পেছনে সমস্ত নবী নামায পড়েছেন। তা ছিলো ওই স্বীকারুক্তির বাস্তব প্রতিফলন, যা পূর্বে লওয়া হয়েছিলো। আর ওই অঙ্গীকার পুরণ করার জন্য হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম আবার দুনিয়াতে তাশরীফ আনবেন।
এতে বুঝা গলো যে, হুযূর-করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নবীগণেরও নবী আর নবীগণ হলেন তাঁর উম্মত। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন নবীগণের নবী, আর অন্যান্য যত নবী ছিলেন, সবাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত। এটার উদাহরণ তথা প্রমাণ পবিত্র ক্বোরআনেও রয়েছে। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা এখানে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ‘সিরা-জাম্ মুনী-রা’ অর্থাৎ ‘উজ্জ্বল সূর্য’ বলে অভিহিত করেছেন।
সুতরাং আকাশে যতো তারকা আছে সবই সূর্যের আলো দ্বারা আলোকিত। যখন সূর্যের আলো সেগুলোর উপর পড়ে তখন তা আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠে; কিন্তু যখন সূর্য উদিত হয় তখন সমস্ত তারকা অদৃশ্য হয়ে যায়। অনুরূপ, সমস্ত নবী হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আলোকে আলোকিত। যখন হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তশরীফ আনলেন, তখন সমস্ত নবীর আলো অদৃশ্য হয়ে গেছে, তাঁদের যুগ শেষ হয়ে গেছে। কারণ, প্রত্যেক বস্তু যখন তার মৌলিক অবস্থায় ফিরে যায় তখন তা অদৃশ্য হয়ে যায়। যেমন সকল নদীর উৎপত্তিস্থল হলো সমুদ্র। কারণ সমুদ্রের পানি বাষ্পের আকৃতিতে পাহাড়ের উপর বৃষ্টি হয়ে পতিত হয়। আর তা হতে নদী সৃষ্টি হয়ে তা সমুদ্রের সাথে মিলে যায়। সমুদ্রের প্রতি এসব নদী এমনভাবে ধাবিত হয় যে, যখন এর গতি পথে কোন বস্তু বাধা হয়, তখন তা সেটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কোন শক্তি এর গতিপথ রুখতে পারেনা, না ফির‘আউনী শক্তি, না হামানী শক্তি, না নমরূদী শক্তি। আর যখন এগুলো মোকাবেলায় এসেছিলো, তখন (নুবূয়তী শক্তি) সেগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, রুখতে পারেনি। মোকাবেলা করতে পারেনি। আর যখন নদী গিয়ে সমুদ্রে মিলে যায়, তখন বুঝাও যায় না কোন্টা সমুদ্রের পানি, কোন্টা নদীর পানি। এখানে এসেই নদী ও সমুদ্র একাকার হয়ে যায়। কবির ভাষায়Ñ
‘আমি হলাম তুমি, তুমি হলে আমি। আমি দেহ হলে তুমি হবে প্রাণ। ফলে কেউ একথা বলবেনা যে, আমি এক আর তুমি অন্য কেউ।
অনুরূপ, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন দুনিয়াতে তাশরীফ আনলেন, তখন সকল নবীর নুবূয়তের যুগ শেষ হয়ে যায়। আর হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ তখনও ছিলো, এখনও আছে।
এখনও তাঁর নুবূয়তের যুগ চলছে। এখনও তাঁর রিসালতের যুগ বাকী আছে। তাইতো কলেমা এ ভাবে পড়া হচ্ছেÑ ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু মুহাম্মদুর রসূলুল্লা-হ্।’ (আল্লাহ্ ব্যতীত কোন মা’বূদ নেই, হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা আল্লাহ্র রসূল।) যদি তা না হতো, তবে বলা হতো, ‘কা-না মুহাম্মদুর রসূলাল্লাহ্’। অর্থাৎ ‘হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা তাঁর রসূল ছিলেন।’
এখানেই অনেক বাতিল ফিরক্বার লোকেরা হোঁচট খাচ্ছে। আর বলছে- হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রিসালতের যুগ ওই সময় ছিলো এখন আর নেই; কিন্তু পূর্বেকার সময়ে যেমন তাঁর হুকুম চলছিলো, এখনো তাঁর হুকুম চলছে। এর সাথে সাথে এ দিকে খেয়াল রাখুন যে, ‘ এর পর যে কেউ তাঁর (নবী) দিক থেকে বিমুখ হয়, তবে তারা ফা-সিক্বদের অর্ন্তভুক্ত।*
তাই সব কিছু হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে স্বীকার করার উপর নির্ভরশীল। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ভালবাসা ও অনুসরণের সাথেই উভয় জগতের কল্যাণও সফলতা সম্পৃক্ত। তা উত্তমরূপে আকঁড়ে ধরুন। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে নিজের সম্পর্ক মজবুতভাবে গড়ে তুলুন। এটাই সফলতার চাবিকাঠি। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে ও আপনাদেরকে বুঝার তাওফীক্ব দিন। আ-মী-ন।
নূরানী তাক্বরীর-পাঁচ
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
وَ مَنْ یُّشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْۢ بَعْدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُ الْهُدٰى وَ یَتَّبِـعْ غَیْرَ سَبِیْلِ الْمُؤْمِنِیْنَ نُوَلِّهٖ مَا تَوَلّٰى وَ نُصْلِهٖ جَهَنَّمَؕ-وَ سَآءَتْ مَصِیْرًا۠
তরজমা : এবং যে ব্যক্তি রসূলের বিরোধিতা করে এর পরে যে, সঠিক পথ তার সম্মুখে সুস্পষ্ট হয়েছে এবং মুসলমানদের পথ থেকে আলাদা পথে চলে, আমি তাঁকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দেবো এবং তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবো, আর তা কতোই মন্দ স্থান প্রত্যাবর্তন করার। [সূরা নিসা: আয়াত-১১৫, কানযুল ঈমান]
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ করছেন, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বিরোধিতা করে, যে কেউই রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বরখেলাফ করে, তার সামনে হক্ব প্রকাশ হওয়ার পর, হিদায়তের পথ প্রকাশ পাওয়ার পর, তার সামনে স্পষ্ট হওয়ার পর হিদায়তের রাস্তা, তার সামনে যাহের হবার পর এবং মুসলমানদের পথ ছেড়ে অন্য পথ অনুসরণ করে, ওই পথ দিয়ে চলে, যা মুসলমানদের পথ নয়, (আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,) তাহলে আমি তাকে তার ওই অবস্থার উপর ছেড়ে দিই, যে দিকে সে ফিরে গেছে; এবং তাকে আমি জাহান্নামে প্রবেশ করাবো, আর এ জাহান্নাম অতিমাত্রায় নিকৃষ্ট ঠিকানা, অত্যন্ত মন্দ জায়গা প্রত্যাবর্তনের।
মদীনা মুনাওয়ারায় এক ব্যক্তি চুরি করেছিলো; কিন্তু সে এ চুরির অপবাদ অন্যজনের উপর দিলো। যখন এটা তদন্ত করা হলো, তখন হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তার হাত কেটে ফেলার আদেশ দিলেন। এতে ওই লোকটি পালিয়ে মক্কায় চলে গেলো। সে সেখানে গিয়ে কাফির হয়ে গেলো। এ প্রসঙ্গে এ আয়াত শরীফ অবতীর্ণ হলো।
ওখানে আরেক ব্যক্তি, ইসলামের প্রাথমিক যুগে কাতেবে ওহী (ওহী লিখক) ছিলো। পরে ইসলাম ত্যাগ করে সে কাফিরদের সাথে যোগ দিলো। যখন সে মারা গেলো এবং কবর খনন করে তাকে তাতে দাফন করা হলো, দাফন করার পর যমীন তাকে বাইরে নিক্ষেপ করলো। মাটি তাকে গ্রহণ করলো না।
বুঝা গেলো যে, যে ব্যক্তি হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বিরোধিতা করে, তাকে কোন কিছুই গ্রহণ করে না তাকে না মাটি গ্রহণ করে, না আল্লাহ্র সৃষ্টির অন্য কোন কিছু তাকে গ্রহণ করে। আরো জানা গেলো যে, যে ব্যক্তি এ দরবারের মাহবূব, সে আল্লাহ্রও মাহবূব হয়ে যায়, যে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফার দরবারের প্রিয় হয়ে যায়, সে আল্লাহ্ তা‘আলার প্রিয় হয়ে যায়। সে যুগের মাহ্বূব হয়ে যায়, সে সমস্ত সৃষ্টির মাহবূব হয়ে যায়। আর যে রসূলের দরবার হতে বিতাড়িত হয়ে যায়, তার কোথাও স্থান নেই। সৃষ্টির সবকিছুর নিকট সে প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়।
সুতরাং বুঝা গেলো যে, যেসব লোক মুসলমানদের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে নিজেদের মনগড়া পথ ও মত গ্রহণ করে, যেমন- বাতিল পন্থীরা আলাদা রাস্তা গ্রহণ করেছে, সম্মানিত সাহাবী, তাবে‘ঈন, ইমামগণ ও মুজতাহিদদের পথ ছেড়ে দিয়েছে, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নী মুসলমানদের পথ ও মত ছেড়ে দিয়ে আলাদা পথ ও মতের সৃষ্টি করেছে, তারা ধ্বংসে পতিত হয়েছে। ছাগলের পাল হতে বিছিন্ন হয়ে একাকী হওয়া ছাগলকে যেমন বাঘে খেয়ে ফেলে, তেমনি যে সব লোক আসল পথ ও মত ছেড়ে, তথা মুসলমানদের পথ ছেড়ে নিজেদের জন্য নতুন পথ ও মত অবলম্বন করে, তারা বরবাদ হয়ে যায়, তাদেরকে বাঘের মতো শয়তান ধ্বংস করে ছাড়ে।
তাই, আমাদের উচিত হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ ও অনুকরণ করা, তাঁর ভালবাসা এবং তাঁর বাণীগুলোকে মেনে নিয়ে তদনুযায়ী আমল করাকে সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা। বস্তুত আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা‘আত থেকে পৃথক থাকা এবং সেটার মোকাবেলায় নতুন ফির্কা বা দল গঠন করা আল্লাহ্র কাছে অপছন্দনীয়। (আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন,) এমন সব লোককে তিনি জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। আর জাহান্নাম অতি নিকৃষ্ট স্থান।
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা আমাদেরকে এবং আপনাদের সবাইকে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করার তাওফীক্ব দিন। আ-মী-ন। আর এতেই আমাদের জন্য উভয় জগতের সফলতা নিহিত। হে আল্লাহ্, রহমত, বরকত ও শান্তি বর্ষণ করুন আমাদের আক্বা হযরত মুহাম্মদ মোস্তফার উপর, তাঁর পবিত্র বংশধর ও সাহাবীগণÑ সবার উপর। হে আল্লাহ্ আমাদের এ প্রার্থনা ক্ববূল করুন।
নূরানী তাক্বরীর-ছয়
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ قَدْ جَآءَكُمْ بُرْهَانٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَ اَنْزَلْنَاۤ اِلَیْكُمْ نُوْرًا مُّبِیْنًا فَاَمَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا بِاللّٰهِ وَ اعْتَصَمُوْا بِهٖ فَسَیُدْخِلُهُمْ فِیْ رَحْمَةٍ مِّنْهُ وَ فَضْلٍۙ-وَّ یَهْدِیْهِمْ اِلَیْهِ صِرَاطًا مُّسْتَقِیْمًا
তরজমা:
১৭৫. ‘‘হে মানবজাতি! নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট আল্লাহ্র পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ এসেছে এবং আমি তোমাদের প্রতি সমুজ্জ্বল নূর নাযিল করেছি।
১৭৬. সুতরাং ওইসব লোক, যারা আল্লাহ্র উপর ঈমান এনেছে এবং তাঁর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরেছে, অবিলম্বে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে আপন রহমত ও অনুগ্রহে প্রবেশ করাবেন এবং তাদেরকে নিজের প্রতি সোজা-সরল পথ দেখাবেন।’’ [সূরা নিসা: আয়াত-১৭৪-১৭৫, কানযুল ঈমান]
এ বরকতময়ী আয়াতে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। এতে সমস্ত মানুষকে সম্বোধন করে এরশাদ হয়েছে- ‘নিশ্চয় তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের তরফ থেকে ‘দলীল’ এসেছে, ‘অকাট্য প্রমাণ’ এসেছে। ‘বোরহান’ বলা হয় ‘অকাট্য’ প্রমাণ’কে। আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ‘বোরহান’ বলেছেন। বলেছেন, এটা আমার ‘বোরহান’ বা অকাট্য দলীল।
(আরো এরশাদ করেছেন) ‘এবং আমি তোমাদের প্রতি সমুজ্জ্বল জ্যোতি, প্রকাশ্য ‘নূর’ অবতীর্ণ করেছি। এখানে ‘নূরাম্ মুবীনা-ন’ দ্বারা কোন কোন তাফসীরকারক ‘পবিত্র ক্বোরআন’-এর অর্থও গ্রহণ করেছেন। কেননা, অন্য আয়াতে এর ব্যাখ্যা এসেছে- ‘নিশ্চয় তোমাদের নিকট নূর ও সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে।’
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেন, আমি তোমাদের নিকট ‘বোরহান’ (অকাট্য প্রমাণ) প্রেরণ করেছি। মুকাদ্দামায় কেউ কিছু দাবী করলে তার পক্ষে দলীলও থাকে। দলীল পেশ করলে তার মুকাদ্দামা মজবুত হয়। সে দলীলাদি পেশ করে। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামও আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার তরফ থেকে এক মজবুত দলীল। যারা দলীল খণ্ডন করতে চায়, তারা মুকাদ্দামাকে দুর্বল করে দিতে চায়। একমাত্র এতদুদ্দেশ্যেই তারা দলীল খণ্ডন করতে চায়।
সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহ্ তা‘আলার দলীল, তাঁর একত্বের প্রমাণ, তিনি সৃষ্টিকর্তা হবার প্রমাণ। আর হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন ওই দলীল, যার সম্পর্কে কারো সমালোচনা করার কোন প্রকার অবকাশ থাকতে পারে না। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার ওই মজবুত দলীল, যার সম্মুখে সমস্ত মাখলূক্ব নিরুত্তর (লা-জওয়াব)। তিনি তোমাদের প্রতিপালকের তরফ থেকে তোমাদের মহান রবের পক্ষ থেকে দলীল (অকাট্য প্রমাণ)। কেননা, আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা সৃষ্টিকুলের সৃষ্টিকর্তা।
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা প্রতিপালন করেন প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সমস্ত সৃষ্টির। যেভাবে আল্লাহ্ তা‘আলা দেহ বা জড় জগতের প্রতিপালনের জন্য, জড় জগতের লালনের নিমিত্তে সূর্যকে সৃষ্টি করেন, যার মাধ্যমে সমস্ত জগতের নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তদ্রƒপ রূহ-জগতে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা রিসালতের সূর্য হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে উদ্ভাসিত করেছেন, যাঁর মাধ্যমে রূহ জগতের আইন-কানূন প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় যাতের মাধ্যমে রূহ জগতের নিয়ম-শৃংখলা কায়েম রয়েছে। যেমন সূর্য প্রকাশ্য (জড়) জগতের জন্য, যাহেরী এন্তেযাম কায়েম করার জন্য প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, তেমনিভাবে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় যাত রূহ জগতের নিয়ম-কানূন কায়েম থাকার জন্য প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এ কারণে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা তাঁকে (হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে) ‘বোরহান’ আখ্যা দিয়েছেন; অকাট্য দলীল বলেছেন।
যারা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করার ধৃষ্টতা দেখায় তারা আসলে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে আপত্তি করেনা বরং আল্লাহ্ তা‘আলার অকাট্য দলীলকে দুর্বল করার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। এরা বস্তুতঃ আহম্মক, নির্বোধ। আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা আমাদেরকে, আপনাদেরকে সবাইকে বুঝার শক্তি দিন। আ-মী-ন।
‘‘অতঃপর যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর উপর এবং সেটাকে মজবুতভাবে ধারণ করেছে।’’ এ আয়াতে ‘বিহী’- অর্থাৎ ‘সেটাকে’ সর্বনাম দ্বারা ‘বোরহান’ বিশেষ্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এটা দ্বারা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় যাতই বুঝানো হয়েছে, (সুতরাং আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়) যে সব লোক আল্লাহ্ তা‘আলার উপর ঈমান এনেছে এবং হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দামনকে আঁকড়ে ধরেছে, সে সব লোককে অবিলম্বে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা আপন রহমতে প্রবেশ করাবেন এবং আপন অনুগ্রহে প্রবেশ করাবেন আর তাদেরকে দেখাবেন আপন সোজা রাস্তা।
লক্ষ্য করুন, উল্লিখিত আয়াতে এ কয়েকটা বিষয় এরশাদ হয়েছে ঃ ১. যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে, ২. যারা তাঁর (হুযূর করীম) দামনকে মজবুতভাবে ধারণ করেছে, ৩. অতঃপর তাদেরকে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা অবিলম্বে স্বীয় রহমতে দাখিল করবেন এবং আপন অনুগ্রহে প্রবেশ করাবেন। আর তাদেরকে রাস্তা দেখাবেন, আপন রাস্তা।
সুতরাং একথা সুস্পষ্ট হলো যে, এ আয়াত শরীফে গভীরভাবে চিন্তা করলে এ কথার ফয়সালা হয়ে যাবে যে, কামিয়াবী ওই সব লোকের জন্য, যারা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দামনকে আঁকড়ে ধরেছে। ওই সব লোকের জন্যই আল্লাহর দয়া রয়েছে, আল্লাহর রহমত রয়েছে, সোজা পথের দিশা রয়েছে এবং তাদের উপর আল্লাহর রহমতও বর্ষিত হয়।
পক্ষান্তরে, যে সব লোকের হাত থেকে এ দামন ছুটে গেছে, তারা মাহরূম হয়েছে, বঞ্চিত হয়েছে। তাদের জন্য কিছুই নেই- না তাদের দ্বীন আছে, না আছে তাদের জন্য দুনিয়া, না আছে ইবাদতের গ্রহণযোগ্যতা। কিছুই নেই।
সমস্ত বাতিল ফির্ক্বা এর মধ্যে রয়েছে, তাদের অব্যাহত প্রচেষ্টা এতেই রয়েছে যে, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দামন হাত থেকে ছুটে যাক! কাজেই, আপনারাও সজাগ হয়ে যান এবং ওই দামনকে মজবুতভাবে ধারণ করুন। স্মরণ রাখবেন, এ দামনেই আপনাদের এ সিলসিলা রয়েছে। এর সম্পর্ক হচ্ছে এ দামনেরই সাথে। যা কিছু আসছে ওই দামন থেকেই আসছে। যা কিছু মেহেরবানী আসছে, ওই দামন থেকেই আসছে। আপনারা সতর্ক হয়ে যান। অনর্থক কথাবার্তা শুনবেন না। অনর্থক কোন কাজ করবেন না। অনৈক্যের কোন কথা বলবেন না। যাতে আপনারা রহমত থেকে দূরে সিট্কে পড়েন, এ সিল্সিলাকে মজবুতভাবে ধরুন। সিলসিলার মধ্যে মজবুত হয়ে যান।
লক্ষ্য করুন! চিন্তা করুন জেনে নিন! যাতে আপনাদের সিলসিলাহ্ মজবুত হয়ে যায়, যাতে আপনারা আল্লাহর বন্ধু হয়ে যান, আপনাদের উপর আল্লাহ তা‘আলার রহমত বর্ষিত হয়। আর এ সিলসিলায় যা কিছু আছে এসব কিছু আল্লাহ্ তা‘আলার তরফ থেকেই, এসবই আল্লাহ ও হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রহমতসমূহ এবং আল্লাহ্ ও হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতসমূহ শামেলে হাল রয়েছে। সুতরাং এ দামন যেন হাত থেকে ছুটে না যায়।
এ আয়াতে মুবারাকার প্রতি সব সময় খেয়াল রাখবেন- ‘‘অতঃপর যে সব লোক আল্লাহ্র উপর ঈমান নিয়ে এসেছে এবং রসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দামনকে মজবুতভাবে ধরেছে, তাদের জন্য কী প্রতিদান রয়েছে? তাদের প্রতিদান হচ্ছে- আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে অবিলম্বে আপন রহমত ও অনুগ্রহে প্রবেশ করাবেন এবং তাদেরকে আপন রাস্তা, সোজা রাস্তা দেখাবেন, যাতে তারা এ পথ ধবে আপন মনযিলে মকসূদে পৌঁছে যায়।
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা শক্তি দান করুন। আ-মী-ন।
নূরানী তাক্বরীর-সাত
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
اَلْیَوْمَ یَىٕسَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا مِنْ دِیْنِكُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَ اخْشَوْنِؕ- اَلْیَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِیْنَكُمْ وَ اَتْمَمْتُ عَلَیْكُمْ نِعْمَتِیْ وَ رَضِیْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًا
তরজমা: আজ কাফিররা তোমাদের দ্বীন থেকে নিরাশ হয়ে গেছে। সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় করো না এবং আমাকে ভয় করো। আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি এবং তোমাদের উপর আমার নি’মাতকে পূর্ণাঙ্গ করেছি। আর আমি তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামকে পছন্দ করেছি।’’ [সূরা মা-ইদাহ্: আয়াত-৩, কানযুল ঈমান]
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেনÑ আজ নিরাশ হয়ে গেছে ওইসব লোক, যারা কাফির হয়ে গেছে, তারা নিরাশ হয়ে গেছে তোমাদের দ্বীন থেকে। সুতরাং তাদেরকে ভয় করো না, আমাকে ভয় করো। আজ আমি পরিপূর্ণ করে দিয়েছি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে এবং পরিপূর্ণ করেছি তোমাদের উপর আমার নি’মাতকেও; আর আমি তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামের উপর রাযী হয়েছি।
এ আয়াত-ই মুবারাকার শানে নুযূল হচ্ছে- ৯ যিলহজ্ব জুমু‘আর দিন এবং ১০ম হিজরী, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খোত্বাহ্ প্রদান করছিলেন। তিনি উট্নীর উপর উপবিষ্ট ছিলেন। এমতাবস্থায় এ বরকতময়ী আয়াতের ওহী এসেছে। যখন এ বরকতমন্ডিত আয়াতের ওহী আসলো, তখন উট্নী বরদাশত করতে পারে নি। এ বরকতময় মুহূর্তে, এ অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, এতে এরশাদ হচ্ছে, আজকের এ দিন যা ছিল, সে সম্পর্কে তাফসীকারকগণ বলেন, সেটা জুমার দিন ছিলো এবং যিলহজ্ব মাসের ৯ম তারিখ ছিলো।
এ দিনে মুসলমানদের দু’ঈদ একত্রিত ছিলো, আর খ্রিস্টানদেরও ঈদের দিন ছিল, ইহুদীদেরও ঈদের দিন ছিল। পাদ্রীদেরও ঈদের দিন ছিল। অর্থাৎ (সর্বমোট) পাঁচটা ঈদই এর মধ্যে একত্রিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তাফসীরকারকগণের অভিমত এও রয়েছে যে, এতে ছয়টা ঈদের সমাবেশ ঘটেছে। সেগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ ঈদই অগ্রাধিকার রাখে। সেটা হচ্ছে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দিদার বা সাক্ষাৎ। প্রকৃত ঈদ তো এটা ছিলো যে, গোলামগণ তাদের মুনিবের সাথে সাক্ষাৎ অর্জন করেছে। সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সাক্ষাৎ করা। (আল্লাহরই পবিত্রতা)।
এ আয়াতে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ করেছেন যে, আজ কাফিরগণ তোমাদের দ্বীন থেকে নিরাশ হয়ে গেছে, অর্থাৎ কাফিরদের ধারণা ছিলো যে, এ দ্বীন- ইসলামের চর্চা ক্ষণস্থায়ী, কিছুদিন পর সেটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কাফিরগণ অনেক চেষ্টা করেছে, মুসলমানদেরকে অনেক নির্যাতন করেছে, বহু কষ্ট দিয়েছে, অনেক লোভ দেখিয়েছে, কিন্তু সাহাবা কেরামের অটলতার এমন অবস্থা ছিলো যে, কোন বস্তুর, কোন ষড়যন্ত্রের, কোন লোভের, কোন নির্যাতনের ও কোন কষ্টের প্রভাব তাঁদের উপর পড়েনি। তাঁরা পাহাড়ের ন্যায়ই অটল রইলেন।
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ করছেন, আজ কাফিরগণ নিরাশ হয়ে গেছে। কাফিরগণ দেখলো মক্কা বিজয় হয়ে গেছে, মক্কা মুসলমানদের করায়ত্ব হয়েছে। আর ঐতিহাসিক অতিগুরুত্বপূর্ণ খোত্বা দেওয়া হচ্ছে। মানুষ দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে। আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেন, আজ কাফিরগণ নিরাশ হয়েছে- তোমাদের দ্বীন থেকে। তারা নিজেদের চালবাজি থেকে নিরাশ হয়ে গেছে- ‘আমাদের তো আর কোন চালবাজি কাজে আসবে না, আমাদের কোন লোভ দেখানোর ষড়যন্ত্র চলতে পারে না। কোন শক্তি চলতে পারে না তাদের বিরুদ্ধে। আর এ দ্বীন-ইসলাম স্থায়ীভাবে থাকবে।’ আজ কাফিরদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো এবং তারা নিরাশ হয়ে গেলো। আজ কাফিরগণ হতাশ হয়ে পড়লো।
খোদ্ আল্লাহ্ তা‘আলা ঘোষণা দিচ্ছেন-‘‘আজ কাফিরগণ তোমাদের দ্বীন থেকে হতাশ হয়ে গেছে। তাদের ব্যাপারে এ আশঙ্কা করো না যে, তারা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে। আমাকে ভয় করো, আমারই খেয়াল রেখো, তাদেরকে ভয় করো না। এরা তোমাদের কোন কিছুই করতে পারবে না।
‘‘আজ পরিপূর্ণ করে দিয়েছি আমি তোমাদের দ্বীনকে।’’ আজ পূর্ণ হয়েছে তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন। এতে কোন প্রকার পরিবর্তন-পরিবর্দ্ধন করা যেতে পারে না। এ দ্বীন ক্বিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী হবে। আজ আমি সেটাকে খুব পরিপূর্ণ করে দিয়েছি। (সুব্হা-নাল্লাহ্)
যখন দ্বীন পরিপূর্ণ হয়েছে তখন বাতেল ফের্কাগুলো সে দ্বীন থেকে কী অপূর্ণতা বের করতে পারে? এতে তাদের উদ্দেশ্যই বা কি তা বুঝে আসে না, এটাই ভাবি। কারণ, আমাদের দ্বীন তো পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। (আল্লাহ্ এরশাদ করেন,) ‘‘আজ পরিপূর্ণ করে দিয়েছি।’অর্থাৎ তোমাদের দ্বীনকে। আজ আমার নি’মাতকে তোমাদের উপর পরিপূর্ণ করে দিয়েছি, পূর্ণ মাত্রায় পূর্ণাঙ্গ করেছি। সুব্হা-নাল্লাহ্।
এতে সমূহ মুবারকবাদী রয়েছে যে, (আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন) ‘এবং আমি পরিপূর্ণ করে দিয়েছি তোমাদের উপর আমার নি’মাতকে এবং রাযী হয়েছি ইসলামের উপর দ্বীন হিসেবে।’ ‘আমি ইসলামের উপর দ্বীন হিসেবে রাযী হয়ে গেছি।’ আর কাফিরদের নিরাশ হয়ে যাওয়া মুসলমানদের ক্ষেত্রে এ মর্মে যে, তাদের এ ষড়যন্ত্র কাজে আসতে পারবে না। এতে বড় সৌভাগ্য রয়েছে এবং এতে মুসলমানগণ বড় ডিক্রী পেয়ে গেছে এবং তাঁদের অটলতার প্রশংসা করা হচ্ছে এ মর্মে যে, আজ তোমাদের অটলতার সামনে কাফিরগণ হাতিয়ার ফেলে দিয়েছে, আশা ছেড়ে দিয়েছে, তারা আজ নিরাশ হয়ে গেছে। আমাদের দ্বীন সম্পর্কে তারা নিরাশ হয়ে গেছে। সুতরাং এটা বড় সৌভাগ্য হলো ওই জনগোষ্ঠীর জন্য, যাদের সম্পর্কে কাফিরদের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, এঁরা (মুসলমানরা) কখনো পরাজিত হবেন না। এঁরা সর্বদা আমাদের উপর জয়ী থাকবেন এবং তাদের উপর আমাদের কোন ক্ষমতা চলতে পারে না। উল্লেখ্য যে, কোন বিশেষ জনগোষ্ঠী হোক কিংবা একাকী হোক যার কিংবা যাদের সম্পর্কে শত্রুদের মনে এ ধারণা জন্মে যে, ‘তাদের বিরুদ্ধে আমাদের কোন ক্ষমতা চলতে পারে না’ আর তারা নিরাশ হয়ে যায়, তাহলে ওই জনগোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তি খোশ নসীবই হয়?
আর কোন কোন হযরত তো এমনও আছেন, যাঁদের সামনে শয়তানও হাতিয়ার ফেলে দেয়। যেমন হযরত ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। তাঁর সামনে শয়তানের কোন ক্ষমতা চলতো না। শয়তান তাঁর সামনে অপরাগ ছিলো। এমনও বহু লোক রয়েছেন। আল্লাহ্ তা‘আলার এমন সৃষ্টিকে শয়তান ভয় করে। তাঁরা বড় সৌভাগ্যবান মানুষ হয়ে থাকেন, যাদের থেকে শয়তান নিরাশ হয়ে যায়- চাই তাঁরা গোটা একটা গোত্র হোন কিংবা ব্যক্তি বিশেষ হোন।
এ আয়াত থেকে আরো একটা কথা জানা গেলো যে, (আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন,) ‘‘আমি তোমাদের জন্য ইসলামের উপর দ্বীন রূপে রাজি হয়েছি।’’ আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেন, “আমি দ্বীন-ইসলামের উপর রাজী হয়ে গিয়েছি।” এখানে ‘তাওহীদ’-এর কথা উল্লেখ করা হয়নি যে, আমি তাওহীদীদের উপর রাজি হয়ে গেছি; বরং বলেছেন, আমি ইসলামের উপর রাজী হয়েছি। ক্বোরআন মজীদ মুসলমানদেরকে যখনই স্মরণ করেছে, তখন ‘হে ঈমানদারগণ’ বলে স্মরণ করেছে। এখানে ‘হে তাওহীদীগণ’ বলেনি। এখানে, ক্বোরআন মজীদে তাওহীদের শব্দ আসেনি। কারণ, ওই তাওহীদই প্রকৃত তাওহীদ, যা নবী আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর মাধ্যমে তাওহীদ হয়। পক্ষান্তরে, নবী আলায়হিস্ সালাম ছাড়া যেই তাওহীদ হয়, তা দোযখেরই চাবি। ওই তাওহীদই গ্রহণযোগ্য, যা নবী আলায়হিস্ সালাম-এর মাধ্যমে অর্জিত হয়। এ জন্য এরশাদ হয়েছে- হে হাবীব আপনি বলুন, “আল্লাহ এক।” যে তাওহীদ ও রেসালতের মাধ্যমেই হয়, সেটাই হচ্ছে তাওহীদ। আর রেসালত ব্যতিরেকে, নুবূয়ত ব্যতিরেকে যে তাওহীদ হয়, সেটা তাওহীদই নয়। শয়তান অপেক্ষা বড় তাওহীদী কে হতে পারে? সেতো বড় তাওহীদী; কিন্তু তার তাওহীদ গ্রহণযোগ্য নয়।
এযে শিখ সম্প্রদায়, তারাও তাওহীদী। এ যে হিন্দু (আর্য্য) সম্প্রদায়, তারাও তাওহীদী। কিন্তু তাদের তাওহীদ গ্রহণযোগ্য নয়। খৃস্টান, ইহুদী সবাই তাওহীদী। (কিন্তু তাদের ওই তাওহীদ গ্রহণযোগ্য নয়।) ওই তাওহীদই গ্রহণযোগ্য, যা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দামনের সাথে মিলে তাওহীদ হয়। একমাত্র সেটাই গ্রহণযোগ্য।
যখন এ বরকতময়ী আয়াত নাযিল হলো তখন হযরত ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কাঁদছিলেন। আল্লাহ্র হাবীব জিজ্ঞাসা করলেনÑ কেন কাঁদছো? হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আরয করলেন, ‘‘হে আল্লাহ্র রাসূল! আমাদের অগ্রযাত্রা এতদিন উন্নতির দিকে ছিল। এখনতো আমাদের উন্নতির শেষ প্রান্ত এসে গেল। যে কোন কিছুর যখন শেষ বা চূড়ান্ত পর্যায় এসে যায়, তখন থেকে সেটা আবার শুরুর দিকে ধাবিত হয়। তখন হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘হাঁ, তুমি ঠিক বলেছো।’’ হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুও তখন কাঁদছিলেন। তাঁকে কেউ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, ‘‘আমাদের
দ্বীন যখন পরিপূর্ণ হয়ে গেলো, তখন হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তো আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে যাবেন। যখন আমাদের দ্বীন পূর্ণ হয়ে গিয়েছে, তখন তো আমাদের কাজ সমাধা হয়ে গিয়েছে, এখন তো হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের চোখের অন্তরালে চলে যাবেন।
সর্বোপরি, ‘‘আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি এবং তোমাদের উপর আমার নি’মাতকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি, আর তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ‘ইসলাম’-এর উপর সন্তুষ্ট হয়েছি। এটা বড় খোশ নসীবী এবং বড় সৌভাগ্যের প্রতীক এ মর্মে যে, আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ করেছেন, “আমি দ্বীন-ইসলামকে পছন্দ করেছি। আমি আপন নি’মাতসমূহ পরিপূর্ণ করেছি। আমি রাজী হয়েছি দ্বীন ইসলামের উপর।’ এর চাইতে বড় খুশী আর কী হতে পারে?
এ বরকতময়ী আয়াতের পর আহকাম বা শরীয়তের বিধানাবলীর কোন আয়াত আসেনি। এটাই আহকামের সর্বশেষ আয়াত।
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা আপনাদেরকে, আমাদেরকে এটা দ্বারা বরকাত দান করুন। ক্ববূল করুন, হে আল্লাহ্!
নূরানী তাক্বরীর-আট
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
قَدْ جَآءَكُمْ مِّنَ اللّٰهِ نُوْرٌ وَّ كِتٰبٌ مُّبِیْنٌۙ
তরজমাঃ
নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে এক ‘নূর’ (জ্যোতি) এসেছে এবং সুস্পষ্ট কিতাব।
[সূরা মা-ইদাহ্ ঃ আয়াত-১৫ঃ কানযুল ঈমান]
বিশ্বনবী হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশংসা করে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেন, এ ‘নূর’ আল্লাহ্র তরফ থেকে এসেছে; অর্থাৎ দুনিয়ায় এসে নূর হননি, বরং ‘নূর’ হয়েই তোমাদের নিকট এসেছেন।
পৃথিবীতে মানুষ এসেই এখানে আলেম হয়, ফাযেল হয়, হাফেয হয়, সমূহ পূর্ণতা অর্জন করে। সবই পৃথিবীতে আসার পরই; কিন্তু হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমন সম্পর্কে এরশাদ হচ্ছে- তোমাদের নিকট নূর এসেছে। তিনি আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার তরফ থেকে ‘নূর’ হয়েই তোমাদের নিকট এসেছেন; এখানে এসে হননি।
যে নূর আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার তরফ থেকে হয়, ওই নূরকে কেউ নেভাতে পারে না, ওই নূরের সাথে কেউ মোকাবেলা করে টিকে থাকতে পারে না। পৃথিবীতে আমরা যে বাতি জ্বালাই, সেটাকে আমরা নিভাতে পারি। কেননা, সেটা আমাদের হাতেরই গড়া; কিন্তু আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার তরফ থেকে যে নূর আসে তাঁকে কে নেভাতে পারে?
তাঁর মান-মর্যাদা কে হানি করতে পারে? আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ ফরমান- তোমাদের নিকট এসেছে ‘নূর’। ‘নূর’ তোমাদের নিকট এসেছে আল্লাহ্ তা‘আলার তরফ থেকে।
এ কারণে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমন কোন শাহী বংশে হয়নি, যাতে (কারো মনে) এ সন্দেহ না জাগে যে, তাঁর এ যে সব মহামর্যাদা অর্জিত হয়েছে, সেগুলো শাহী বংশের কারণে অর্জিত হয়েছে। কোন এমন বংশেও তিনি তাশরীফ আনেননি, যারা ধনশালী, যাতে কেউ এ সন্দেহ করতে না পারে যে, ধনৈশ্বর্যের মাধ্যমেই তাঁর এসব পূর্ণতা (কামালাত) হাসিল হয়েছে। এ জ্যোতি, এ খ্যাতি তাঁর এ ধনৈশ্বর্যের কারণেই অর্জিত হয়েছে। অনুরূপ, তিনি এমতাবস্থায় দুনিয়াতে তাশরীফ এনেছিলেন, যখন তাঁর পিতা ইহধামে ছিলেন না। এর পরপর তাঁর মাতা ও পিতামহ- উভয়ের ছায়াও তাঁরা উপর থেকে উঠে গিয়েছিলো। শুধু তা নয়, তাঁর নুবূয়ত প্রকাশের সময়, তাঁর বংশীয় (নিকটাত্মীয়) লোকদের প্রায় সবাই পরপারে পাড়ি জমান। বেঁচে ছিলো আবূ লাহাব প্রমুখ। তারাতো তাঁর প্রাণেরই শত্র“ ছিলো। সুতরাং হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নূরকে যে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলাই চমকিয়েছেন- তাতে সন্দেহ নেই।
‘নূর’ তাকেই বলে, যা নিজেও আলোকিত, অপরকেও আলোকিত করে। যেমন, সূর্য নিজেও প্রজ্জ্বলিত এবং অন্যকেও তা আলোকিত করে; কিন্তু সূর্যের আলো কখনো হ্রাস পায়, কখনো খুবই তেজোদ্দীপ্ত হয়, কখনো আবার ফ্যাকাশে হয়ে যায়; কিন্তু হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় সত্তা এমন ‘নুর’ যে, সেটার কখনো পতন নেই। সেটা সর্বদা আলোকিত, সব সময় চমকায়। (এমনকি) যারা সেটার নিটকস্থ হয়েছে, সেটার সাথে যাদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে, তারাও আলোকময় হয়ে গেছে। তাঁরা অপরকেও আলোকিত করতে পারেন।
সূর্য বাহ্যিক জগতকে আলোকিত করে; কিন্তু হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এমন ‘নূর’, যা অন্তরকেও আলোকিত করে দেয়। অন্তর এবং মস্তিস্ককেও তিনি চমকিয়ে দিয়ে থাকেন, পবিত্র করেন, যাহের ও বাতেনকে আলোকিত করেন।
আর সূর্য তো রাতে উদিত হয় না। উদিত হয় শুধু দিনের বেলায়। কিন্তু হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামরূপী সূর্য আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার তরফ থেকে এমন জ্যোতির্ময় যে,
তা সর্বদা সবসময় আলোকিত, সবসময় আলো দান করে। যে-ই তাঁর সান্নিধ্যে আসে, যার উপর তাঁর আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়, সেটাকেও আলোময়, আলোকোজ্জ্বল করে দেন। তা এ জন্যই যে, আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার তরফ থেকে ‘নূর’ হয়েই তিনি তোমাদের নিকট এসেছেন।
(অতঃপর আল্লাহ্ এরশাদ করেন,) ‘‘এবং কিতাবে মুবীন বা সুস্পষ্ট কিতাব তোমাদের নিকট এসেছে। ‘কিতাবে মুবীন’ বা সুস্পষ্ট কিতাব দ্বারা এখানে ক্বোরআন পাকই বুঝানো উদ্দেশ্য। এখানে ‘নূর’ এবং ‘কিতাব’ একসাথে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এযে, কিতাব যখনই পাঠ করা হোক না কেন, তাতো পড়া যায় আলোর মধ্যে; অন্ধকারে পড়া যায় না। আলো থাকলেই তো কিতাব পাঠ করা যাবে। এ থেকে বুঝা গেলো যে, যার অন্তরে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ভালবাসা বিদ্যমান, সে-ই ‘ক্বোরআনকে যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারবে। যার অন্তরে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ভালবাসা থাকে না, সে ক্বোরআন বুঝতে পারে না। ক্বোরআন বুঝার জন্য হুযূরে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ভালবাসার প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে তাঁর অনুসরণের।
এজন্যই এসব বাতিল ফেরক্বা (ভ্রান্ত মতবাদীরা) বিভিন্ন ধরনের ধোঁকা খাচ্ছে, পথভ্রষ্ট হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। তারা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মর্যাদাহানির চেষ্টা চালাচ্ছে। এসব বিবেকহীন, অনুপযুক্ত লোক বুঝতে পারছে না। (আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ করেন) ‘‘আমি আপনার জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি।’’ অর্থাৎ যাঁর সম্মানকে আল্লাহ্ পাক বুলন্দ করেন, কার শক্তি আছে সেটাকে কমানোর? এজন্যই এসব ভ্রান্ত মতবাদী লোক বুঝছে না, তারা শুধু মুখে কলেমা উচ্চারণ করে; (কিন্তু কলেমার মর্মার্থ) বুঝছে না।
যে কিতাব (ক্বোরআন মজীদ) বুঝতে চায়, তার উচিত যেন সে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসারী হয়ে যায়। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ভালবাসার জন্য যেন অন্তরে স্থান করে নেয়। যখন হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ভালবাসা অর্জিত হয়ে যায়, তারপরই সে ক্বোরআন পাক বুঝতে পারবে।
যতক্ষণ হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ভালবাসা অন্তরে অর্জিত হবে না, সে ক্বোরআন পাক বুঝতে সক্ষম হবে না। কেউ সেটা ব্যতীত ক্বোরআনকে যথাযথভাবে বুঝতে সমর্থ হবে না।
আল্লাহ্ পাক আরো এরশাদ করেছেন, ‘‘তিনি এ ক্বোরআন করীম দ্বারা অনেককে গোমরাহ্ করেন এবং অনেককে হিদায়ত করেন।’’ অনেকে এ ক্বোরআন করীমের মাধ্যমে পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অনেকের হেদায়ত অর্জিত হয়েছে। বস্তুতঃ ক্বোরআন করীমকে বুঝার জন্য হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নূরের প্রয়োজন। যার মধ্যে নূর থাকবে, যার মধ্যে ভালবাসা থাকবে সে-ই প্রকৃতপক্ষে ক্বোরআন করীম বুঝবে। পক্ষান্তরে, যেসব লোক তা থেকে বঞ্চিত হবে, তারা ক্বোরআন পাক বুঝতে পারে না।
আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে ও আপনাদেরকে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রকৃত ভালবাসা দান করুন। হে আল্লাহ্ ক্ববূল করুন।
নূরানী তাক্বরীর-নয়
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
اِنَّمَا وَلِیُّكُمُ اللّٰهُ وَ رَسُوْلُهٗ وَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوا الَّذِیْنَ یُقِیْمُوْنَ الصَّلٰوةَ وَ یُؤْتُوْنَ الزَّكٰوةَ وَ هُمْ رٰكِعُوْنَ وَمَنْ یَّتَوَلَّ اللّٰهَ وَ رَسُوْلَهٗ وَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا فَاِنَّ حِزْبَ اللّٰهِ هُمُ الْغٰلِبُوْنَ۠
তরজমা :
৫৫. এতদ্ব্যতীত নয় যে, তোমাদের একমাত্র বন্ধু হচ্ছেন আল্লাহ্, তাঁর রসূল এবং ঈমানদারগণ, যারা নামায ক্বায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ্রই সামনে বিনত হয়।
৫৬. আর যারা ভালবাসে আল্লাহকে, তাঁর রসূলকে এবং তাদেরকে, যারা ঈমান এনেছে (নিশ্চয়ই তারা আল্লাহর দল); সুতরাং নিশ্চয় আল্লাহর দলই বিজয়ী। [সূরা মা-ইদাহ্: আয়াত-৫৫-৫৬, কানযুল ঈমান]
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেন, এতদ্ব্যতীত নয় যে, (নিশ্চয়) তোমাদের বন্ধু হলেনÑ আল্লাহ্, আল্লাহ্ তোমাদের বন্ধু, তোমাদের অভিভাবক (সাহায্যকারী) এবং আল্লাহ্র রসূল তোমাদের বন্ধু, তোমাদের অভিভাবক, সাহায্যকারী আর ওইসব লোকও, যারা ঈমান এনেছে, নামায ক্বায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং তারা রুকূ’কারী; আর যেসব লোক মুহাব্বত রাখে, বন্ধুত্ব রাখে আল্লাহর সাথে, আল্লাহর রসূলের সাথে, মু’মিনদের সাথে, (নিশ্চয় তারা আল্লাহর দল বা জনগোষ্ঠী। নিশ্চয় আল্লাহর দল, আল্লাহর জমা‘আত, আল্লাহর জনগোষ্ঠী বিজয়ী, এরাই প্রাধান্য অর্জনকারী।
এ মানবগোষ্ঠী, এ দল, যাদের অন্তরে আল্লাহ্, আল্লাহ্র রসূল এবং মু’মিনদের প্রতি বন্ধুত্ব ও ভালবাসা থাকে এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত প্রদান করে এবং রুকূ’ করে, যাদের অন্তরে আল্লাহ্, আল্লাহর রসূল এবং মু’মিনদের সাথে, মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা থাকে, তারাই বিজয়ী।
এ আয়াতের শানে নুযূল হচ্ছে- হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে সালাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ইহুদীদের বড় আলিম ছিলেন। এখন মুসলমান হয়ে গেছেন। তিনি একদিন রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে এসে আরয করলেন, “হে আল্লাহ্র রসূল! বনী ক্বোরাইযা এবং বনী নযীর- দু’টি গোত্র আমাকে সব বিষয়ে বয়কট করে বসেছে। (সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছে।) এ প্রসঙ্গে এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে- এতদ্ব্যতীত নয় যে, (নিশ্চয়) তোমাদের বন্ধু হলেন আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূল… আল-আয়াত।
যখন এ বরকতময় আয়াত নাযিল হলো, তখন হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে সালাম-এর মনে শান্ত¦না এলো। তাঁদের উদ্দেশে বলা হলো যে, এখন থেকে যদি ইহুদী সম্প্রদায় তোমাদেরকে বয়কট করে নেয়, তবে তোমাদের ক্ষতি কি? তোমাদের সাথে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা স্থাপনকারী তো রয়েছেন আল্লাহ্, আল্লাহর রসূল ও মু’মিন-মুসলমানগণ। যদিও ওইসব লোক (ইহুদীরা) তোমাদেরকে বয়কট করেছে, তবুও মুসলমানগণ, যারা রুকু’কারী, যারা সাজদাকারী, যারা নামায প্রতিষ্ঠাকারী, তারাতো তোমাদের বন্ধু হয়ে গেছেন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে সালাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তখন বললেন, ‘‘হে আল্লাহ্র রসূল, আমি সন্তুষ্ট হয়েছি আল্লাহ্ প্রতিপালক হবার উপর এবং হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা আল্লাহ্র রসূল হবার উপর আমি রাজি হয়েছি।”
এ আয়াতের শানে নুযূল তো এমনিই। তবে এর তাৎপর্য অন্যরূপও এসে যায়। এ থেকে বুঝা গেল যে, আল্লাহ্র সাথে, আল্লাহর রসূলের সাথে এবং মু’মিনদের সাথে যাদের বন্ধুত্ব রয়েছে, ওইসব লোক, যারা নামাযসমূহ কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, রুকু’ করে ওইসব লোকই বিজয় অর্জনকারী। ওইসব লোক কামিয়াব। ওইসব লোক বিজয়ী-সমগ্র জাহানের উপর, সমগ্র জাহানের উপর এরা বিজয়ী।
যেহেতু এসব লোক আল্লাহ্ওয়ালা হয়ে গেছেন, তাঁদের মুহাব্বত রয়েছে আল্লাহ্র সাথে, আল্লাহ্র রসূলের সাথে এবং মু’মিনদের সাথে, সেহেতু আল্লাহ্, আল্লাহ্র রসূল এবং মু’মিনগণ তাঁদের সাহায্যকারী হয়েছেন। এ দলই বিজয়ী। কেননা, আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার সাহায্য তাঁদের অর্জিত হয়েছে। আল্লাহ্র রসূলের সাহায্য তাদের হাসিল হয়ে গেছে। তাদের কাজেই এসব লোক এমন বিজয়ী যে, তাদের সাথে কেউ মুকাবেলা করে জয়ী হতে পারে না। এসব লোক, আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার কর্তৃত্বের মধ্যে রয়েছে, আল্লাহ্ তা‘আলার তরফ থেকে, আল্লাহ্ তা‘আলার নির্দেশে রাজত্ব করছেন এবং তাঁদের বাদশাহী রয়েছে স্থল ও জলের উপর, তাঁদের বাদশাহী রয়েছে বৃক্ষ ও পাথরের উপর এবং তাঁদের কথা মান্য করা হয়, তাঁরা যা বলেন তা মান্য করা হয়। ক্বোরআন পাক এবং হাদীস শরীফ থেকে প্রমাণিত হয় যে, তাঁদের কথা মান্য করা হয়।
এটা নয় যে, তাঁরা আল্লাহ্ হয়ে গেছেন। এ থেকে তাঁরা আল্লাহ হননি; বরং তাঁরা আল্লাহ্র দল হয়ে গেছেন, আল্লাহ্র জমা‘আত হয়ে গেছেন। তাঁরা আল্লাহ্র দলে শামিল হয়ে যাবার কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁদেরকে এ মর্যাদা দিয়েছেন যে, তাঁরা যা বলেন, তার আনুগত্য করা হয়। হযরত ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর নিকট মিশরের গভর্ণর চিঠি লিখেছেন, ‘এখানে নীল নদ অবাধ্য হয়ে গেছে। (পানি অনেক নিচে নেমে গেছে।)
এখানকার জনসাধারণের নিয়ম হচ্ছে যে, তারা এমতাবস্থায় একটা মেয়েকে সুসজ্জিত করে সেটার মধ্যে ফেলে দেয়। এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?’ হযরত ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু একটা চিঠি লিখলেন দরিয়াকে, চিঠিটি লিখেছেন নীল নদের নামে। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘হে দরিয়া, তুমি বিদ্রোহী হয়ো না, সঠিক পরিমাণে পানি প্রবাহিত করো।’ অতঃপর এ নীল নদের মধ্যে আজ পর্যন্ত কোন ব্যতিক্রম আসেনি। কারণ, সমস্ত জিনিষই তাঁদের কথা মান্য করে। নীল নদও মেনে নিয়েছে।
এর মর্মার্থ এযে, তাঁদের কথা মান্য করা হয়। তাঁদের কথা প্রত্যেক কিছু মান্য করে। কেননা, তাঁরা আল্লাহ্ ওয়ালা হয়ে গেছেন। তাঁরা আল্লাহ্র দলে শামিল হয়ে গেছেন। যাঁরা আল্লাহ্র দলে শামিল হয়ে গেছেন তাদের কোন কষ্ট নেই, কোন পেরেশানী নেই। তাঁরা কৃতকার্য। আল্লাহর দল সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, ‘‘শুনো! নিশ্চয়ই আল্লাহ্র দল বিজয়ী।’’
এর ব্যাখ্যায় আরয করছি যে, এরা যারা রাজ্যের হাকিম (বিচারক) হন, কমিশনার হন, তাঁরাও তাতে নিজেদের ক্ষমতা চালান; কিন্তু এতে তো তারা বাদশাহ্ হয়ে যান না; বরং বাদশাহর দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। তাঁরা তো বিচারক, প্রশাসক হয়ে বিজয়ী হন। অনুরূপ, যাঁরা আল্লাহ্ওয়ালা হন, আল্লাহর দলে শামিল হন, সে সব লোকের সাথে কেউ মোকাবেলা করে জয়ী হতে পারে না, তাঁরাই প্রত্যেক জায়গায় বিজয়ী থাকেন।
কেননা, এসব ইনসান আল্লাহ্ ওয়ালা হয়ে গেছেন। যাঁদের মুহাব্বত রয়েছে আল্লাহর সাথে, আল্লাহর রসূলের সাথে এবং মু’মিনদের সাথে, তাঁদের সাথে কারো ভালবাসা ও দোস্তী হলে তাঁর পরাজয় নেই। তাঁরা অসম্পূর্ণ নন; প্রতিটি ময়দানে কৃতকার্য।
কাজেই, বুঝা গেল যে, যেসব লোক বলে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ সাহায্য করতেই পারে না, আল্লাহ্র ওলীগণ সাহায্য করতে পারেন না, তারা ক্বোরআন পাকের এ আয়াতকে অস্বীকার করে। তারা জানে না যে, ক্বোরআন পাক এরশাদ করছে, তোমাদের বন্ধু, তোমাদের সাহায্যকারী হচ্ছেন আল্লাহ্, তাঁর রসূল এবং মু’মিনগণ।
প্রসঙ্গতঃ অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে- ‘আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের সাহায্যকারী আর কেউ নেই।’ আর এখানে এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমাদের দোস্ত, তোমাদের মদদ্গার হন আল্লাহ্, আল্লাহ্র রসূল ও মু’মিনগণ, যারা নামায ক্বায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং তারা রুকূ’কারী। অর্থাৎ তোমাদের বন্ধু হলেন- আল্লাহ্, আল্লাহর রসূল এবং মু’মিনগণ। আর এমনও এরশাদ হচ্ছে যে, এবং তোমাদের জন্য আল্লাহ্ ব্যতীত না আছে কোন বন্ধু, না আছে মদদগার।
বাতিল ফিরক্বার লোকেরা মুসলমানদেরকে পথভ্রষ্ট বলে। আর ক্বোরআন মজীদ বলে বেড়ায়, এটা আয়াত। এতে এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের জন্য কোন বন্ধুও নেই, তোমাদেরকে কেউ সাহায্যও করতে পারে না।’
তখন মুসলমানগণ হতভম্ব হয়ে যায় আর বলে এ কি? (পরস্পর বিরোধী আয়াত!) এর জবাব হচ্ছে- বস্তুতঃ এ আয়াতে উল্লেখিত ‘মিন দূ-নিল্লাহি’-এর মর্মার্থ হচ্ছে আল্লাহর মোকাবেলায় এসে কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারে না। অর্থাৎ আল্লাহ্ যদি কাউকে সাজা দিতে চান, তবে কারো শক্তি নেই যে, সে সাজা দূরীভূত করবে। আর যদি আল্লাহ্ কাউকে কিছু দান না করতে চান, তবে কেউ তাকে তা দিতে পারে না। অর্থাৎ আল্লাহ্র মোকাবেলায় এসে কাউকে কিছু প্রদান করা- এটা হতে পারে না। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন- আমার মোকাবেলায় এসে কাউকে সাহায্য করতে পারে না। আয়াতের মর্মার্থ এর বিপরীত নয়। মর্মার্থ হচ্ছে- আল্লাহর মোকাবেলায় এসে কেউ কারো সাহায্য করতে পারে না।
আমরা যখন এ পৃথিবী থেকে পরলোকে চলে যাই, তখন মুসলমানগণ ঈসালে সাওয়াব করে থাকেন। ক্বোরআন ইত্যাদি পড়ে মরহুমদের রূহে সাওয়াব পৌঁছান। (এতে মুসলমানগণ উপকৃত হন)। আর আউলিয়া কেরাম, যাঁরা মাযারসমূহে রয়েছেন, তাঁরা সেখান থেকে আল্লাহর সৃষ্টির উপকারও করেন, তাঁরা সৃষ্টির সাহায্য করেন তাঁদের শারীরিক সম্পর্ক তো ছিন্ন হয়ে যায়, কিন্তু রূহানী সম্পর্ক খতম হয় না। সেটা ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকে। সেটার ধবংস নেই। সেটা স্থায়ী।
সুতরাং ওইসব বাতিল ফিরক্বার বিভ্রান্তির ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। তারা ক্বোরআন করীমের এ ধরনের আয়াতসমূহ এমনভাবে জনসমক্ষে উপস্থাপন করে থাকে, যাতে সরলপ্রাণ মুসলমানগণ তাদের চক্করে এসে যায়। এ জন্য উচিৎ হচ্ছে যদি এ ধরনের কোন বিভ্রান্তিমূলক কথা শুনেন, তবে তৎক্ষণাৎ নিজেদের (হক্কানী সুন্নী) আলেমদের নিকট চলে যাওয়া এবং তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করে নেওয়াÑ ক্বোরআন তো এমন বলেছে, এর সহীহ্ অর্থ কী? তখন তাঁরা আপনাদেরকে বুঝিয়ে দেবেন। নতুবা এ সব লোকের খপ্পরে (চক্রান্তে) পড়ে নিজেদের পরিণাম বরবাদ করার সম্ভাবনা খুব বেশী।
ক্বোরআন পাক থেকে অর্থ বের করে এবং তা বুঝা এত সহজ কাজ নয়, অতি মুশকিল কাজ। একদা এক ব্যক্তি এক বড় আলেম ও ইমামের নিকট এসে বললো, ‘‘আপনার অনুমতি পেলে আমি আপনার সামনে ক্বোরআন শরীফ থেকে তেলাওয়াত করবো, এর একটা আয়াত পড়বো, তারপর সেটার তরজমা (অর্থ) বলবো এবং তফসীর (ব্যাখ্যা) করবো।’’ তিনি (আলিম) বললেন, ‘‘না তোমার জন্য এর অনুমতি নেই।’’ অতঃপর সে বললো, ‘‘তাহলে আমি একটা হাদীস শরীফ পাঠ করবো এবং সেটার অর্থ বলবো।’’ তখন তিনি (আলিম) বললেন, ‘‘না তোমার জন্য অনুমতি নেই।’’ অতঃপর উপস্থিত লোকেরা বললো, ‘‘হুযূর, যদি লোকটা ভুল বলতো তবে আপনি শুদ্ধ করে দিতেন। তাকে তো তখন বুঝাতে পারতেন। তা না করে একেবারে অনুমতিই দিলেন না। এর কারণ কি?’
তদুত্তরে তিনি বললেন, কথা হচ্ছে- ‘লোকটা বদ-আক্বিদা (ভ্রান্ত আক্বিদার অনুসারী)। তার নিকট থেকে কিছু শুনে যদি আমার ঈমানে অনু পরিমাণও পার্থক্য আসে, তবে আমি তো বরবাদ হয়ে যাবো। আমি তো ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়ে যাবো। কাজেই, তার থেকে ক্বোরআনের আয়াত শ্রবণ করার কি প্রয়োজন? এ বদ আক্বীদার নিকট থেকে হাদীস শুনার প্রয়োজনই বা কি? আমার কোন প্রয়োজন নেই।’ এটাই সঠিক পন্থা যে, বদ-আকীদা লোকদের থেকে দূরে সরে থাকো এবং সৎ লোকদের সঙ্গ অবলম্বন করো। সুতরাং তোমরাও তাঁদের সঙ্গী হয়ে যাও। (কারণ আল্লাহ্ তাঁর রসূল এবং মু’মিনগণ তো সৎ লোকদেরই বন্ধু।) আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেন, ‘‘নিশ্চয়ই তোমাদের বন্ধু, তোমাদের সাহায্যকারী হচ্ছেন আল্লাহ্, তাঁর রসূল ও মু’মিনগণ। আর যারা আল্লাহকে, আল্লাহ্র রসূলকে ভালবাসে এবং নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে এবং রুকু’কারী, তারাই আল্লাহ্র দল। আর আল্লাহ্র দলই বিজয়ী। তারাই আল্লাহ্র জমা‘আত তাঁরা সর্বত্র বিজয়ী থাকবেন।
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা আমাদেরকে ও আপনাদেরকে বিজয়ী রাখুন। আ-মী-ন।
নূরানী তাক্বরীর-দশ
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
وَ مَا رَمَیْتَ اِذْ رَمَیْتَ وَ لٰكِنَّ اللّٰهَ رَمٰىۚ-
তরজমা
(হে আমার হাবীব!) আপনি যে মাটি কাফিরদের প্রতি নিক্ষেপ করেছিলেন, তা আপনি নিক্ষেপ করেননি, বরং আল্লাহই নিক্ষেপ করেছেন। [সূরা আন্ফাল: আয়াত-১৭: কানযুল ঈমান]
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমান, ‘ওয়ামা- রামায়তা ইয্ রামায়তা ওয়ালা- কিন্নাল্লা-হা রামা’ হে আমার হাবীব! আপনি যে মাটি কাফিরদের প্রতি নিক্ষেপ করেছিলেন, তা আপনি নিক্ষেপ করেননি, আল্লাহই নিক্ষেপ করেছিলেন।
এ পবিত্র আয়াত বদরের যুদ্ধের ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট। যখন মক্কার ক্বোরাঈশরা যুদ্ধের অনেক সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে মদীনা মুনাওয়ারার উপর হামলা করার জন্য এসেছিলো, তারা তখন অনেক জোরে-শোরে বলতে লাগলো, ‘‘আমরা ইসলামের বাগিচাকে খতম করতে এবং হিদায়তের প্রদীপকে নির্বাপিত করতে এসেছি। বদর নামক স্থানে (উভয় দল) মুখোমুখী হলো। সারা রাত সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর যিকরে রত ছিলেন। পক্ষান্তরে, কাফিররা পাপাচার ও অশ্লীল কাজে, গান-বাজনা এবং মদ্যপান ইত্যাদিতে মগ্ন ছিলো। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাজদারত হয়ে এতো বেশী কান্নাকাটি করলেন যে, তাঁর সাজদার জায়গার আশ-পাশ পর্যন্ত তাঁর চক্ষু মুবারকের পবিত্র অশ্রু দ্বারা ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছিলো।
এটা ওই যুদ্ধ, যার সম্পর্কে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন- আবূ জাহল এখানে মরবে, শায়বা এখানে মরবে, উত্বা এখানে দোযখে নিক্ষিপ্ত হবে- এ এ স্থানে তারা (কাফিররা) জাহান্নামে পৌঁছবে। বর্ণনাকারী সাহাবী বর্ণনা করেছেন যে, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যে কাফির যে স্থানে মরবে বলে চিহ্নিত করেছিলেন, ওই স্থান হতে একচুল পরিমাণও এদিক-সেদিক হয়নি। যে যে স্থানে মরবে বলে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, সে সেখানেই জাহান্নামে পৌঁছে গিয়েছিলো।
ওই সময় (যুদ্ধের প্রারম্ভে) হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কাফিরদের প্রতি এক মুষ্ঠি বালু মাটি নিক্ষেপ করেছিলেন, সকল কাফিরদের চোখে ওই বালুকণা পড়লে তারা চোখ কচলাতে রইলো। (আর ওই সময় মুসলমানদের আক্রমনে) তারা চরমভাবে পরাজিত হয়েছিলো।
আল্লাহ্ তাবারাক ওয়া তা‘আলা এরশাদ ফরমায়েছেন, হে হাবীব! আপনি যে-ই মাটি নিক্ষেপ করেছিলেন, তা আপনি নিক্ষেপ করেন নি, আমি নিক্ষেপ করেছিলাম।
এ ঘটনা থেকে একথা বুঝা গেলো যে, তাসাওফ শাস্ত্র মতে, ‘ফানাফিল্লাহ্’র স্তর অনেক ঊর্ধ্বে। ফানাফিল্লাহ্ ও বাক্বাবিল্লাহ্ (যথাক্রমে, আল্লাহ্র মধ্যে বিলীন হওয়া ও আল্লাহ্র বিশেষ সাহায্যে জীবিত থাকা)’র মর্যাদা যখন কোন বান্দার অর্জিত হয়ে যায়, তখন তিনি তাঁর প্রকৃত আকৃতিতে থাকেন সত্য; কিন্তু মহান রবের ইশ্ক্ব (প্রেম) বা ভালবাসা তাঁর প্রতিটি শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ে। তিনি তখন যে কাজই করুন না কেন, তখন তা আল্লাহ্ তা‘আলার দিকেই সম্পৃক্ত হয়ে যায়। আর তিনি তখন কথা বলেন, তখন জিহ্বা তাঁর থাকে, কিন্তু ওই কথা হয় অন্যের। এ প্রসঙ্গে মাওলানা রূমী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেছেন-
গুফ্তায়ে ঊ- গোফতায়ে আল্লাহ্ বুয়াদ, – গরছেহ্ আয হলক্ব ূ-মে আবদুল্লাহ্ বুয়াদ।
অর্থাৎ ঃ “তাঁর (বান্দা) কথা আল্লাহরই কথা হয়ে যায়, যদিও তা আল্লাহ্র ওই বান্দার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়।’’
দেখুন! হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম যখন তূর পাহাড়ের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন বৃক্ষ হতে ধ্বনিত হচ্ছিলো, “হে মূসা! নিশ্চয় আমিই আল্লাহ্, বিশ্ব-প্রতিপালক।’’ [সূরা ক্বাসাস: আয়াত-৩০]
এ ধ্বনি বৃক্ষ হতে উচ্চারিত হলেও ধ্বনিটি বৃক্ষের ছিলো না, বরং ধ্বনিতো আল্লাহ্ তা‘আলারই ছিলো। তেমনিভাবে, জ্বিন্ যখন কারো উপর প্রভাব বিস্তার করে, তখন কথা জ্বিনই বলে থাকে, যদিও মুখ জিনগ্রস্ত মানুষেরই হয়ে থাকে। তদ্রƒপ, কয়লা যখন আগুনের সাথে মিলিত হয় তখন তা আগুনে পরিণত হয়। তখন কয়লা আগুনের মতো কাজ করে। কোন বস্তু তখন ওই কয়লাকে স্পর্শ করলে কয়লা সেটাকেও জ্বালিয়ে দেয়।
এটাতো উদাহরণ মাত্র। এ স্তরে এসে অনেক আরিফ (খোদাপরিচিতি সম্পন্ন) বান্দা নিজের দৃঢ়তা এবং ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারেন না। যেমন হযরত মানসূর হাল্লাজের মুখে উচ্চারিত হয়েছিলো, “আনাল হক্ব।” (আমিই সত্য আল্লাহ।) কেউ কেউ বলেন, তাঁর মুখে ধ্বনিত হয়েছিলো, “আনাল্লা-হ্” (আমিই আল্লাহ্)। অর্থাৎ তিনি এতে স্থির থাকতে পারেননি। তাঁর মুখে ‘আনাল হক্ব’ উচ্চারিত হয়ে গিয়েছিলো। এখানেও আসলে কথা ছিলো আল্লাহ্ তা‘আলার, মুখ ছিলো তাঁর।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, ফেরআউনও বলেছে, “আনা রাব্বুকুমুল আ’লা।” (আমি তোমাদের সর্বোচ্চ রব।) আর মানসূর হাল্লাজের মুখেও এ একই ধরনের বাক্য (আনাল হক্ব) বের হয়ে গিয়েছিলো;
কিন্তু উভয়ের বলার মধ্যে বড় পার্থক্য বিদ্যমান। ফেরআউন আমিত্ব, অহংকার ও গর্বভরে ‘আমি সর্বোচ্চ রব’ বলেছিলো। আর হযরত মানসূর হাল্লাজ যে ‘আনাল হক্ব’ বলেছিলেন, তা এজন্য ছিলো যে, তখন ‘হক্ব’ (আল্লাহ্) ব্যতীত অন্য কিছু তাঁর দৃষ্টিতে আসেনি। তাঁর অস্তিত্ব তখন আল্লাহ্তে বিলীন হয়ে গিয়েছিলো। সুতরাং তাঁর মুখে আল্লাহ্ তা‘আলার বাণী শরীফ উচ্চারিত হয়েছিলো। তাই নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয়া এবং নিজের ‘আমিত্ব’ থেকে বেরিয়ে আসা অতি প্রয়োজন।
তাসাওফের পথে যে সব লোক নিজেকে নিজে কিছু মনে করে, আর বলে বেড়ায়, আমি এটা করেছি, ওটা করেছি, আমি এ ইবাদত করি, ওই নেক কাজ করি, আমি এমন করি; ইত্যাদি, সে তাসাওফের প্রকৃত রহস্য সম্পর্কে বে-খবরই রয়ে গেছে। তার খবরই নেই যে, সে ‘আমি, আমি’ করতে করতে নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করে দেবে, শেষ পর্যন্ত কবরে পৌঁছে যাবে। সে জান্নাতের কোন সুগন্ধিও সে পাবে না। তাই আমিত্বের অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসা চাই। বিশেষতঃ যারা তরীক্বতের মধ্যে প্রবেশ করেছে, তারা যেন কখনো কল্পনাও করবে না যে, এ ইবাদত করেছি। আমরা এটা করেছি, আমরা মাদরাসার খিদমত করেছি, খানক্বার খেদমত করেছি। এ সবের প্রতি কখনো কল্পনাও করবে না; বরং এ মর্মে শোকর আদায় করবে যে, ‘আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে এ সব করার শক্তি দিয়েছেন আর আমার থেকে এ কাজ নিয়েছেন, অথচ আমি এ কাজের যোগ্য ছিলাম না।’ এ জন্য সে শোকরিয়া আদায় করবে। এটার বিপরীতে গর্ব-অহংকার করবে না।
হযরত মনসূর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির মতো আরিফ বান্দা ফানাফিল্লাহ্র স্তরে নিজেকে সামলাতে পারেননি; কিন্তু কী আশ্চর্য! হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে এরশাদ হচ্ছেÑ ‘যে মাটি তিনি নিক্ষেপ করেছেন, তা তিনি নিক্ষেপ করেননি, আল্লাহ্ই নিক্ষেপ করেছেন। তিনি যা বলেন, তার সবই আল্লাহ্র কথা।
এরশাদ হচ্ছে- ‘‘এবং তিনি কোন কথা নিজ প্রবৃত্তি থেকে বলেন না, তা’তো নয়; কিন্তু ওহীই, যা তাঁর প্রতি (নাযিল) করা হয়। [সূরা নাজ্ম: আয়াত-৩-৪]
আরো এরশাদ হচ্ছে- ওই সব লোক, যারা আপনার নিকট বায়‘আত করছে, তারাতো আল্লাহ্রই নিকট বায়‘আত গ্রহণ করছে। [সূরা ফাত্হ: আয়াত-১০]
হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বায়‘আতকে আল্লাহ্ তা‘আলা নিজের বায়‘আত বলে উল্লেখ করেছেন। এরশাদ হচ্ছেÑ ‘আল্লাহ্র ক্বুদ্রতের হাত তাদের হাতের উপর’। (৪৮:১০) এটা পর্যন্ত এরশাদ হয়েছে Ñ ‘আপনি যা বলেন, তা আমারই কথা’, ‘আপনি যে মাটি নিক্ষেপ করেছেন, তা আমিই নিক্ষেপ করেছি’, আর ‘আপনার বায়‘আত মানে আমার বায়‘আত।’ এতদ্সত্ত্বেও হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সর্বদা বলতেন যে, “আমিতো আল্লাহ্র একজন বান্দা।” এটা তাঁর মহান মর্যাদা। এটা তাঁরই অটলতারই প্রমাণ। অনেক আরিফ বান্দা এ স্তরে এসে নিজেদের অটল ও অবিচল রাখতে পারেন না। একারণেই বলে ফেলেছে, ‘আনাল হক্ব’ (আমিই পরম সত্য); কিন্তু হুযূর-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পূর্ণতার অবস্থা কতোই আশ্চর্যজনক! তাঁর কী অটলতা! কবির ভাষায়-
‘‘হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম আল্লাহ্র নূরের অতি সামান্য তাজাল্লী দেখেই বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলেন, আর হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এমন অপরূপ মর্যাদায় উন্নীত যে, তিনি আল্লাহ্ তা‘আলার দীদার হাসিমুখে, স্বাচ্ছন্দ্যেই করেছিলেন।’
(আপনি নিক্ষেপ করেন নি যখন আপনি নিক্ষেপ করেছেন)-এ আয়াত দ্বারা একথাও প্রতীয়মান হয় যে, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শানে সামান্যতম বেয়াদবী করাও মূলত আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে বেয়াদবী করার নামান্তর, আর ওই বেয়াদব ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়, কাফির হয়ে যায়। বস্তুত কোন ব্যক্তি যত বড় আলিম হোক, যত বড় ইবাদতকারী হোক, যত বড় মুত্তাক্বী হোক, সে অনেক কিছুই হোক না কেন, কিন্তু কখনো সে যদি তাঁর (হুযূর-ই করীম) পবিত্র পাদুকা যুগলের সাথেও সামান্য বেয়াদবী করে, তবে সে মুরতাদ্দ্ (ধর্মত্যাগী) ও কাফির হয়ে যায়। যেমন পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হচ্ছে-
‘‘তোমাদের সমস্ত পুণ্যকর্ম বরবাদ হয়ে যাবে, অথচ তোমরা তা অনুধাবনও পারবে না।’’ (৪৯:২)
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা আমাদেরকে আপনাদেরক এ মহান দরবারের আদব রক্ষা করার তাওফীক্ব দিন। আ-মী-ন।
হে আল্লাহ্, রহমত বর্ষণ করুন আমাদের আক্বা হযরত মুহাম্মদ মোস্তফার প্রতি, আমাদের আক্বা হযরত মুহাম্মদ মোস্তফার পবিত্র বংশধরের প্রতি এবং নাযিল করুন বরকত ও শান্তি।
নূরানী তাক্বরীর-এগার
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
وَ لَوْ اَنَّهُمْ رَضُوْا مَاۤ اٰتٰىهُمُ اللّٰهُ وَ رَسُوْلُهٗۙ-وَ قَالُوْا حَسْبُنَا اللّٰهُ سَیُؤْتِیْنَا اللّٰهُ مِنْ فَضْلِهٖ وَ رَسُوْلُهٗۤۙ-اِنَّاۤ اِلَى اللّٰهِ رٰغِبُوْنَ۠
তরজমা:
‘এবং কতই ভালো হতো যদি তারা সন্তুষ্ট হতো সেটার উপর, যা আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল তাদেরকে প্রদান করেছেন, আর বলতো ‘আল্লাহ্ তাবারাকা তা‘আলা আমাদের জন্য যথেষ্ট।’ এখন আল্লাহ্ আমাদেরকে দিচ্ছেন আপন করুণা থেকে এবং তাঁর রাসূলও; আমরা আল্লাহরই প্রতি আসক্ত।’ [সূরা তাওবা, আয়াত:৫৯, কানযুল ঈমান]
আল্লাহ্ তাবা-রাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেন, কতোই উত্তম হতো, যদি তারা সন্তুষ্ট হতো সেটার উপর, যা কিছু তাদেরকে দিয়েছেন আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল; এর উপর যদি তারা রাজি হয়ে যেতো! তাহলে তা কতোই উত্তম হতো! আর বলতো, ‘আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের জন্য যথেষ্ট। অবিলম্বে আমাদেরকে দেবেন আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা আপন অনুগ্রহ থেকে এবং তার রসূলও। নিঃসন্দেহে আমরা আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি আসক্ত।
এ আয়াত শরীফ অবতরণের প্রেক্ষাপট (শানে নযূল) এই যে, একদা হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম গণীমতের মাল বন্টন করছিলেন। ওখানে এক ব্যক্তি ছিলো। তার নাম যুল্ খুয়াইসারাহ্ হারক্বূস ইবনে যুহায়র ছিলো। সে দাঁড়িয়ে আরয করলো, হে আল্লাহর রসূল, আপনি আপনার বন্টনে ইনসাফ করুন! ন্যায়পরায়ণতার সাথে বন্টন সম্পন্ন করুন!, (আল্লাহরই পানাহ্)।
তখন হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘আমি যদি ইনসাফ না করি, তবে দুনিয়াতে ইনসাফকারী আর কে আছে?’’ এর ভিত্তিতে হযরত ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আরয করলেন, ‘‘হে আল্লাহর রাসূল, সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম, আমাকে অনুমতি দিন, আমি এ বে-দ্বীন (মুনাফিক্ব)-এর গর্দান উড়িয়ে দিই।’
হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, ‘‘ওমর! আল্লাহ্র অভিপ্রায় এ যে, এ ব্যক্তির বংশে এমন দল সৃষ্টি হবে, যাদের নামায আর বাহ্যিক পরহেযগারী তোমাদের নামায ও পরহেয্গারীকে ছাড়িয়ে যাবে; কিন্তু তারা ঈমান হতে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে, যেমন তীর ধনুক থেকে বের হয়ে যায়। তারা ক্বোরআন শরীফ পড়বে, কিন্তু ক্বোরআন তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবেনা। তা টেপ রের্কডারের মতোই পড়া হবে মাত্র। টেপ রের্কডার বাজে ঠিকই, কিন্তু এতে কোন উদ্দেশ্য তাকে না। তাই তা কিছুই নয়।
এতে বুঝা গেলো যে, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কোন পবিত্র কাজের বিপক্ষে আপত্তি করা কুফরী। এ জন্যই হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেছেন, ‘আমাকে অনুমতি দিন, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দিই।’ কেননা, মুরতাদ্দ্ (ধর্মত্যাগী) হত্যারযোগ্য। কিন্তু হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, ‘‘না, ক্বতল করো না। আল্লাহ্র ইচ্ছা হচ্ছে এরূপ। (যা একটু আগে বলা হয়েছে।)
এতে আরো প্রতীয়মান হয় যে, যদি কোন ব্যক্তি এটা বলে যে, ‘আল্লাহ্ এবং আল্লাহ্র রসূল আমাকে ইজ্জত দেবেন, ঈমান দেবেন, এটা দেবেন, এটা দেবেন’, তাহলে এটা শিরক্ নয়। কেননা, আল্লাহ্ তা‘আলা ক্বোরআন পাকে বলেছেন, ‘সা‘ইয়ূ’তী-নাল্লাহু মিন ফাদ্বলিহী ওয়া রাসূলুহু।’ অবিলম্বে আল্লাহ্ আমাদেরকে দেবেন নিজ করুণায় এবং তাঁর রাসূলও। এটা শিরক নয়; বরং এ আমল পবিত্র ক্বোরআনেরই অনুরূপ। পক্ষান্তরে, হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কোন কর্মের উপর আপত্তি করা, কোন প্রকারের অশালীন আচরণ করাই হচ্ছে কুফ্র। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকেÑআপানাদের সকলকে বুঝার তাওফীক্ব দিন। আ-মী-ন।
নূরানী তাক্বরীর-বার
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ عَزِیْزٌ عَلَیْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِیْصٌ عَلَیْكُمْ بِالْمُؤْمِنِیْنَ رَءُوْفٌ رَّحِیْمٌ فَاِنْ تَوَلَّوْا فَقُلْ حَسْبِیَ اللّٰهُ ﱙ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَؕ-عَلَیْهِ تَوَكَّلْتُ وَ هُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِیْمِ۠
তরজমা:
১২৮. “নিশ্চয়ই, তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকে ওই মহান রসূল তাশরীফ এনেছেন। যাঁর নিকট তোমাদের কষ্টে পড়া কষ্টদায়ক, তোমাদের কল্যাণ অতিমাত্রায় কামনাকারী, মুসলমানদের উপর পূর্ণ দয়ার্দ্র, দয়ালু।
১২৯. অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে আপনি বলে দিন, ‘আমার জন্য আল্লাহ্ যথেষ্ট। তিনি ব্যতীত অন্য কোন মা’বূদ নেই। আমি তাঁরই উপর ভরসা করেছি এবং তিনিই মহান আরশের অধিপতি।’ [সূরা তাওবাহ্: আয়াত-১২৮-১২৯, কানযুল ঈমান]
এ মুবারক আয়াতের মধ্যে গভীরভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন, গভীরভাবে চিন্তা করুন। সুবহা-নাল্লাহ্। সর্বপ্রথম এতে নিশ্চয়তাসূচক শব্দ আনা হয়েছে-‘লাক্বদ’। এর মধ্যে ‘লাম’ও নিশ্চয়তাসূচক, ‘ক্বাদ’ও নিশ্চয়তাসূচক। এ দু’টি দ্বারাই আরম্ভ করা হয়েছে। তা এ জন্য যে, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এ কামালাত (পূর্ণতাসমূহ)-এর অস্বীকারকারী রয়েছে। মুসলমানদের মধ্যেও এমন কতগুলো কলেমাগো মুসলমানধারী সৃষ্টি হবে, যারা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কোন কোন পূর্ণতাকে অস্বীকার করবে। এ জন্য এ বরকতময় আয়াত ‘লাম’ ও ‘ক্বাদ’ দুটো নিশ্চয়তাসূচক শব্দ দ্বারা আরম্ভ করা হয়েছে। আর এর মধ্যে কতগুলো বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা হয়েছে গভীরভাবে লক্ষ্য করুন। আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন, ‘‘তিনি তোমাদের নিকট এসেছেন।’’ হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাবের কথা বর্ণনা করেছেন- ‘তিনি তাশরীফ আনয়ন করেছেন’ বচন দ্বারা। এখানে লক্ষ্য করা যাক। আল্লাহ্ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন; অথচ এ পৃথিবী ও আসমান সৃষ্টি করা সম্পর্কে এবং অন্যান্য সৃষ্টির ‘সৃষ্টি করা’ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা ‘খালাক্বা’ (সৃষ্টি করেছেন) বচনটা উল্লেখ করেছেন। অথবা বদী’ (নূতনভাবে সৃষ্টিকারী) শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম, বিশেষ করে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাবের ক্ষেত্রে ‘সৃষ্টি করেছেন’ উল্লেখ করেন নি। তাঁর শানে ব্যবহার করেছেন ‘আরসালনা-কা’, অথবা ‘জা-আকুম’ কিংবা ‘বা‘আসা’ [অর্থাৎ যথাক্রমে, ‘হে হাবীব আপনাকে প্রেরণ করেছি’ অথবা ‘তিনি তাশরীফ এনেছেন’, ‘তিনি (আল্লাহ্) প্রেরণ করেছেন’ ইত্যাদি।] অনুরূপ, সাধারণ মানুষকে বলা হয়েছে ‘ইনসান’, আর হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বলা হয়েছে ‘রসূল’।
এ বরকতময় আয়াতে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর তাশরীফ আনয়নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ‘হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তোমাদের নিকট তাশরীফ এনেছেন’, মু’মিনদের নিকট এসেছেন। মু’মিন যেখানেই থাকুক না কেন, তাঁর নিকট হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ এনেছেন- চাই সে (মু’মিন) মাশরিক্ব বা প্রাচ্যে থাকুক, কিংবা মাগরিব বা পাশ্চাত্যে থাকুক। যদিও হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বেলাদত শরীফ (শুভ জন্ম) মক্কা শরীফে হয়েছে এবং অবস্থান করেছেন মদীনা মুনওয়ারায়, কিন্তু তিনি তাশরীফ এনেছেন বিশ্বের সমস্ত মু’মিনের নিকট। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, ‘‘তোমাদের নিকট তাশরীফ এনেছেন।’’ এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে।
এ কথার উদাহরণ হচ্ছে- যেমন ধরুন সূর্য। সূর্য উদিত হয় আসমান থেকে, সূর্যের অবস্থানও আসমানে। কিন্তু সেটা আলো দেয় গোটা বিশ্বে, সেটার আলো বিশ্বের সর্বত্র পৌঁছে থাকে। অনুরূপ, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আবির্ভূত হয়েছেন মক্কা মুর্কারমায়, কিন্তু তিনি প্রত্যেক মু’মিনের অন্তরেই মওজূদ রয়েছেন। এ কথা মনে রাখা দরকার। এ কারণে, আমরা যখন নামায পড়ি তখন এরই মধ্যে, অর্থাৎ তাশাহ্হুদে পড়ে থাকি- অর্থাৎ ‘‘হে নবী, (সম্বোধন করে) আপনাকে সালাম এবং আপনার উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর রহমত এবং বরকতসমূহ।’’ এমনিতে কেউ মওজূদ না থাকলে, তাকে সালাম দেওয়া হয় না। কেউ না থাকলে তো সালাম দেয়া হয় না। কেউ যদি সালামের জবাব না দেয় কিংবা দিতে না পারে, তাকেও সালাম দেওয়া হয় না, দিওনা।
আর আমরা এ জন্য হুযূর-ই আক্রামকে সালাম দিয়ে থাকি যে, তিনি আমাদের সালামের জওয়াব দিয়ে থাকেন। সৌভাগ্যবান লোকেরা তাঁর সালামের জওয়াব শুনেও থাকেন।
এখানে (আয়াতে) এরশাদ হয়েছে তোমাদের নিকট তাশরীফ এনেছেন এক মহান রসূল তোমাদেরই নিজেদের থেকে। ‘তোমাদের মধ্য থেকে’ প্রেরণ করার হিকমত হচ্ছেÑ যদি হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ফেরেশতাদের মত অদৃশ্য হতেন, তবে আমরা তাঁর নিকট থেকে ফয়য পেতাম কিভাবে? সুতরাং তিনি মানবীয় পোশাক (আবরণ) পরে (বাহিক্যকভাবে মানুষ হিসেবে) এসেছেন। এর মাধ্যমে তিনি ইন্সানিয়াত (মানবীয়তা)কে মর্যাদাবান করেছেন। এ কারণে, মানুষ ফেরেশতাদের উপর প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি মানবীয় পোশাকে বা আবরণে এসে মানব জাতিকেই ধন্য করেছেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, তোমাদের কোন মুশ্কিলে আক্রান্ত হওয়া, তোমাদের দোযখে প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা, তোমাদের কোন গুনাহে লিপ্ত হওয়া দেখে তিনি (হুযূর-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) অতি মাত্রায় দুঃখিত হন, এসব প্রত্যক্ষ করা তাঁর জন্য অতীব কষ্টদায়ক। তিনি এমনই দয়ালু যে, তোমাদের মুশকিল, তোমাদের পেরেশানী ইত্যাদি তিনি বরদাশ্ত করতে পারেন না।
তিনি তোমাদের বেলায় একথার অত্যন্ত প্রত্যাশী যে, তোমরা অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশের উপযোগী হয়ে যাও, আল্লাহ্র রহমতের উপযোগী হয়ে যাও, গুনাহ্ থেকে তোমরা প্রত্যেকে বিরত থাকো। এ সবই তাঁর একান্ত প্রত্যাশার বস্তু।
মু’মিনদের জন্য হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত দয়ালু, মেহেরবান। এখানে বিশেষ লক্ষ্যণীয় যে, ‘রঊ-ফ’ ও ‘রহী-ম’ আল্লাহ্ তা‘আলার দু’টি গুণবাচক নাম। এখানে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা স্বীয় দু’টি গুণবাচক নাম দ্বারা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে স্মরণ করেছেন। সুবহা-নাল্লাহ!
এটা তাঁরই শান বা মর্যাদা। সুতরাং তাঁর মধ্যে এসব পূর্ণতা থাকা সত্ত্বেও যদি তোমরা অবাধ্য হয়ে মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে হে হাবীব! আপনি বলে দিন, ‘‘আমার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট।’’
সুতরাং সত্যপন্থীদের স্মরণ রাখা দরকার যে, যদি কোন ক্ষমতাসীন, এমনকি সমগ্র দুনিয়াও যদি বিরোধী হয়ে যায়, তবুও কোন প্রকার ভয় করা উচিত হবে না। আপনি সত্যের উপর দৃঢ় প্রতিষ্ঠ থাকুন! আর দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিন- ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট!’
একথাও ঘোষণা করুন- ‘আমি তাঁরই (আল্লাহ্) উপর ভরসা করেছি।’ আর ওই পবিত্র সত্ত্বা হলেন- মহান আরশের মালিক, অধিপতি।
আল্লাহ্ পাক আপনাদেরকে ও আমাদেরকে এসব হেদায়তের উপর আমল করার শক্তি দান করুন। হে আল্লাহ্ ক্ববূল করুন।
নূরানী তাক্বরীর-তের
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
قُلْ بِفَضْلِ اللّٰهِ وَ بِرَحْمَتِهٖ فَبِذٰلِكَ فَلْیَفْرَحُوْاؕ-هُوَ خَیْرٌ مِّمَّا یَجْمَعُوْنَ
তরজমাঃ আপনি বলুন, আল্লাহ্রই অনুগ্রহ ও তাঁরই দয়া এবং সেটারই উপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিৎ। তা তাদের সমস্ত ধন-দৌলত অপেক্ষা শ্রেয়। [সূরা ইয়ূনুস: আয়াত-৫৮, কানযুল ঈমান]
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ করেন, হে প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম, আপনি বলে দিন, আল্লাহ্রই অনুগ্রহ ও তাঁর দয়ার উপর খুব আনন্দ করা উচিত। আর এ আনন্দ তাদের জন্য অধিকতর শ্রেয় ওইসব ধন-দৌলত থেকে, যা তারা সঞ্চয় করে থাকে। অর্থাৎ যে ধন-সম্পদ ও স্বর্ণ-রৌপ্য তারা সঞ্চয় করে, তা থেকে অধিকতর শ্রেয় হচ্ছে- আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও তাঁর করুণা প্রাপ্তিতে আনন্দ-উৎসব পালন করা।
আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে বহু প্রকারের আনন্দ প্রদান করেছেন। যেমন- শিশুর জন্মের, সন্তান-সন্তুতির বিবাহ্ উপলক্ষে। আর (পার্থিব) নানা কাজে আমরা আনন্দ-উৎসব পালন করি; কিন্তু উল্লিখিত আয়াতে যে খুশী উদ্যাপন করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা হলো আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া প্রাপ্তিতে খুশী ও আনন্দ উদযাপন করার। আবার আনন্দ-উৎসবও দু’ধরনের হয়ে থাকেঃ
এক, যে আনন্দ উৎসব নাফ্সের তাড়নায় ও অহংকারবশত পালিত হয়ে থাকে। এটা অবৈধ। মানুষ যখন আনন্দে বিভোর হয়ে যায়, তখন সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে, অহংকারী হয়ে উঠে এবং অবৈধ-কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। আর এ সব আনন্দ করা থেকে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা নিষেধ করেছেন। এরশাদ হচ্ছে- “তোমরা অহংকার ও গর্ববোধ করোনা, কেননা, অহংকারীকে আল্লাহ্ পছন্দ করেন না।” তাই অনর্থক অহংকার করা, ধন-সম্পদের উপর গর্ববোধ করা এবং অবৈধ আনন্দ-উৎসব ও ক্রিয়াকান্ডে জড়িয়ে পড়া আল্লাহ্ তা‘আলার অসন্তুষ্টির কারণ হয়।
্দুই, আর যে আনন্দ উৎসব ও খুশী করার জন্য মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন তা হলো ঈমানের খুশী, (দ্বীনের উপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকার খুশী।) যে খুশীতে মানুষ বিনয়ী হয়, চোখ থেকে (কৃতজ্ঞতার) অশ্রু গড়িয়ে পড়ে আর মুখে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করে। কিন্তু এমন এক আনন্দ উৎসবও রয়েছে, যে আনন্দে সমস্ত বিশ্বজগৎ শরীক হয়, যে খুশীতে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলাও শরীক আছেন এবং যে আনন্দের সারিতে তাঁর সমস্ত ফেরেশতা, নবীগণ, পুণ্যাত্মা বান্দাগণ এবং সব মুসলমানও শরীক আছেন, তা হলো আজকের এ পবিত্র দিন ১২ই রবিউল আউয়াল শরীফের ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর খুশী। এটা এমন এক খুশী উদ্যাপনের দিন, যে দিনের তুলনা হয় না।
সর্বপ্রথম আল্লাহ্ তা‘আলা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র ‘মীলাদ’ পালন উপলক্ষে নবীগণকে একত্রিত করে তাঁদের উদ্দেশে এরশাদ করলেন, (যেমন পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হচ্ছে,) ‘‘যখন আল্লাহ্ তা‘আলা সকল নবী থেকে এ মর্মে অঙ্গীকার নিলেন যে, ‘যখন তোমাদের মধ্যে আমার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শুভ পদার্পণ করবেন আর তোমরা যদি তাঁর যুগ পাও, তবে তোমাদের উচিত হবে তাঁর উপর ঈমান আনা ও তাঁকে সাহায্য করা।’’ তখন একবাক্যে সকল নবী ‘হাঁ’ বলে এ অঙ্গীকার স্বীকার করে নেন। সুতরাং সর্বপ্রথম আল্লাহ্ তা‘আলাই সব নবী ও ফেরেশতাদের নিয়ে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম দিবস তথা পবিত্র মীলাদের আলোচনা করে মীলাদুন্নবী পালন করেন।
হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম আপন পুত্র হযরত শীস আলায়হিস্ সালামকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘‘যদি তোমার উপর কোন প্রকারের দুঃখ-দুর্দশা আসে, তখন তুমি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে স্মরণ করে আল্লাহর দরবারে ইস্তিগফার পড়বে। তেমনিভাবে হযরত ইবরাহীম আলায়হিস্ সালাম প্রার্থনা করেছেন- ‘‘হে আমাদের রব! তাঁদের (ইসমাঈলের বংশ) থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করুন।’’ (এটা ক্ববূল হয়েছে।) তাই প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “আমি হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামের দো‘আ-প্রার্থনার ফসল।’’
সকল নবী ও রাসূল আপন আপন উম্মতকে বলেছেন, ‘‘যদি তোমরা ওই মহা মর্যাদাবান রাসূলের যুগ পাও, তখন তোমাদের উচিত হবে তাঁর (রিসালতের) উপর ঈমান আনা এবং তাঁকে সাহায্য করা। সবশেষে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম আপন উম্মতের প্রতি শুভ সংবাদ দিয়ে গেছেন, ‘আমার পর একজন রাসূল আসবেন, যাঁর নাম হবে আহমদ।’
এভাবে সকল নবী স্ব স্ব যুগে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ধরা বুকে শুভ পদার্পণ করবেন বলে সুসংবাদ প্রদানের মাধ্যমে মীলাদুন্নবী তথা নবীর জন্ম উৎসব পালন করে যান। তাঁর শুভাগমনের কথা প্রচার করে যান। তাছাড়া, আল্লাহ্ তা‘আলা পবিত্র ক্বোরআনের বিভিন্ন স্থানে এভাবে এরশাদ করেছেন, ((নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নূর (জ্যোতি) এবং সুস্পষ্ট গ্রন্থ (ক্বোরআন) এসেছে।)) ((নিশ্চয় তোমাদের মধ্য থেকে এক মহান রাসূলের শুভাগমন হয়েছে।)) ইত্যাদি। এভাবে কোরআনে করীমে হুযূর-ই আক্রামের মীলাদের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
আর হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামও নিজের মীলাদের বর্ণনা নিজেই করেছেন। যেমন তিনি এরশাদ করেছেন- ‘আমি হযরত ইবরাহীম আলায়হিস্ সালামের দো‘আ।’ (আনা দা’ওয়াতু ইব্রাহী-মা, অর্থাৎ তিনি দো‘আ করেছিলেন, ‘হে আমাদের রব, তাদের মধ্যে একজন মহান রসূল প্রেরণ করো…)। আর আমি হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালামের শুভ সংবাদ। (ওয়া বাশা-রতু ঈসা…, অর্থাৎ এবং হযরত ঈসার সুসংবাদ, যা তিনি তাঁর উম্মতদেরকে প্রদান করেছিলেন।)’
সুতরাং বুঝা গেলো যে, এ মীলাদ মোবারক (নবীর জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা ইত্যাদি) আল্লাহ তা‘আলার যেমন সুন্নাত, তেমনি সমস্ত ফিরিশতা, সমস্ত নবী এবং মুসলমানদেরও সুন্নাত। সকল সম্মানিত সাহাবীরও সুন্নাত। এমন কোন কাজ নেই, যাতে সকলে শামিল আছেন। এটা আল্লাহর বিশেষ দয়া যে, এ পবিত্র মীলাদে স্বয়ং ¯্রষ্টা যেমন শামিল আছেন, তেমনি সমস্ত সৃষ্টিজগৎও শামিল আছে। আল্লাহরই জন্য সমস্ত প্রশংসা।
পক্ষান্তরে, একমাত্র অভিশপ্ত শয়তান ছাড়া সবাই এ দিনে খুশী প্রকাশ করেছে, বরং মীলাদ-ই পাকের সময় সব ফেরেশতা কাতারে কাতারে হযরত আমেনার আঙ্গিনায় নবী করীমকে সম্ভাষণ জানাতে ছুটে যান এবং দুনিয়ায় নবীর শুভাগমনের জন্য শোকরিয়া আদায় করেন।
আজ যে সব ভাই মীলাদুন্নবী তথা ধরাবুকে নবীর শুভাগমন দিবসে খুশী উদ্যাপন করার জন্য দলে দলে জুলূসে যোগদান করেছেন এবং অকাতরে নবীর প্রেমে নিজেদের প্রাণ উজাড় করে ধন-সম্পদ উৎসর্গ করেছেন- আল্লাহ্ তা‘আলা সবই কবুল করুন।
আর আপনাদের এ ক্বোরবানীর জন্য আমরা কিভাবে শোকরিয়া আদায় করবো? দো‘আ করিÑ আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের সবার চেষ্টাও পরিশ্রমকে ক্বুবুল করুন! আ-মী-ন। এবং আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক (ওয়াস্ সালাম)।
নূরানী তাক্বরীর-চৌদ্দ
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
اِنَّ اللّٰهَ وَ مَلٰٓىٕكَتَهٗ یُصَلُّوْنَ عَلَى النَّبِیِّؕ-یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا صَلُّوْا عَلَیْهِ وَ سَلِّمُوْا تَسْلِیْمًا
তরজমা: নিশ্চয় আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশ্তাগণ দুরূদ প্রেরণ করেন ওই অদৃশ্য বক্তা (নবী)’র প্রতি, হে ঈমানদারগণ, তাঁর প্রতি দুরূদ ও খুব সালাম প্রেরণ করো। [সূরা আহ্যাব : আয়াত ৫৬, কানযুল ঈমান]
এ আয়াতে চমৎকার বিষয় রয়েছে। তা হচ্ছে- আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, নির্দেশ দিয়েছেন Ñ নামায পড়ো, রোযা রাখো, যাকাত দাও, এটা করো, ওটা করো ইত্যাদি; কিন্তু দুরূদ শরীফের বেলায় বলেছেন, এ দুরূদ শরীফ আমি (আল্লাহ)ও পাঠ করি, আর আমার ফেরেশতারাও পাঠ করে। হে মু’মিনগণ! তোমরাও নিজেদের আক্বা (মালিক) হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দুরূদ শরীফের হাদিয়া প্রেরণ করো। এ দুরূদ পাঠের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর ফিরিশতাগণ এবং মু’মিন বান্দাগণÑ সবাই শামিল রয়েছেন। এমন কোন কাজ নেই, যা আল্লাহও করেন আবার বান্দারাও করেন। আল্লাহ্র যে কাজ তা’ আমরা কখনো করতে পারিনা। তিনি তো সৃষ্টিকর্তা, রিয্ক্বদাতা। আর আমাদের কাজ হলো তাঁর ইবাদত, আনুগত্য করা। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের এসব কাজ থেকে পবিত্র। অবশ্য, যদি এমন কোন কাজ থাকে, যা আল্লাহ্ও করেন ও ফেরেশতাগণও করেন এবং মু’মিনগণকেও করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, তা শুধু হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করা।
স্মর্তব্য যে, আল্লাহ তা‘আলার দুরূদ শরীফ পড়ার অর্থ হলো তাঁর প্রিয় হবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর রহমত বর্ষণ করা। আর ফেরেশতাদের দুরূদ পাঠ করার অর্থ হলো-রহমতের প্রার্থনা করা।
হযরত উবাই বিন কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে হাদীস বর্ণিত, তিনি প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে আরয করলেন, ‘‘হে আল্লাহ্র রাসূল, আমি আপনার উপর দরূদ শরীফ পাঠ করতে কতটুকু সময় নির্ধারণ করতে পারি?’’ হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, ‘‘যতটুকু ইচ্ছা ততটুকু সময় নির্ধারণ করো।’’ আমি আরয করলাম, ‘‘এক চতুর্থাংশ সময়। অর্থাৎ তিনভাগ অন্যান্য দো’আ, ওযীফা ইত্যাদি পড়বো আর এক ভাগ দুরূদ শরীফ পড়বো।’’ হুযূর এরশাদ করলেন, ‘‘তোমার খুশী, হ্যাঁ যদি আরো বেশী করো, তবে তোমার জন্য উত্তম হবে।’’ আমি আরয্ করলাম, ‘‘অর্ধেক সময়।’’ হুযূর এরশাদ করলেন, ‘‘তোমার ইচ্ছা, তবে যদি আরো বেশী করে দুরূদ শরীফ পাঠ করো, তবে তোমার জন্য উত্তম হবে।’’ আমি আরয করলাম, ‘‘দু’ তৃতীয়াংশ সময়। ‘‘হুযূর এরশাদ করলেন, ‘‘তা তোমার ইচ্ছাধীন। হ্যাঁ, যদি এর চেয়েও বেশী করো, তবে তোমার জন্য উত্তম হবে।’’
আমি আরয করলাম, ‘‘হুযূর! সম্পূর্ণ সময়টুকুই দুরূদ শরীফ পড়বো। অর্থাৎ অন্য দো’আ-ওযীফা ইত্যাদির স্থলে কেবল দুরূদ শরীফই পড়বো।’’
তখন হুযূর রহমতে আলম এরশাদ করলেন, “এখন ঠিক আছে, যদি এমন করো, তবে এ দুরূদ শরীফ তোমার যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশা লাঘব, তোমার (ধর্মীয় ও পার্থিব বিষয়ে) সাফল্য লাভ এবং তোমার সমস্ত পাপ মোচনের জন্য যথেষ্ট হবে।” [তিরমিযী]
আরো বর্ণিত আছে, যে কেউ একবার হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দুরূদ শরীফ প্রেরণ করবে, আল্লাহ্ তা‘আলা তার উপর দশটি রহমত বর্ষণ করেন, তার দশটি পাপ মার্জনা হয় এবং তার দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। সুতরাং আপনারা এটা হতে অনুমান করুন, যে ব্যক্তি প্রতিদিন এক হাজারবার দুরূদ শরীফ পাঠ করে, সে কতো পরিমাণ পুণ্যের অধিকারী হচ্ছে।
ইমাম সুফিয়ান সাওরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, আমি হজ্জের সময় এক যুবককে প্রত্যেক পুণ্যময় স্থানে দুরূদ শরীফ পাঠ করছে (অথচ হজ্জে প্রতিটি স্থানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দো’আ ও যিক্রের নিয়ম বর্ণিত আছে;) তাকে বললাম, ‘‘হে যুবক, তুমি প্রত্যেক স্থানে শুধু দুরূদ শরীফই পাঠ করছো কেন?’’ সে আরয করলো, হুযূর আমি হজ্জ্ব করার জন্য এক কাফেলার সাথে বের হলাম।
আমার সাথে আমার পিতাও ছিলেন। পথিমধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং মারা যান। তার চেহারাও বিকৃত হয়ে গেলো। এখন আমি এ একাকী অবস্থায় কী করবো দিশেহারা হয়ে পড়ি। আমি তখন কাঁদতে থাকি। কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখে ঘুম এসে গেলো। স্বপ্নে আমি নুরানী আকৃতির এক মহান ব্যক্তিকে আসতে দেখি। তিনি এসে তাঁর নুরানী হাত আমার পিতার চেহারায় রাখলেন। অমনি আমার পিতার চেহারা চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে গেলো। আমি ওই আগন্তক বুযুর্গের দরবারে আরয করলাম, “হযরত, আপনি কে? এ আমার এ দুর্দশার সময় আমাকে সাহায্য করলেন?” তিনি বললেন, “আমি আল্লাহর রাসূল। তোমার পিতা প্রতিদিন আমার উপর দুরূদ শরীফ প্রেরণ করতো। (এ কারণে আজ তোমাদের এ অসহায়ত্বের সময় আমি রসূল তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছি।)”
বস্তুতঃ দুরূদ শরীফ সমস্ত বিপদাপদ ও দুঃখ-দুর্দশা দুরীভূতকরণের উত্তম উপায়। তাই তা তোমাদের দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করুন!। বাতিল ফির্ক্বার লোকেরা এ কুমন্ত্রণা দিয়ে বেড়ায় যে, অমুক দুরূদ শরীফ পড়বে, অমুক দুরূদ শরীফ পাঠ করবেনা। দুরূদ-ই ইব্রাহীমী দলীল প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত। অন্য সব দুরূদ পড়া না-জায়েয ইত্যাদি। এটা বলা তাদের মূর্খতার পরিচায়ক। দুরূদ শরীফ যা-ই হোক না কেন, তা পড়লে সাওয়াব পাওয়া যাবে। আপনারা কি দেখেননা যে, ওলামায়ে কেরাম হাদীস শরীফ অধ্যয়ন করার সময় বলে থাকেন, ‘ক্বা-লা, ক্বা-লা রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’। যদি এ দুরূদ শরীফ পড়া নিষেধ হতো, তবে এখানেও সম্মানিত ওলামা ‘দুরূদ-এ ইব্রাহীমী’ পাঠ করতেন।
তাছাড়া, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার উপর দুরূদ পাঠ করে, তা আমার দরবারে (ফেরেশ্তা কর্তৃক) পৌঁছানোও হয়। এটার অর্থ এ নয় যে, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উম্মতের দুরূদ শুনেন না; বরং (অন্য বর্ণনামতে) তিনি আমাদের দুরূদ শরীফ শুনেন।
যেমন দেখুন, আমাদের আমলসমুহ আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। তাই বলে কি আল্লাহ আমাদের আমলসমূহের ব্যাপারে বে-খবর? তা কখনো না। এটা একটা ব্যবস্থাপনা মাত্র।
বস্তুতঃ হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের কথা, কাজ সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন। তিনি প্রতিটি স্থানে ‘হাযির-নাযির’। যেমন এরশাদ হচ্ছে, “আন্ নবিয়্যু আওলা- বিল মু’মিনী-না মিন আন্ফুসিহিম।” অর্থাৎ হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মু’মিনদের প্রাণের চেয়েও নিকটে। এটাই ঈমান (বিশ্বাস) রাখুন। আল্লাহ আমাদের সকলকে বুঝার তাওফীক্ব দিন। আ-মী-ন।
নূরানী তাক্বরীর-পনের
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُقَدِّمُوْا بَیْنَ یَدَیِ اللّٰهِ وَ رَسُوْلِهٖ وَ اتَّقُوا اللّٰهَؕ-اِنَّ اللّٰهَ سَمِیْعٌ عَلِیْمٌ(۱) یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَرْفَعُوْۤا اَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِیِّ وَ لَا تَجْهَرُوْا لَهٗ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ اَنْ تَحْبَطَ اَعْمَالُكُمْ وَ اَنْتُمْ لَا تَشْعُرُوْنَ(۲) اِنَّ الَّذِیْنَ یَغُضُّوْنَ اَصْوَاتَهُمْ عِنْدَ رَسُوْلِ اللّٰهِ اُولٰٓىٕكَ الَّذِیْنَ امْتَحَنَ اللّٰهُ قُلُوْبَهُمْ لِلتَّقْوٰىؕ-لَهُمْ مَّغْفِرَةٌ وَّ اَجْرٌ عَظِیْمٌ(۳) اِنَّ الَّذِیْنَ یُنَادُوْنَكَ مِنْ وَّرَآءِ الْحُجُرٰتِ اَكْثَرُهُمْ لَا یَعْقِلُوْنَ(۴) وَ لَوْ اَنَّهُمْ صَبَرُوْا حَتّٰى تَخْرُ جَ اِلَیْهِمْ لَكَانَ خَیْرًا لَّهُمْؕ-وَ اللّٰهُ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ(۵)
তরজমা : ১. হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আগে অগ্রসর হয়ো না, আল্লাহ্কে ভয় করো। আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা (সবকিছু) শুনেন ও জানেন।
২. হে ঈমানদারগণ, নিজেদের কণ্ঠস্বরকে উঁচু করো না ওই অদৃশ্যের সংবাদাদাতা (নবী)-এর কণ্ঠস্বরের উপর এবং তাঁর সামনে চিৎকার করে কথা বলো না যেভাবে পরস্পরের মধ্যে একে অপরের সামনে চিৎকার করো যেন কখনো তোমাদের কর্মসমূহ নিষ্ফল না হয়ে যায় আর তোমাদের খবরই থাকবে না।
৩. নিশ্চয় ওই সমস্ত লোক, যারা আপন কণ্ঠস্বরকে নিচু রাখে আল্লাহর রসূলের নিকট, তারা হচ্ছে ওইসব লোক, যাদের অন্তরকে আল্লাহ্ তা‘আলা খোদাভীরুতার জন্য পরীক্ষা করে নিয়েছেন। তাদের জন্য ক্ষমা ও মহা পুরস্কার রয়েছে।
৪. নিশ্চয় ওইসব লোক, যারা আপনাকে হুজুরাসমূহের বাইরে থেকে আহ্বান করে তাদের মধ্যে অধিকাংশই নির্বোধ।
৫. এবং যদি তারা ধৈর্যধারণ করতো যতক্ষণ না আপনি তাদের নিকট তাশরীফ আনয়ন করতেন, তবে তা তাদের জন্য উত্তম ছিলো; এবং আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, দয়ালু। [সূরা হুজুরাত: আয়াত-১-৫, কানযুল ঈমান]
সুবহা-নাল্লাহ্! এ বরকতময় আয়াতে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা মু’মিনদেরকে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের প্রতি সম্মান ও আদব প্রদর্শনের শিক্ষা দিচ্ছেন- (এভাবে যে,) এ দরবারে এ পদ্ধতিতে এসো, এ মহাসম্মানিত রসূলকে এভাবে সম্মান করো তাঁকে এরূপ আদব করো। তোমাদের অন্তরে যদি আদব থাকে তাহলে আদবের সাথে তাঁর প্রতি মুহব্বত (হৃদয়ে) ওঁতপ্রোতভাবে জড়িত। রসূলের প্রতি ভালোবাসা আসলে হৃদয় আবাদ হবে। আর তোমাদের অন্তরে মুহাব্বতের চেরাগ জ্বলে উঠবে, তখন আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার সান্নিধ্য পাওয়ার পথও তোমাদের জন্য উজ্জ্বল বা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
এখানে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা আমাদেরকে (তাঁর রসূলের প্রতি) আদব ও ভালবাসার শিক্ষা দিচ্ছেন আর এরশাদ করছেন, আল্লাহ্ ও রসূলের আগে যাবেনা, আগে অগ্রসর হয়ো না। এটা বলেন নি, কোন্ বিষয়ে আগে যেওনা; বরং দুনিয়ার যে কোন ব্যাপারে। অর্থ এ যে, দুনিয়ার কোন কাজে, কোন ব্যাপারে আল্লাহ্ ও রাসূলের আগে বাড়বে না। আগে যেওনা, এখানে দ্বিতীয় লক্ষণীয় বিষয় এও রয়েছে যে, আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার আগে তো কেউ যেতে পারে না। তাই এখানে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আগে অগ্রসর হওয়াকেই আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর নিজের আগে অগ্রসর হওয়া বুঝিয়েছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা এখানে নিজের উল্লেখ আগে করেছেন আর এরশাদ করেছেন, রসূলের আগে হওয়া আল্লাহ্র আগে হওয়ার নামান্তর।
একদা হযরত সায়্যিদুনা আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নামায পড়াচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ আনলেন। তখনই হযরত আবূ বকর পেছনে সরে আসলেন। কেননা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপস্থিতিতে সমস্ত ইমামের ইমামতি রহিত, নবীগণের নুবূওয়তের কার্যকারিতা রহিত, রসূলগণের রেসালতের কার্যকারিতা রহিত। অতএব, তিনি (হযরত আবূ বকর হুযূর-ই আকরামের আগে) নামায কীভাবে পড়াতে পারেন? হাঁ যদি হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কাউকে ইমাম হওয়ার নির্দেশ দেন, তবে তিনি ইমাম হতে পারেন। এ ছাড়া হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপস্থিতিতে কেউই নামায পড়াতে পারে না।
এ বিধান সর্ব বিষয়ে প্রযোজ্য। তেমনি দুনিয়ার সকল কাজকর্মের ব্যাপারে যদি কোন সরকারের আদালত কোন প্রকারের বিচার করে, তবে তাকে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের এ বিধি-বিধান, এ শরীয়তের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিৎ। (অর্থাৎ বিচারকার্য যেন শরীয়তের অনুরূপ হয়।) আমাদের কোন মীমাংসা ও আইন-কানূন যেন আল্লাহ্ ও রসূলের বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়। তাই বিচারক বা জজের এমনভাবে ফায়সালা করা উচিৎ যেন তা শরীয়তের বিরোধী না হয়। এখানে এ আয়াতের মধ্যে দুনিয়ার সব বিষয় এসে গেছে। সুতরাং এর কোনটাতে কেউ যেন আল্লাহ্ ও রাসূলের আগে না বাড়ে।
আল্লাহ্ তা‘আলার এ কিতাব ক্বোরআন মজীদ আর হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের উপর চলার জন্য পরিপূর্ণরূপে চেষ্টা করে যাও; আর নিছক নিজের পক্ষ হতে কোন প্রকারের মীমাংসা করতে যেও না।
তারপর এটা ইরশাদ হলো যে, হে ঈমানদারগণ! রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মুখে নিজেদের কণ্ঠস্বরকে তাঁর কণ্ঠস্বর থেকে উঁচু করো না। আর তাঁর সামনে নিজেদের আওয়াজকে অধিকতর উঁচু করো না। আর তাঁর সামনে জোরে জোরে কথা বলো না, তাঁর সম্মুখে উচ্চস্বরে কথা বলো না যেভাবে তোমরা একে অপরের সাথে উঁচুস্বরে কথা বলে থাকো। এভাবে আমার হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে এসে উঁচুস্বরে কথা বলো না কখনো আবার তোমাদের অজ্ঞাতসারে তোমাদের আমলসমূহ বিনষ্ট হয়ে যায় কিনা, যেন তোমাদের পুণ্যকর্মগুলো বরবাদ হয়ে না যায়। সুবহা-নাল্লাহ্।
যখন এ আয়াত শরীফ অবতীর্ণ হলো, তখন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব ও হযরত ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা নিচুস্বরে কথা বলতে শুরু করলেন। রসূলে পাকের দরবারে উঁচু স্বরে কথা বলা ঈমান হতে হাত ধোয়ার নামান্তর। তাঁরা এতো নিচু স্বরে কথা বলতে শুরু করলেন যে, অনেক সময় হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে পুনর্বার জিজ্ঞাসা করে নিতে হতো তোমরা কী বলছো? এভাবে (হুযূরের দরবারে) নিচুস্বরে কথা বলা সাহাবীরা নিজেদের অভ্যাসে পরিণত করে নিলেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু শপথ করে বসলেন যে, যতক্ষণ আমার দেহে প্রাণ থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সম্মুখে কখনো উঁচুস্বরে কথা বলবো না; বরং যখন হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে প্রতিনিধি দল আসতো, তখন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাদেরকে (নবীর দরবারের আদব শিক্ষা দেয়ার জন্য) কতেক সাহাবীকে নিযুক্ত করলেন, যেন তাঁরা তাদেরকে বুঝান যে, এভাবে রসূলের দরবারে এসো, এভাবে নবীর সাথে কথা বলো।
ক্বায়স ইবনে সাবিত নামে জনৈক সাহাবীর কণ্ঠস্বর স্বভাবত উঁচু ছিলো। তিনি নবীর দরবারে উচুঁস্বরে কথা বলতেন। যখন এ আয়াত শরীফ অবতীর্ণ হলো, তখন তিনি তাঁর ঘরের দরজা বন্ধ করে কান্না আরম্ভ করে দিলেন। আর বলতে লাগলেন, এ আয়াত তো আমার প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে। কেননা, আমিই তো রাসূলের দরবারে উঁচুস্বরে কথা বলতাম। এ ভয়ে তিনি দু’দিন পর্যন্ত নবীর দরবারে যাওয়া হতে বিরত রইলেন।
তাঁকে না দেখে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘সাবিত ইবনে ক্বায়স কোথায়? তাকে দেখা যাচ্ছে না!’ লোকেরা আরয করলেন, ‘‘হুযূর! তিনি তো ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদছেন।’’ হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘যাও, তাঁকে ডেকে নিয়ে এসো।’’ সাবিত ইবনে ক্বায়স যখন হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে আসলেন, তখন হুযূর করীম বললেন, ‘‘কি হলো, তোমাকে দেখা যাচ্ছে না?’’ তিনি বললেন, “হে আল্লাহর রসূল! আমি তো ধ্বংস হয়ে গেছি, বরবাদ হয়ে গেছি, এ আয়াত তো আমার প্রসঙ্গে এসেছে। আমিই তো এ দরবারে উঁচু স্বরে কথা বলি।’’ হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সান্ত¦না দিয়ে বললেন, ‘‘না, তোমার জীবন সাফল্যমন্ডিত। তুমি শাহাদতের মৃত্যু পাবে, তোমার ভাগ্যে জান্নাত রয়েছে।’’ এটা কি তোমার জন্য উত্তম নয়? এতে কি তুমি সন্তুষ্ট নও?’’ তিনি বললেন, ‘‘হ্যাঁ, সন্তুষ্ট আছি, হে আল্লাহর রসূল!’’ এভাবে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সান্ত¦না দিলেন।
যখন (ভন্ড নবী) মুসায়লামা কায্যাব-এর সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ হলো, তখন ওই যুদ্ধে হযরত সাবিত ইবনে ক্বায়সও শহীদ হন।
এরপর রাতে এক ব্যক্তি তাঁকে স্বপ্নে দেখলেন। তিনি বলছিলেন, ‘‘তুমি গিয়ে (সেনাপতি) খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে বলো, ‘‘আমার শরীরে এক যুদ্ধবস্ত্র ছিল, অমুখ ব্যক্তি (আমার শাহাদাতের পর) তা চুরি করে নিয়ে গেছে। সে এ ময়দানের শেষ প্রান্তে তাঁবুতেই আছে, সেখানে আমার যুদ্ধবস্ত্রটিও আছে। আর এ যুদ্ধবস্ত্রটা যেন আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর কাছে পৌঁছানো হয়। আমার উপর অমুক অমুকের ঋণ আছে। তিনি যেন তা পরিশোধ করার ব্যবস্থা করেন। আর আমার একথাগুলোকে নিছক স্বপ্ন মনে করো না, বরং এতে সুদৃঢ় আস্থা রেখো।’’ সুতরাং ওই ব্যক্তি পরদিন ভোরে হযরত খালিদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর কাছে গিয়ে বললেন, ‘‘হুযূর, সাবিত ইবনে ক্বায়সকে আমি গত রাতে স্বপ্নে দেখেছি এবং তাঁকে এসব বলতে শুনেছি।’’ তখন হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালীদ স্বপ্নে নির্দেশিত স্থান হতে তাঁর যুদ্ধবস্ত্রটা তালাশ করে উদ্ধার করলেন। (এবং বাক্বী কাজগুলোও সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করেন।)
এভাবে এ আয়াত শরীফ অবতীর্ণ হওয়ার পর সাহাবা-ই কেরামের এ অবস্থা দাঁড়ালো যে, তাঁরা সবাই নবীর দরবারে নিচু স্বরে কথা বলা আরম্ভ করলেন, তখন আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করলেন- ‘নিশ্চয় এসব লোক রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে কথা বলার সময় নিজেদের কণ্ঠস্বরকে নিচু করে থাকে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের হৃদয়সমূহে খোদাভীতির পরীক্ষা নিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার। মহা প্রতিদান তাদেরকে প্রদান করা হবে, যারা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে নিচুস্বরে কথা বলে এবং আদব বজায় রাখে।
যখন তামীম গোত্রের প্রতিনিধি দল হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে আসলো, তখন হুযূর করীম ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেলেন। তারা ঘরের বাইরে থেকে ‘হে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম), আমাদের মধ্যে আসুন’ বলে উচ্চস্বরে ডাকতে আরম্ভ করে দিলো। তখন আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এ আয়াত শরীফ অবতীর্ণ করলেন-‘‘নিশ্চয় যারা আপনাকে বাইরে থেকে ডাকছে, তাদের মধ্যে অধিকাংশ নির্বোধ। তারা যদি ধৈর্যধারণ করতো, যতক্ষণ না আপনি স্বেচ্ছায় তাদের মধ্যে তাশরীফ নিয়ে যেতেন, তবে এটা তাদের জন্য মঙ্গলময় হতো। আর আল্লাহ্ মহা ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’’
পক্ষান্তরে, যাঁরা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শানে শালীনতাবিবর্জিত কথা বলে, তারা নির্বোধ। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে ‘নির্বোধ’ বলেছেন। সুতরাং যারা রসূলের মিম্বরে বসে রসূলের প্রতি অশালীন উক্তি করে, তারা আদব ও মুহাব্বত এবং শিরকের মধ্যে পার্থক্য করে না এবং রসূলের প্রতি আদব ও মুহব্বত প্রদর্শন করাকে র্শিক বলে থাকে। আমরা তো হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি আদব ও মুহব্বত প্রদর্শনকে ঈমানের প্রাণ বলে থাকি।
এ আয়াতের মধ্যে চিন্তা করে দেখুন যে, আল্লাহ্ তা‘আলা এ দরবারের কী আদব ও মুহব্বত শিক্ষা দিচ্ছেন! এ দরবারকে ভালবাসো, এটার প্রতি আদব করো। যদি তুমি আদব করো, তবে তোমার এ মর্যাদা অর্জিত হবে। যেমনটি সাবিত ইবনে ক্বায়স-এর অর্জিত হয়েছে। আর যদি বে-আদবী করো, তবে পরিণাম হবে মন্দ। আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা আমাকে আপনাদেরকে বুঝার তৌফীক্ব দিন। আর ওইসব নির্বোধ থেকে মুসলমানদেরকে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা রক্ষা করুন। আ-মী-ন।
নূরানী তাক্বরীর-ষোল
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
وَ الضُّحٰىۙ(۱) وَ الَّیْلِ اِذَا سَجٰىۙ(۲) مَا وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَ مَا قَلٰىؕ(۳) وَ لَلْاٰخِرَةُ خَیْرٌ لَّكَ مِنَ الْاُوْلٰىؕ(۴) وَ لَسَوْفَ یُعْطِیْكَ رَبُّكَ فَتَرْضٰىؕ(۵) اَلَمْ یَجِدْكَ یَتِیْمًا فَاٰوٰى۪(۶) وَ وَجَدَكَ ضَآلًّا فَهَدٰى۪(۷) وَ وَجَدَكَ عَآىٕلًا فَاَغْنٰىؕ(۸) فَاَمَّا الْیَتِیْمَ فَلَا تَقْهَرْؕ(۹) وَ اَمَّا السَّآىٕلَ فَلَا تَنْهَرْؕ(۱۰) وَ اَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ۠(۱۱)
তরজমা:
১. চাশ্ত (পূর্বাহ্ণ)-এর শপথ; ২. এবং রাতের, যখন পর্দা-আবৃত করে। ৩. আপনার প্রতিপালক আপনাকে পরিত্যাগ করেননি এবং অপছন্দও করেননি। ৪. এবং নিশ্চয় পরবর্তী জীবন আপনার জন্য পূর্ববর্তী জীবন অপেক্ষা উত্তম। ৫. এবং নিশ্চয় অচিরে আপনার প্রতিপালক আপনাকে এ পরিমাণ দেবেন যে, আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। [সূরা ওয়াদ্ব্দ্বোহা: আয়াত-১-৫: কানযুল ঈমান]
এ পবিত্র সূরার শানে নুযূল বা অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট হলো এ যে, এক সময় কিছু দিন কিছু কাল ওহী আসা বন্ধ ছিলো। এতে কাফিরগণ অত্যন্ত আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠলো। আর হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে (ঠাট্টা স্বরূপ) বলতে লাগলো, ‘আল্লাহ্ তাঁর উপর নারায হয়ে গেছেন এবং তাঁকে ছেড়ে দিয়েছেন।’ এ ধরনের নানা কথা তারা বলতে লাগলো। আবূ লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল এ বলে খোঁচা দিলো, ‘আপনার সাথে যে জিন্টি ছিলো তা এখন আপনাকে ছেড়ে দিয়েছে।’ তারা এ ধরনের ধৃষ্টতাপূর্ণ বাক্য ব্যবহার করছিলো। তখন আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা (তাদের খন্ডনে) এ সূরা অবতীর্ণ করলেন। (আর এরশাদ করলেন) শপথ উজ্জ্বল দিবালোকের আর রজনীর, যখন তা হয় বিঝুম ও নিশ্চল। আপনার রব আপনাকে পরিত্যাগ করেননি, না আপনার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। আর আপনার ভবিষ্যতে আগত প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ক্ষণ, পূর্ববতী সময় ও মুহূর্ত হতে শ্রেয় ও উত্তম। আর অচিরেই আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে এতবেশী (কল্যাণ) দান করবেন যে, তাতে আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। সুবহা-নাল্লাহ্।
‘ওয়াদ্ব-দ্বোহা’ মানে এখানে তাঁর (রসূল-ই করীম) সমুজ্জ্বল মুখমন্ডল। অর্থাৎ তাঁর (রসূলের) উজ্জ্বল চেহরা মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো চমকাচ্ছে। আর ‘রজনী’ (ওয়াল লায়লি) দ্বারা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যুল্ফি মুবারক (চেহারা শরীফের দু’দিকে ঝুলন্ত চুল মুবারক) বুঝানো হয়েছে। সুতরাং (আয়াতের) অর্থ এ দাঁড়ায় যে, ‘তাঁর দ্বীপ্তিময় চেহারার শপথ এবং তাঁর নূরানী যুল্ফি মুবারকের শপথ!
আর কতেক ব্যাখ্যাকারক এটাও বলেছেন যে, ‘আদ্ব্্ দ্বোহা’ দ্বারা ওই সময় বুঝানো উদ্দেশ্য, যখন হযরত মূসা আলায়হিস সালাম তাঁর লাঠি (ফির‘আউনের) যাদুকরদের যতো যাদু ছিলো সব খেয়ে ফেলেছিলো। তাছাড়া, তাঁরা এও বলেছেন যে, ‘দ্বোহা’ মানে বিশেষত চাশ্তের সময়।
যেমন (পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে) ‘যে দিন পূর্বাহ্নে আমি সমস্ত মানুষকে সমবেত করবো।’ আর ‘রাত’ (ওয়াল্ লায়লি) সম্পর্কে এও বলেন যেন, এখানে রাত’ মানে ‘মি’রাজ রজনী’।
যা হোক! আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারে কতেক শপথ করে তাঁকে এ বলে শান্ত ¦না দিলেন যে, ‘আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা না আপনাকে পরিত্যাগ করেছেন, না আপনার প্রতি তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন।’ (কিছু কাল আপনার প্রতি) ওহী আসা বন্ধ হওয়া, ওহী না আসার মধ্যেও (আল্লাহ্র) শত শত হিকমত আছে। কিছু দিনের জন্য ওহী আসা বন্ধ হওয়ার মধ্যে আল্লাহ্ তা‘আলার হাজারো রহস্য নিহিত আছে। এতে আপনার পেরেশান হওয়ার কারণ নেই। আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা আপনার উপর না অসন্তুষ্ট হয়েছেন, না আপনাকে ছেড়ে দিয়েছেন।
‘ওয়া লাল্ আ-খিরাতু খায়রুল লাকা মিনাল ঊ-লা’Ñ আর আপনার আগত প্রতিটি মুহূর্ত ও সময়, পূর্ববতী সময় হতে উত্তম ও শ্রেয়। ‘ওয়ালা সাউফা ইয়ু’ত্বীকা রাব্বুকা ফাতারদ্বা-।’ এবং আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা আপনাকে এতো বেশী (কল্যাণ) প্রদান করবেন যে, তাতে আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। সুবহা-নাল্লাহ!
অবাক হবার মতো বিষয় যে, উক্ত আয়াতগুলোতে দেখুন, চিন্তা ও অনুধাবন করুন যে, এখানে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধনকারী, অথচ কাফিরগণই তাঁর প্রতি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলো। কতই মর্যাদা ও রহস্যময় ব্যাপার যে, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারে ধারণা ও কল্পনাই করা যায় না। কারণ, মর্যাদা ও মহত্বের ক্ষেত্রে, কাফিরগণ (হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারে) বাদানুবাদ করলো; অথচ এর জবাব দিচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা। আর হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সত্ত্বার শপথ করে বলেছেন, ‘‘আপনাকে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা না ছেড়ে দিয়েছেন, না তিনি আপনার প্রতি বিরাগভাজন। আর অনতিবিলম্বে তিনি আপনাকে এতবেশী প্রদান করবেন যে, আপনি সন্তুষ্টি হয়ে যাবেন।’’
সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টি চায়, সবাই তাঁকে সন্তুষ্ট করতে চায়; কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সন্তুষ্টি করেছেন। সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহ্ তা‘আলাকে সন্তুষ্টি করছে, আর আল্লাহ্ তা‘আলা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সন্তুষ্টি চাচ্ছেন। এরশাদ করেন, (আপনার) প্রতিপালক আপনাকে এতো প্রচূর (কল্যাণ) দান করবেন যে, আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন।
একদা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ক্রন্দন করছিলেন। এমন সময় আল্লাহ্ তা’আলা জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালামকে কে বললেন, ‘‘গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো আমার হাবীব কেন কাঁদছেন?’’ জিব্রাঈল এসে আরয করলেন, ‘‘হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহ্ তা‘আলা জিজ্ঞাসা করছেন- আপনি কেন কাঁদছেন?’’
উত্তরে রসূল-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘উম্মতের চিন্তায় আমি কাঁদছি।’’ তখন আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করলেন, (জিব্রাঈল!) আমর হাবীবকে গিয়ে বলে দাও যেন উম্মতের জন্য চিন্তিত না হন। যতক্ষণ তিনি সন্তুষ্ট না হবেন, ততক্ষণ আমি তাঁর অসংখ্য উম্মতকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে থাকবো এ পর্যন্ত যে, তিনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। তখন হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘আমি ততক্ষণ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হবো না, যতক্ষণ আমার একজন উম্মতও দোযখে থাকবে।’’
ইমাম বাক্বের রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, ক্বোরআন শরীফের আয়াতগুলোর মধ্যে এ আয়াত অন্য সব লোকের জন্য অতিমাত্রায় গুরুত্ববহ- ‘হে হাবীব! আপনি বলে দিন, হে আমার ওইসব বান্দা, যারা নিজেদের নাফ্সের উপর যুল্ম করেছো, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়োনা। নিশ্চয় আল্লাহ্ সমস্ত পাপ ক্ষমা করেন। নিশ্চয় তিনি মহা ক্ষমাশীল, দয়ালু।’
কিন্তু আমাদের নিকট আমরা আহলে বায়তের নিকট, এ আয়াত শরীফ সর্বাধিক গুরুত্ববহ ‘অবিলম্বে আল্লাহ্ তা‘আলা আপনাকে এত বেশী দান করবেন যে, আপনি তাতে সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন।’’ আল্লাহরই পবিত্রতা!
রাহমাতুল্লিল ‘আ-লামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের উপর কতই দয়ালু, কত বেশী দানশীল, কত বেশী দয়ালু, আমাদের চিন্তায় সর্বদা কেঁদেছেন, আমাদের জন্য কত কষ্ট করেছেন! কিন্তু আমরা বে-খবর। আমাদের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। আল্লাহ তা‘আলা বার বার আমাদেরকে বলছেন- আমার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করো। যদি তোমরা তাঁর অনুসরণ করো, তবে তোমরা আমি মহান স্রষ্টা আল্লাহ্র প্রিয় হয়ে যাবে।
এ জন্য এরশাদ করেছেন-হে হাবীব, আপনি তাদেরকে বলে দিন, যদি আল্লাহকে ভালবাসে, তাহলে আমার অনুসরণ অনুকরণ কর। আমার অনুসরণও আনুগত্য করলে তোমরা আল্লাহ্র প্রিয়পাত্রে পরিণত হবে।’
এ জন্য আমাদেরকে এ সিলসিলার অন্তর্ভূক্ত হওয়া জরুরী। আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য এ যে, আমরা যেন সঠিক অর্থে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসারী হই এবং হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সত্যিকার গোলাম বনে যাই। আমরা যদি আমাদের মুনিব (হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর হতে পারি, তবে আমাদের কোন প্রকারের দুঃখের কারণ নেই। আসমান ও যমীন যদি দুনিয়াকে চাক্কির মতো পিষেও দেয়, কিন্তু যে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর গভীর সান্নিধ্য অর্জন করে নেয়, তবে দুনিয়ার কোন শক্তি তাকে নাড়তে পারবে না।
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা আমাদেরকে ও আপনাদের সকলকে এ নি’মাত (নবীপ্রেম) দান করুন। আ-মী-ন।
নূরানী তাক্বরীর-সতের
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
اَلَمْ نَشْرَحْ لَكَ صَدْرَكَۙ(۱) وَ وَضَعْنَا عَنْكَ وِزْرَكَۙ(۲) الَّذِیْۤ اَنْقَضَ ظَهْرَكَۙ(۳) وَ رَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَؕ(۴) فَاِنَّ مَعَ الْعُسْرِ یُسْرًاۙ(۵) اِنَّ مَعَ الْعُسْرِ یُسْرًاؕ(۶) فَاِذَا فَرَغْتَ فَانْصَبْۙ(۷)وَ اِلٰى رَبِّكَ فَارْغَبْ۠(۸)
তরজমা:
১. আমি কি আপনার বক্ষকে প্রশস্ত করিনি? ২. আর আপনার উপর থেকে আপনার ওই বোঝা নামিয়ে নিয়েছি, ৩. যা আপনার পৃষ্ঠদেশ ভেঙ্গেছিলো। ৪. আর আমি আপনার জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি। ৫. সুতরাং নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্থি রয়েছে। ৬. নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে। ৭. অতএব, আপনি যখন নামায থেকে অবসর হবেন, তখন দো‘আর মধ্যে পরিশ্রম করুন; ৮. এবং আপন রবের প্রতি মনোনিবেশ করুন। [সূরা ইন্শিরাহ: আয়াত-১-৮; কানযুল ঈমান]
এ সূরা মোবারকে আল্লাহ্ তারাবাকায় ওয়া তা‘আলা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে শান্ত¦না প্রদান করেছেন। এ সূরা তখন অবতীর্ণ হয়েছিল, যখন মক্কা মুর্কারমার প্রতিটি লোক হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শত্র“ ছিলো। প্রত্যেকে তাঁকে কষ্ট দেয়ার জন্য, তাঁকে পেরেশান করার জন্য তৎপর ছিলো। এমনি অবস্থায় আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে শান্ত¦না প্রদান করেন এবং এরশাদ করেন- ‘আমি কি আপনার বক্ষকে প্রশস্ত করিনি? এ যে নুবূতের বোঝা, এযে আমানত, এমনি দায়িত্বভার যমীন ও আসমান বহন করতে পারেনি। এমন আমানতরূপী দায়িত্বভার হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামই বহন করেছেন। কেননা, আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা তাঁর বক্ষ মোবারককে প্রশস্ত করে দিয়েছেন। এ কারণেই তিনি এ মহান দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা ফরমাচ্ছেন যে, ওই দায়িত্বভার, যা তাঁর পৃষ্ঠ মুবারককে ভারী করে দিয়েছিল, এমন মহান যিম্মাদারী, যা তাঁরই উপর দেয়া হয়েছে, তিনি সেটা যথাযথভাবে পালন করেছেন।
আল্লাহ্ তাবারকা ওয়া তা‘আলা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে এরশাদ করেন, আমি কি আপনার জন্য আপনার বক্ষকে প্রশস্ত করিনি? আর আমি আপনার থেকে ওই বোঝা অপসারণ করেছি, যে বোঝা আপনার পৃষ্ঠ ভেঙ্গে দিয়েছিলো (অর্থাৎ যা আপনার জন্য অতিশয় কষ্টদায়ক ছিলো।) ওই ভার আপনার থেকে উঠিয়ে দিয়েছি। সুব্হা-নাল্লাহ্! পবিত্র হাদীসে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বক্ষ বিদারণের যে ঘটনা বর্ণিত আছে তার অর্থ এ যে, আল্লাহ্ তাবারকা ওয়া তা‘আলা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বক্ষ মোবারককে প্রশস্ত করে দিয়েছেন। এ বক্ষ মোবারকে পূর্বাপর সকল জ্ঞান ও হিকমতের সমাবেশ ঘটেছে।
সকল বস্তুর জ্ঞান ও সমস্ত মর্যাদাপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এ বক্ষ মুবারকে সন্নিবিষ্ট হয়েছে। আল্লাহ্র সাথে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ধ্যানমগ্ন হওয়া এবং পার্থিব নানা ব্যস্ততা তাঁর জন্য সহজই ছিলো, কোনরূপ চাপ সৃষ্টিকারী ছিলোনা। অর্থাৎ দুনিয়াবী নানা ব্যস্ততা ও দায়িত্বের কারণে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভে কোন বাধা হতে পারে নি। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একদিকে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত আছেন, অন্যদিকে তাঁর দুনিয়ার সাথেও সম্পর্ক ছিলো।
একদিকে আল্লাহ্র একান্ত সান্নিধ্যপ্রাপ্ত, অপরদিকে সৃষ্টিজগতের সাথেও তাঁর সম্পর্ক অটুট। একদিকে আল্লাহ্র সাথে হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সম্পর্কের তার লাগানো আছে, সেখান হতে প্রতিনিয়তই ওহী আসছে, আর অন্য দিকে তিনি ওই ওহীর জ্ঞান সৃষ্টিকুলকে বিতরণ করছেন। এ দিকে আল্লাহর সাথে ‘ওয়াসিল’ (মিলিত), ওদিকে সৃষ্টিজগতের সাথে ‘শাগিল (ব্যস্ত)। রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেনÑ‘‘আল্লাহ্ দাতা আর আমি তা বিতরণ করি।’’
তাই বক্ষের প্রশস্ততা দ্বারা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এমন সব নি’মাত প্রাপ্ত হন যে, সকল বৈশিষ্ট্য, সকল যাহেরী ও বাত্বেনী জ্ঞান ও হিকমত তাঁর বক্ষ মোবারকে স্থান লাভ করেছে। যদি এ বক্ষ প্রশস্ত করা না হতো তবে এতো মহান মহান দায়িত্বের কষ্ট সহ্য কীভাবে করতেন?
তাই আল্লাহ্ তাবারকা ওয়া তা‘আলা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বক্ষকে প্রশস্ততা দান করে তাতে দুনিয়ার সকল দায়িত্ব ও আমানতের ভার তাঁকে দান করেছেন। বক্ষ প্রশস্ত করার মধ্যে উভয় জগত এসে গেছে। তাতে জাগতিক জ্ঞানও এসে গেছে আর আধ্যাত্মিক জ্ঞানও এসে গেছে।
আর সৃষ্টিকুলের কতজনই হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দুরূদ পড়ছে। সকলের দুরূদ তিনি শ্রবণ করছেন আর সাথে সাথে এর জবাবও দিচ্ছেন। (প্রতিদিন) উম্মতের আমল তাঁর সমীপে পেশ করা হচ্ছে। সৃষ্টিকুলের কোটি কোটি দুরূদ ও সালাম সম্পর্কে তিনি সম্যক খবর রাখেন। আর গোনাহ্গার উম্মতের জন্য আল্লাহ্র দরবারে দো’আ এবং শাফা‘আতও করে যাচ্ছেন। তাই তিনি এদিকে আল্লাহ্র সাথে যেমন সম্পৃক্ত, তেমনি সৃষ্টিজগতের সাথেও তার সম্পর্ক রয়েছে।
তদুপরি, কাফির ও মুশরিকরা তাঁর প্রতি এতো যুল্ম অত্যাচার করেছিলো যে, যদি তা বিশাল পাহাড়ের উপর করা হতো, তবে তা সেটা আপন স্থানে স্থির থাকতে পারতোনা। কিন্তু হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কতো দৃঢ়তা ও অটলতার সাথে আপন গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন, তাতে তিনি কারো পরোয়া করেননি। তাই যদি বক্ষ বিদীর্ণ করা না হতো, তাঁর প্রতি আল্লাহ্র সাহায্য না হতো, তবে তিনি (হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এটা কী করে বরদাশত করতেন? তাই আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, ‘আমি কি আপনার বক্ষ প্রশস্ত করিনি? এ বক্ষ প্রশস্ত করার মধ্যে সব কিছু এসে যায়। যাহেরী ও বাতেনী জ্ঞান এবং দুনিয়া ও আখিরাত সব কিছু এসে যায়।
আর আপনার ওই বোঝাও অপসারণ করেছি, যা আপনার পিঠকে ভেঙ্গে দিয়েছেলো (অর্থাৎ যা আপনার জন্য ছিল অতিশয় কষ্টদায়ক)। আপনার গোত্রের ও আরববাসীদের চরিত্র দেখে, তাদের মূর্খতা ও দেব-দেবীর পূজা দেখে, তাদের গর্ব-অহংকার দেখে আপনার অনেক কষ্ট হয়েছিলো, তাই আল্লাহ্ তাবারকা ওয়া তা‘আলা আপনাকে নুবূয়ত দান করেছেন আপনার যে দায়িত্ব ও কষ্ট ছিলো, তা আল্লাহ্ তা‘আলা আপনার নিকট থেকে অপসারণ করে দিয়েছেন।
আর আমি আপনার জন্য আপনার স্মরণকে সুউচ্চ করেছি। আপনার মর্যাদাকে বুলন্দ করেছি। একদা হযরত জিবরাঈল আলায়হিস সালাম হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে এসে আরয করলেন, ‘‘হে আল্লাহ্র রসূল! আল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করছেন, তিনি আপনার মর্যাদাকে কীভাবে সুউচ্চ করবেন।’’ তখন হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, ‘‘আল্লাহ্ তা‘আলাই তা ভালো জানেন।’’ তখন আল্লাহ্ তা‘আলা বললেন, ‘‘হে প্রিয় রসূল! আমি আমার নামের সাথে আপনার স্মরণকে বুলন্দ করলাম। আযানে আপনার নাম হবে, খোৎবায় আপনার নাম হবে, আরশে আপনার নাম থাকবে, পৃথিবীতে আপনার নামের ডঙ্কা বাজবে। অর্থাৎ যেখানে আমার নাম নেওয়া হবে, সেখানে আপনার নামও নেওয়া হবে। তাইতো আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে ফিরিশ্তারা সর্বদা দুরূদ পড়ে থাকেন, মু’মিনরাও তাঁর প্রতি দুরূদ শরীফ পড়ছেন। আমার অনুগত্যে আপনার আনুগত্যকেও শামিল করে নিয়েছি।
‘‘যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করলো, সে আল্লাহ্র আনুগত্য করলো।’’ আর গোটা পৃথিবীতে যারা আপনার মর্যাদাকে খাটো করতে চায়, কমাতে চায়, তারা আল্লাহ্র সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মর্যাদাকে কে কমাতে পারে? যাঁর মর্যাদাকে স্বয়ং আল্লাহ্ বুলন্দ করেছেন, কার সাধ্য আছে তাঁর মর্যাদাকে খাটো করার? আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে ও আপনাদের সকলকে বুঝার তাওফীক্ব দিন।
বাতিল ফিরক্বার লোকেরা এ জন্য প্রতারিত হয় যে, তারা আনুগত্য, মুহব্বত, আদব ও ইবাদতের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। আল্লাহ্ তাবারকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ করেন, ‘‘তোমরা রসূলকে সম্মান করো, তাঁকে শ্রদ্ধা করো।’’ হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রেম-ভালবাসা যে হৃদয়ে নেই, তা ঈমানশূন্য। তাই আমাদের প্রতি নির্দেশ রয়েছে, তাঁর প্রতি মুহব্বত করার, তাঁকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার ও তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ করার। যে রাসূলের আনুগত্য করলো, সে আল্লাহ্র আনুগত্য করলো। কিন্তু যেখানে ইবাদত করার কথা আছে সেখানে বলা হয়েছেÑ ‘‘আল্লাহ্ ছাড়া কারো ইবাদত করো না।’’ তাই, ‘ইবাদত, ‘ইত্বা’আত (আনুগত্য), আদব ও মুহব্বত-এর মধ্যে পার্থক্য করা উচিত। কিন্তু বাতিল ফিরক্বার লোকেরা মুহব্বতকে র্শিক বলে, ইবাদতকেও শিরক বলে। তারা তো জাহিল বা মুর্খ। যার মধ্যে আদব নেই, সে বঞ্চিত হয়, যার মধ্যে মহব্বত নেই, তার ঈমান নেই, যে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করেনি, সে আল্লাহ্র আনুগত্য করেনি। কিন্তু যেখানে আল্লাহ্র ইবাদতের কথা আছে, সেখানে বলা হয়েছে, ‘লা-তা’বুদূ- ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া কারো ইবাদত করো না। ইবাদত এক জিনিস, ইত্বা‘আত অন্য জিনিস। আদব এক জিনিস আর মুহব্বত অন্য জিনিস। যদি এতে পার্থক্য করা না হয়, তবে তা হবে যন্দিক্বী। আল্লাহ্ তাবারকা ওয়া তা‘আলা আমাকে ও আপনাদের সকলকে বুঝার তাওফীক্ব দিন। আ-মী-ন।
অতঃপর, নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে। ওই সময় (হে হাবীব) আপনার উপর এতসব মুসীবৎ এসেছে, কষ্ট এসেছে, আপনার সাহাবা কেরামের নিকট এতসব কষ্ট পৌঁছেছে যে, লোকেরা তাঁদের শত্র“, তবে এগুলো অতি অল্প দিনের জন্যই। অনতিবিলম্বে এসব লোক ঈমানের দাবীদার হয়ে যাবে, এসব লোক ইসলামের দাবীদার হয়ে যাবে, এরা আপনার গোলাম হয়ে যাবে। অনুরূপই হয়েছে বাস্তবে। অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে ওই সব লোক, যারা কাফির ছিল, যারা রক্তের পিপাসু ছিল, ওই সব লোকই আপনার গোলাম হয়ে গেছে। ওই সব লোকই দ্বীনের পতাকাবাহী হয়ে গেছে।
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, সুতরাং নিশ্চয় কষ্টের পর স্বস্তি রয়েছে।
সুতরাং আপনি যখন নুবূয়তের দাত্বিয়াবলী পালন করে নেবেন, তখন রিয়াযত (এবাদত) -এ মশগুল হয়ে যাবেন। আল্লাহ্রই পবিত্রতা! এ রিয়াযত (এবাদত-সাধনা) এমন গুরুত্বপূর্ণ যে, আল্লাহ্ তা‘আলা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে এরশাদ ফরমাচ্ছেন, ‘‘আপনি যখন নুবূয়তের দায়িত্ব পালন করে নেবেন, তখন রিয়াযতে মশগুল হয়ে যাবেন।
এ যে আপনাদের তরীক্বতের সবক দেয়া হচ্ছে, এ যিক্র, এ দুরূদ শরীফ, এ সালাতে আওয়াবীন, এগুলো এমন সব গুরুত্বপূর্ণ বস্তু যে, এগুলো দ্বারা মানুষের উন্নতি হয়। ইনসানের মে’রাজ তো এগুলো দ্বারাই হয়। আর মানুষের দুনিয়াতে আসার উদ্দেশ্যও এ থেকে হাসিল হয়, মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। আর এ যে সবকগুলো রয়েছে, তাসবীহ্-তাহলীল ওযীফা রয়েছে, সেগুলো যেন অতি মুহাব্বতের সাথে সম্পন্ন করা হয়, অতীব নিষ্ঠার সাথে যেন পালন করা হয়। এতে বড় উদ্দেশ্য রয়েছে। আর যখন আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেন, ‘এবং যখন আপনি অবসর হন নুবূয়তের দায়িত্বাবলী পালন করার পর, তখন এর মধ্যে লেগেই থাকুন। এবং স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি মনোনিবেশ করুন।’
আল্লাহ্ আমাদেরকে, আপনাদেরকে আমল করার শক্তি দান করুন। আ-মী-ন।
নূরানী তাক্বরীর-আঠার
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
وَ التِّیْنِ وَ الزَّیْتُوْنِۙ(۱) وَ طُوْرِ سِیْنِیْنَۙ(۲) وَ هٰذَا الْبَلَدِ الْاَمِیْنِۙ(۳) لَقَدْ خَلَقْنَا الْاِنْسَانَ فِیْۤ اَحْسَنِ تَقْوِیْمٍ٘(۴) ثُمَّ رَدَدْنٰهُ اَسْفَلَ سٰفِلِیْنَۙ(۵) اِلَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ فَلَهُمْ اَجْرٌ غَیْرُ مَمْنُوْنٍؕ(۶) فَمَا یُكَذِّبُكَ بَعْدُ بِالدِّیْنِؕ(۷) اَلَیْسَ اللّٰهُ بِاَحْكَمِ الْحٰكِمِیْنَ۠(۸)
তরজমা:
১. ডুমরের শপথ ও যায়তূনের ২. এবং সিনাই পর্ব্বতের, ৩. আর নিরাপদ শহরের; ৪. নিশ্চয় আমি মানুষকে সর্বোৎকৃষ্ট আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি, ৫. তারপর তাকে নিন্ম থেকে নিন্মতর অবস্থার দিকে ফিরিয়ে দিয়েছি; ৬. কিন্তু যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ করেছে, তাদের জন্য অফুরন্ত প্রতিদান রয়েছে, ৭. অতঃপর এখন কোন্ জিনিষ তোমাকে ন্যায় বিচারকে অস্বীকার করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে? ৮. আল্লাহ্ কি সকল বিচারকের চেয়ে শ্রেষ্ঠতম বিচারক নন? [সূরা ত্বী-ন : আয়াত ১-৮, কানযুল ঈমান]
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেন, আঞ্জীর বা ডুমুর ফলের শপথ, যায়তূন বৃক্ষের শপথ, আর তূর পর্বতের শপথ এবং এ নিরাপদ নগরী অর্থাৎ মক্কা মুর্কারমার শপথ!
এখানে এ বস্তুগুলোর শপথ এ জন্যে করা হয়েছে, যাতে সামনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মনযোগের সাথে শ্রবণ করা হয়। তাই ওই চারটি শপথের সাথে এ বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে।
‘ডুমুরফল’ (আন্জীর) হচ্ছে উৎকৃষ্ট মানের ফল, যাতে পরিত্যাজ কিছুই নেই। দ্রুত হজমী, অতি উপকারী, মসৃণ, সহজভোজ্য, পাকস্থলীর বালুকণা অপসারণকারী আঁত বা কলিজার গ্রন্থী উম্মুক্তকারী, দেহকে সবলকারী ও কফ অপসারণকারী।
‘যায়তূন’ একটা বরকতময় বৃক্ষ। এর তৈল প্রদীপ জ্বালানোর কাজেও ব্যবহৃত হয় এবং ব্যাঞ্জন (তরকারী)-এর পরিবর্তেও খাওয়া যায়। এ গুণ দুনিয়ার অন্য তেলে নেই। এর গাছ শুষ্ক পর্বতগুলোতে জন্মে। কোন প্রকার যতœ ব্যতিরেকেই উৎপন্ন হয়। হাজার হাজার বছর যাবৎ বিদ্যমান থাকে। এসব জিনিষে আল্লাহ্র মহাশক্তির নিদর্শন সুস্পষ্ট হয়।
আর ত্ব ূর? এটাকে ‘ত্বূরে সায়না’ বা ত্বূর পাহাড়ও বলা হয়। ত্বূর পাহাড়ে আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর সাথে কথা বলার মাধ্যমে তাঁকে সম্মানিত ও গৌরাবান্বিত করেছেন। আর দামেস্ক, যেখানে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম শুভাগমন করেন এবং সেখান থেকে নুবূয়ত ও রেসালতের কার্য আরম্ভ করেন। বায়তুল মুক্বাদ্দাস হলো নবীগণের শহর। অনেক বড় বড় নবী ওই শহরে শুভাগমন করেছেন। আর মক্কা মুর্কারমা হলো নিরাপদ ও বরকতময় স্থান।
এটা এমন নিরাপদ শহর যে, যখন আরবের সর্বত্র খুনাখুনি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের বাজার গরম ছিলো, তখনও মক্কার লোকেরা নিরাপদে ছিলো। মক্কা মুর্কারমার ব্যবসায়ী কাফেলা বহির্দেশে গেলে সেখানেও তারা নিরাপদে থাকতো, লোকেরা তাদেরকে (মক্কার লোক হিসেবে) সম্মান করতো। তাদের দিকে চোখ তুলে দেখারও কারো সাহস হতো না। আর যে সেখানে (মক্কার হেরেম শরীফ) প্রবেশ করে, সে নিরাপদ থাকে। তেমনিভাবে জঙ্গলের কোন চিতা বাঘও যদি কোন শিকারের পেছনে ছুটে আর ওই শিকার দৌঁড়ে গিয়ে যদি হেরেম শরীফের ভিতর চলে যায়, তবে ওই হিং¯্র বাঘও তাকে ধাওয়া না করে ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ যে কেউ এ হেরম শরীফে প্রবেশ করলো, তার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হলো।
আর এ মক্কা মুর্কারমাহ্? হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম ও হযরত ইসমা‘ঈল আলায়হিস্ সালাম খানা-ই কা’বা নির্মাণ করেছেন। আর তা’তে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শুভ জন্ম হয়।
তাই এ নগরীকে অনেক মর্যাদা দান করা হয় এবং এটা খুব নিরাপদ নগরী। ‘এতে আল্লাহ্ তা‘আলার প্রকাশ্য ও স্পষ্ট নিদর্শনাবলী বিদ্যমান।
অতএব, আল্লাহ্ তা‘আলা এ সব পবিত্র স্থানের শপথ করার পর এরশাদ করছেন, ‘নিশ্চয় নিশ্চয় আমি মানুষকে সুন্দর আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি।’ এটা হলো শপথের উত্তর। (অর্থাৎ) আকার-আকৃতিতে, জ্ঞান-গরিমায় আর সৃষ্টিগত দিক দিয়ে অনেক উত্তম পদ্ধতিতে আমি (আল্লাহ্) ইনসানকে সৃষ্টি করেছি। মানুষের জন্ম ও অতি উত্তম সর্বোত্তম পদ্ধতিতে হয়েছে। চিন্তা করে দেখুন যে, এ মনুষ্য জাতি সৃষ্টির সবকিছু হতে সুশ্রী। আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে খিলাফতের তাজ পরিয়েছেন। (পৃথিবীতে আল্লাহর বিধান কার্যকর করার কাজ) দিয়েছেন।
আর নিশ্চয় নিশ্চয় আমি আদম সন্তানদের কে সম্মানিত করেছি।’ উপাধি পেয়েছে। আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এ সব কিছুকে তার অধীন ও আনুগত্যশীল করেছেন, অনুসারী করেছেন।
আর আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষকে সমস্ত সৃষ্টি হতে অনেক বেশী সম্মান ও মর্যাদার পাত্র বানিয়েছেন। এ তার চোখ দেখুন, এ কান দেখুন, এ হাত এবং সমগ্র শরীর দেখুন। প্রত্যেক বস্তু স্ব স্ব স্থানে সম্পূর্ণ সুসজ্জিত ও সুবিন্যস্ত। চক্ষু যদি তার স্থানে না হয়ে অন্য কোথাও হতো, কান যদি আপন স্থানে না হতো, যদি মাথা স্ব-স্থানে না হতো, হাত তার যথাস্থানে না হতো, তবে তা একেবারে অসুন্দর দেখাতো। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষের প্রত্যেক কিছুকে আপন আপন স্থানে সুবিন্যস্ত করেছেন এবং তার জন্মকে অত্যন্ত উত্তম পদ্ধতিতে করিয়েছেন, যাতে সে সৃষ্টির সেরা হয়।
খলীফা মনসূরের যুগে ঈসা ইবনে মূসা নামে এক প্রসিদ্ধ লোক ছিলো। সে তার স্ত্রীকে একদা বললো, “তুমি যদি চাঁদের চেয়ে বেশী সুন্দর না হও, তবে তোমাকে আমার পক্ষ হতে তিন তালাক্ব।”
সে তার এ উক্তির উপর দুঃখিত হয়ে খলীফার নিকট এটার সমাধানের জন্য গেলো। খলীফা ফক্বীগণকে একত্রিত করে বললেন, ‘‘আপনারা এ উক্তির ব্যাপারে কী বলেন?’’ (তার স্ত্রীর উপর তালাক্ব বর্তাবে কিনা)। তখন উপস্থিত সকল ফক্বীহ্ বললেন, “এতে তালাক্ব হয়ে গেছে।” ওখানে ইমাম-ই আ’যম রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর এক ছাত্র উপস্থিত ছিলেন। তিনি নিশ্চুপ র’য়ে সকলের রায় শ্রবণ করছিলেন। খলীফা মনসূর বললেন, ‘‘আপনি কিছু বলছেন না কেন? আপনিও আপনার রায় ব্যক্ত করুন।’’ তখন তিনি বললেন, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। ডুমুরফল, যায়তূন, ত্ব ূরে সায়না ও নিরাপদ শহরের শপথ! নিশ্চয় আমি মানব জাতিকে সর্বাধিক সুন্দর আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি।’’
এ’তে বুঝা যাচ্ছে যে, মানুষ চাঁদ থেকেও অধিক সুন্দর। অতএব, তালাক্ব হয়নি।’’ খলীফা মনসূর এটা শুনে বললেন, ‘‘তোমার উত্তরই সঠিক।’’ মানসূর তখনই ঈসার স্ত্রীর নিকট খবর পাঠালেন, যেন সে তার স্বামীর কাছে চলে যায়। আর বলে পাঠালেন, ‘‘তোমাদের বিবাহ্ যথারীতি অটুট রয়েছে।’’ অতএব, মানুষকে আল্লাহ্ তা‘আলা প্রত্যেক দিক দিয়ে, সর্বোত্তম পদ্ধতিতে, সুন্দরতম অবয়বে সৃষ্টি করেছেন।
অত:পর আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেন, “তারপর আমি (আল্লাহ্) মানুষকে (তার কৃতকর্মের দরুন) সর্ব নি¤œস্তরে পৌঁছিয়েছি। তাকে হীন থেকে হীনতর স্থানে নিয়ে যাই।” এটার অর্থ কি? আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষকে খিলাফতের মর্যাদা ও বিবেক-বুদ্ধির দিক দিয়ে মহিমান্বিত করেছেন। কিন্তু সে যখন এসব কিছুকে ছেড়ে দিলো, নিজের মাথা হতে সম্মানের মুকুট ফেলে দিলো, পাপ ও অন্যায়ের বাজার গরম করে তুললো, আল্লাহ্ ও রসূলের নাফরমানী (অবাধ্যতা)-এর ব্যবস্থা করলো, ঔদ্ধত্য ও অভদ্রতা প্রদর্শন আরম্ভ করলো, এভাবে যখন ইন্সানিয়াত অর্থাৎ মানবতার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকলো না, জীবন্ত কন্যা শিশুকে কবর দিতে আরম্ভ করলো, তখন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, ‘‘নিশ্চয় আমি তাকে ‘আসফালা সাফিলীন’ বা হীন থেকে হীনতর স্তরে নিক্ষেপ করেছি।”
ক্বিয়ামত দিবসে হিসাব-নিকাশের পর জীব-জন্তুগুলোকে মাটিতে পরিণত করে দেওয়া হবে; কিন্তু মানুষ? মানুষের জন্য হয়তো জান্নাতে হবে, নতুবা হবে দোযখ। সে হয়তো জান্নাতে যাবে, নতুবা দোযখে যাবে। এজন্য মানুষ যখন তার ইন্সানিয়াতের মর্যাদা থেকে সরে দাঁড়ায়, তখন সে চতুষ্পদ জন্তু হতেও নিকৃষ্ট হয়ে যায়। আর চতুষ্পদ জন্তু তার চেয়ে উত্তম। যেমন এরশাদ হচ্ছে- ‘তারা চতুষ্পদ জন্তুর সাথে তুল্য; বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট।’ কেননা, আল্লাহ্ তা‘আলা তার উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন অপরিহার্য করেছিলেন, সে তা পালন করে নি এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি। তাই, তার শেষ পরিণতি কী হলো? ‘আসফালা সাফিলীন’ অর্থাৎ সে দোযখের সর্বনি¤œ স্তরে নিক্ষিপ্ত হবে।
এখানে আল্লাহ্ তা‘আলা কত বড় অনুগ্রহই করেছেন! যেমন এরশাদ হচ্ছে- ‘ইল্লাল্ লাযী-না আ-মানূ, হাঁ যারা ঈমান গ্রহণ করলো, ওয়া‘আমিলুস্ সোয়া-লিহা-ত আর সৎকর্ম করলো, যার কর্ম সৎ ‘ফালাহুম আজ্রুন গায়রু মামনূন’ তাদের জন্য রয়েছে অশেষ পুরস্কার ও প্রতিদান, যা কখনো শেষ হবার নয়, যা কখনো নিঃশেষ ও বন্ধ হবে না- তাদেরকে এত বেশী প্রতিদান দেয়া হবে।
এটা (পুরস্কার) কোন্ লোকদের জন্য? তাদেরই জন্য যাদের ঈমান আছে আর যাদের কৃতকর্মগুলো সৎ। এখানে সর্বপ্রথম ঈমানের কথা বলা হয়েছে। তাই প্রথমে ‘ঈমান’ হলো অপরিহার্য বিষয়। আর কেউ যদি হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মান-মর্যাদাকে কমানোর চিন্তায় থাকে তার ঈমান থাকে না, ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। যদি সত্যিকার অর্থে মু’মিন হয়, ঈমান ঠিক থাকে, আমলও যদি সৎ থাকে তবেই আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে সে এতোবেশি প্রতিদান ও পুরস্কার পাবে, যা কখনো নি:শেষ হবার নয়, যা কখনো নিঃশেষ হবে না।
তাফসীরকারকগণ এ আয়াতের অনেক অর্থ করে থাকেন। তাঁদের মধ্যে কতেক এটাও বলেছেন যে, আল্লাহ্ তা‘আলা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উদ্দেশে বলেছেন, এরপর আপনাকে, আপনার দ্বীনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে?
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা কি সকল বিচারকের উপর বিচারক নন? সমস্ত বাদশাহ্দের উপর বাদশাহ্ নন কি? (অবশ্যই তিনি সবার উপর বাদশাহ্।) এখানে এটার অর্থ হলো এ যে, আল্লাহ্ তা‘আলা নেক্কারদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর অসৎ লোকদেরকে দোযখে প্রবেশ করাবেন। তখন এ সম্পর্কে কেউ কি কোন আপত্তি তুলতে পারবে? (মোটেই পারবেনা।)
তাই আল্লাহ্ তা‘আলা আহকামুল হাকিমীন হিসেবে কি এমনটি করবেন যে, যারা দিবারাত্রি আল্লাহ্র স্মরণে কাটিয়েছে, সৃষ্টিজগতের কল্যাণার্থে কাজ করেছে, পক্ষান্তরে, যারা পাপাচারে রাতদিন সৃষ্টিজগতের অনিষ্ট ও কষ্ট দেয়ার মাঝে অতিবাহিত করেছে এ দু’দলকে আল্লাহ্ তা‘আলা একস্থানে রাখবেন? কখনো না। যারা সৎকর্মশীল, যারা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর গোলাম, তাঁদের জন্য বেহেশত নিশ্চিত। আর যারা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি অসৌজন্য মূলক আচরণকারী তাদের জন্য দোযখ অবধারিত। যারা নেক্কার, যাদের সৎকর্ম রয়েছে তাদের জন্য জান্নাত রয়েছে। আর যে বদ্কার তার জন্য দোযখ- আল্লাহ্ তা‘আলা এ ফায়সালা করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ আমাদেরকে ইন্সানিয়াতের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার শক্তি দিন।
আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। আর বলেছেন, আমি (আল্লাহ্) আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি। আর এ শেষ যুগে আমাদেরকে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতের মধ্যে স্থান দান করেছেন- এটা আমাদের প্রতি তাঁর বড় করুণা ও দয়া। যদি আমরা এসব নি’মাতের গণনা করি, তবে কখনো হিসাব করে সেগুলো শেষ করতে পারবো না।
এরশাদ হচ্ছে- আল্লাহ্ আমাদেরকে এতো পরিমাণ নি’মাত দান করেছেন যে, যদি তোমরা আল্লাহর নি’মাতগুলোকে গণনা করো, তবে সেগুলো গণনা করতে পারবেনা’ সেগুলো কখনো গণনা করে শেষ করা যাবে না। আর যদি এ নি’মাত প্রাপ্তিতে আমরা তাঁর (আল্লাহ্র) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, তবে তিনি আরো বাড়িয়ে দেবেন। (যেমন আল্লাহ্ বলেন) ‘যদি তোমরা আল্লাহ্র শোকরিয়া আদায় করো, তবে তিনি তোমাদেরকে আরো বাড়িয়ে দেবেন।’ আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা আমাকে আপনাদেরকে আল্লাহর এ সব নি’মাতের শোকরগুযারী করার তাওফীক্ব দিন। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে এ শেষ যুগে মুরশিদে বরহক, হক্ব সিলসিলা দান করেছেন, আর মাদরাসা ও তরীক্বতের খেদমত ও সেবা করার তাওফীক্ব দান করেছেন, এটার যতো শোকরিয়া করিনা কেন, তা অতি নগণ্য। আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা আমাদেরকে ও আপনাদের সবাইকে এ জীবনে এবং এ খেদমতে সদা অবিচল ও সুদৃঢ় রাখুন। আ-মী-ন।
নূরানী তাক্বরীর-ঊনিশ
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়ত্বান থেকে।
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
اِذَا جَآءَ نَصْرُ اللّٰهِ وَ الْفَتْحُۙ(۱) وَ رَاَیْتَ النَّاسَ یَدْخُلُوْنَ فِیْ دِیْنِ اللّٰهِ اَفْوَاجًاۙ(۲) فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَ اسْتَغْفِرْهُﳳ-اِنَّهٗ كَانَ تَوَّابًا۠(۳)
তরজমা:
১. যখন আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার সাহায্য ও বিজয় আসবে, ২. এবং দ্বীন ইসলামের বিজয় অর্জিত হবে, আর যখন আপনি লোকদেরকে দেখবেন আল্লাহ্র দ্বীনে দলে দলে প্রবেশ করছে; ৩. অতঃপর আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাকারী অবস্থায় তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর থেকে (উম্মতের জন্য) ক্ষমা চান। নিশ্চয় তিনি অত্যন্ত তাওবা কবূলকারী। [সূরা নাসর: আয়াত-১-৩]
স্মরণ করুন, যখন মক্কা বিজয় হচ্ছিলো, দশ/বার হাজার সাহাবা-ই কেরাম হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথী ছিলেন আর হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে এ বলে উপদেশ দিচ্ছিলেন যে, ‘সাবধান! তোমাদের কেউ যেন কোন প্রকারে প্রথম আক্রমকারী না হও, নিজেদের তীর-কামান রেখে দাও, তলোয়ারগুলোকে খাপে রেখে দাও! আর যতক্ষণ মক্কাবাসী তোমাদের উপর আক্রমণ করবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তাদের দিকে (আক্রমণের জন্য) অগ্রসর হবে না।
দশ/বার হাজার সাহাবা-ই কেরামের পদভারে মক্কা ভূমি যেন আন্দোলিত হয়ে উঠলো। এর কিছু কাল পূর্বে যে স্থান হতে আমাদের আক্বা ও মাওলা (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) হযরত সিদ্দীক্ব-ই আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে সাথে নিয়ে পবিত্র মক্কা হতে হিজরত করেন, আর কাফিরগণ তাঁদের উভয়ের সন্ধানে বের হয়েছিলো। আজ কিছু কাল পর সমগ্র দুনিয়াবাসী এ দৃশ্য দেখলো যে, দশ। বার হাজার সাহাবা-ই কেরাম প্রত্যেক রকমের যোদ্ধাস্ত্র নিয়ে সুসজ্জিত হয়ে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে (মক্কায়) আসলেন। সুবহা-নাল্লাহ্! কী অপূর্ব দৃশ্য!
তিনি (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করলেন, ‘‘যে ব্যক্তি হেরম শরীফের মধ্যে প্রবেশ করবে সে নিরাপত্তায় থাকবে, আর যারা নিজ নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘরের ভিতর অবস্থান করবে তাদের জন্য নিরাপত্তা রইলো, যে ব্যক্তি আবূ সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে তার জন্য নিরাপত্তার সুসংবাদ রইলো, কিন্তু বর্তমানে যদি এ প্রকার কোন বিজয় সাধিত হতো, তবে শক্রতার আগুন জ্বলে উঠতো। মক্কার লোকদের জন্য সাধারণ হত্যার নির্দেশ ঘোষণা হতো-‘সবাইকে হত্যা করো! তারা আমাদের উপর পূর্বে কত নির্যাতনই করেছে? হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণকে তাদের অত্যাচারের কারণে আপন মাতৃভূমি ছাড়তে হয়েছিলো। এমন কি মদিনায়ও তাঁদেরকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি, সেখানেও তাঁদের দিকে হামলা পরিচালনা করা হয়। ইসলামের বাগিচাকে খতম করার জন্য এগিয়ে যায়, দুনিয়ার বুকে যত নির্যাতন, অত্যাচার ও অবিচার হতে পারে সবই কাফিরদের দ্বারা সম্পন্ন হয়েছিলো।
কিন্তু এখন সরওয়ারে কা-ইনাত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দশ/বার হাজার সাহাবা-ই কেরাম সমেত (মক্কায়) তশরীফ নিয়ে যাচ্ছেন এবং তাদের উপর চড়াও হচ্ছেন।
কিন্তু আল্লাহ্রই পবিত্রতা! তিনি আজ এভাবে মক্কায় প্রবেশ করছেন যে, আল্লাহর দরবারে তিনি আজ শির মুবারক ঝুঁকিয়ে দিয়েছেন। এদিকে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হচ্ছে। অশ্রু দিতে দিতে করতে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মক্কায় প্রবেশ করেন। এ স্থলে যদি দুনিয়ার অন্য কোন বাদ্শা হতেন, তবে তিনি যালিমদেরকে বেছে বেছে হত্যা করতেন। এমনকি তাদের উপর যত শাস্তিই দেওয়া হতো, তা তাদের অত্যাচারের তুলনায় অনেক কমই হতো।
কিন্তু এ রাহ্মাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দুনিয়াবাসীর জন্য আদর্শ আপন উম্মতদের জন্য নমুনা, এমন কি দুনিয়ার সকল রাজা-মহারাজার জন্য আদর্শ মহাপুরুষ। তিনি (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এমন শান ও মর্যাদা সহকারে মক্কা বিজয় করছেন যে, সকলের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। অন্যদিকে প্রত্যেক বিদ্রোহী এ ভয়ে সদা কম্পমান যে, এখন আমাদের পরিণাম কী হবে?
কিন্তু রাহ্মাতুল্লিল ‘আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সকলের প্রতি দয়াপবরশ হয়ে সবাইকে ক্ষমা দিলেন। সকলকে (প্রতিশোধ না নিয়ে) ছেড়ে দিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে এখন যারা শক্র ছিলো, সবাই (তাঁর) গোলামে পরিণত হয়েছে, সবাই ইসলামের একেকজন রক্ষক বনে। তখন আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন, যখন আসলো আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়।’
অতএব, এ আয়াত মুবারকা দ্বারা আমাদের এ শিক্ষা অর্জিত হলো যে, যদি কারো কোন-প্রকারের সাফল্য অর্জিত হয়, সে যেন ভাল কাজ করে, আল্লাহর ইবাদত করে, কারো প্রতি দয়া-অনুগ্রহ করে, সৎ কাজ করে। অথবা এভাবে বলা যায়- কারো কোন গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জিত হলে, তিনি যেন একথা না বলেন, ‘আমি এটা করেছি, আমি ওটা করেছি, এটা আমার যোগ্যতা হয়েছে বলে এ প্রকারের ধারণাও অন্তরে না আসা চাই; বরং এতে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার এ বলে শোক্রিয়া বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাই উচিত যে,
‘হে আল্লাহ্, তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, তুমি আমাকে এ পুণ্যকর্ম করার তাওফীক্ব দিয়েছো।
আমাকে নামায পড়ার, এ মাদ্রাসা ইত্যাদির খিদমত করার শক্তি ও সামর্থ্য দিয়েছো। যদি তোমার শক্তি ও সামর্থ্য এতে যোগ না হতো তবে এটা করা আমার পক্ষে সম্ভবপর হতো না। এটা একমাত্র তোমার দয়া ও করুণারই বহিঃপ্রকাশ। এটা তরীক্বত (ইলমে তাসাওফ)-এর পথ পরিক্রমায়ও বড় সবক যে, যখন কোন ইবাদত-বন্দেগী করবে, ভাল কাজ করবে, তখন এটা বলবে না, আমি এটা করেছি, আমি ওটা করেছি। সাবধান! এতে মানুষের হৃদয়ে অহংবোধ সৃষ্টি হয়। আর মানুষ তার অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বদর যুদ্ধে এক আযীমুশ্শান বিজয় করেছেন। যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনকালে সাহাবা-ই কেরাম পথিমধ্যে এভাবে বলাবলি করলেন, ‘আমরা কাফিরগণকে এমন এমনভাবে কতল করেছি, শয়বাহ্কে হত্যা করেছি।’
এ ধরনের আলোচনা করতেই ওহী আসলো- ‘তোমরা কতল করোনি তাদেরকে, বরং আল্লাহ্ই কতল করেছেন।’ এতে বড় শিক্ষা রয়েছে। আল্লাহ্ আমাকে আপনাদেরকে ওই সুযোগ দান করেছেন! আমরাও আল্লাহ্র পথে জিহাদে অংশ নিতে পেরেছি এবং এভাবে জিহাদে শরীক হয়েছি, আর কাফিরদের মুকাবেলায় যুদ্ধের সারিতে শামিল হয়েছি। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে ও আপনাদেরকে ওই তাওফীক্ব দিন।
এতে এরশাদ হচ্ছে যে, “যখন আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার সাহায্য ও বিজয় আসবে, আর যখন আপনি দেখবেন দলে দলে লোক ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হচ্ছে, তখন আপনি আল্লাহ্ তাবারকা ওয়া তা‘আলার হাম্দ (প্রশংসা) বর্ণনা করে তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করুন। আর আপনার উম্মতের জন্য আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন, যেন এ রসূলের ইসতিগফার (ক্ষমাপ্রার্থনা) উম্মতের জন্য সনদ হয়ে যায়।
এজন্য এসতেগফার বড় মূল্যবান। তাই বুযুর্গ ব্যক্তিদের বেলায় আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার এ এরশাদ- ‘তারা সেহেরীর সময় আল্লাহ্র কাছে ইস্তেগফার অর্থাৎ ক্ষমা প্রার্থনায় রত থাকে।’ এ জন্য উচিত-ইসতিগ্ফার বেশী পরিমাণ করা।
‘আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা তাদেরকে আযাব দেবেন না যতক্ষণ তাঁরা এসতেগফারে রত থাকবে।’ এ আযাবের মধ্যে দুনিয়ার দুঃখ-কষ্টও আছে, আবার পরকালের আযাবও আছে। ইন্শাআল্লাহ! ইসতিগফারের কারণে সব মাফ হয়ে যাবে। আল্লাহ্ তাবারকা ওয়া তা‘আলা অত্যন্ত তাওবাহ্ কবুলকারী।
এ সূরা মুবারকে মুসলমান ও সারা বিশ্বের বাদ্শাদের জন্যও কত বড় শিক্ষা রয়েছে। এর নাম দয়া, এর নাম বদান্যতা, এটার নাম শক্রকে একান্ত হাতের মুষ্ঠিতে পাওয়ার পরও ছেড়ে দেয়া এবং তাকে ক্ষমা করে দেওয়া আর এটা রাহমাতুল্লিল আ‘লামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শান বা মহা মর্যাদা। আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা আমাদেরকে ও আপনাদেরকে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পদাঙ্ক অনুসরণ ও অনুকরণ করে চলার তাওফীক্ব দিন। আমীন।